গুরু মহারাজ স্বামী পরমানন্দের কাছে শোনা কথাগুলি নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল ৷ আমরা শুরু করেছিলাম মানব ও মানব বিবর্তনের ইতিহাসের কথা । কিন্তু বর্তমান পৃথিবীর হিংসা-মারামারি-যুদ্ধের যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, এমন পরিস্থিতি বা এর চাইতেও ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি পূর্বে পূর্বে এই পৃথিবী প্রত্যক্ষ করেছে – শুধুমাত্র তখন যুযুধান পক্ষেরা পৃথক ছিল, যুদ্ধের কারণ আলাদা ছিল! পৃথিবীতে ক্ষমতাবানদের অহংকারে-র প্রদর্শনের কথা উঠলেই গুরুমহারাজ ভারতীয় দুই মহাকাব্যের দুই খলনায়ক রাবণ ও দুর্যোধনের উল্লেখ করতেন, এখন সেই প্রসঙ্গে একটু বলে নেওয়া হচ্ছে ! তারপরেই আমরা আবার ফিরে যাবো – আমাদের পুরোনো আলোচনায়, অর্থাৎ মানব সমাজ বিবর্তনের ইতিহাসে ।
গুরু মহারাজ বলেছিলেন রাবণের অহংকারের কথা ! তার অহংকার করার যথেষ্ট কারণ ছিল কারণ তৎকালীন সময়ে (আজ থেকে প্রায় দশ হাজার বছর আগে ভগবান রামচন্দ্রের লীলা-র কাল ছিল, – এটাই গুরু মহারাজ বলেছিলেন) উত্তর ভারত বা আর্যাবর্তের সভ্যতা এবং দাক্ষিণাত্যের দ্রাবিড় সভ্যতা অপেক্ষাও রাবণের রাজধানীর সভ্যতা , বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে অনেক বেশি উন্নত ছিল ! তৎকালীন ‘মায়া’ সভ্যতা (দক্ষিণ আমেরিকার মেস্কিকোর সভ্যতা)-র সাথে যুক্ত হয়ে রাবনের লঙ্কা , বিজ্ঞান ও প্রযুক্ততে এতটা উৎকর্ষতা লাভ করেছিল। মায়া সভ্যতার প্রযুক্তিবিদদের মধ্যে দু-তিনজনের নাম পাওয়া যায় – ময়দানব, মারীচ এবং কালনেমি ৷ এরা সবাই ‘মায়া’-বিদ্যা জানতো, তাছাড়া ময়দানব তার জামাতা (তৎকালীন যুগে এক শক্তিশালী দেশের সাথে অন্য আরেকটি শক্তিশালী দেশের মিত্রতা স্থাপনের অন্যতম একটা মাধ্যম ছিল বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন । এমনকি মুঘল আমলেও সম্রাট আকবর শক্তিশালী রাজপুত জাতিকে নিজের অধীনে আনার জন্য যোধাবাঈ-এর সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিল) – রাবনকে “পুষ্পক” রথ দান করেছিল, যা আকাশমার্গ অবলম্বন করে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাতায়াত করতে পারতো । তাছাড়া তৎকালে রাবন পুত্র ইন্দ্রজিৎ-কে ‘মেঘনাদ’ নামে অভিহিত করা হতো এবং বলা হতো সে মেঘের আড়াল থেকে যুদ্ধ করতে পারে ! এসব থেকে সহজেই বোঝা যাচ্ছে যে রাবণের “প্রযুক্তি” কতটা উন্নত ছিল – তারা যুদ্ধ বিমান বা ছোট যাত্রী বিমান ব্যবহারে স্বচ্ছন্দ ছিল, তাদের বর্তমানের NASA-র ন্যায় গবেষণাগার ছিল, অত্যাধুনিক যুদ্ধাস্ত্রের (অগ্নিবান, বরুণবান যেগুলি আজকের মিসাইল এবং নাগবান, গরুড়বান – এগুলি রাসায়নিক অস্ত্র বা জীবাণুঅস্ত্র, ব্রহ্মাস্ত্র- পাশুপত অস্ত্র হোল আজকের পরমাণু অস্ত্র – গুরু মহারাজ এইভাবেই এগুলোর ব্যাখ্যা করেছিলেন)– ব্যবহার ছিল ।
তুলনায় আর্যাবর্তের রাজাদের (দশরথ), নিষাদরাজের (মধ্য ভারতের গুহক), দাক্ষিণাত্যের দ্রাবিড় রাজাদের (কিষ্কিন্ধ্যার রাজা বালি) প্রযুক্তি অতটা উন্নত ছিল না । গুরুমহারাজ বলেছিলেন – রামচন্দ্রের সময়ে ভারতবর্ষে তিনটি সভ্যতা ছিল – আর্য সভ্যতা, নিষাদ সভ্যতা ও দ্রাবিড় সভ্যতা । আর তৎকালীন ভারতবর্ষের বাইরেও পৃথক পৃথক সভ্যতা ছিল ৷ সব সময়েই পৃথিবীতে দুটি সংস্কৃতির ধারা প্রবহমান। এই দুই সংস্কৃতির জনক-ই ছিল প্রাচীন ভারতের দুজন ঋষি – দেবগুরু বৃহস্পতি এবং দৈত্যগুরু বা রাক্ষসগুরু শুক্রাচার্য ! তৎকালীন যুগে আর্য এবং দ্রাবিড় রাজাদের অধিকাংশরাই দেবগুরু বৃহস্পতির নীতি follow কোরতো, কিন্তু ভারতের ভিতরেই এবং বাইরের বেশিরভাগ রাজ্যে (দেশে) শুক্রাচার্য্যের নীতিই বেশি চলত ৷ বৃহস্পতির নীতি ছিল – বাইরের উন্নতির দিকে মন না দিয়ে নিজের অন্তর্জগতের উন্নতি করো, তাহলেই জীবন সুখময় ও শান্তিময় হয়ে উঠবে । কিন্তু শুক্রাচার্যের নীতি ছিল ভোগ-ঐশ্বর্য্যের দিকে মন দাও, বাহ্যিক উন্নতি করো, স্বাস্থ্যবান হও – যতদিন বেঁচে থাকবে স্ফূর্তিতে বাঁচো, মৌজ-মস্তিতে বাঁচো ! ভারতীয় দর্শনগুলির মধ্যে চার্বাক-দর্শন কিছুটা শুক্রাচার্যের দ্বারা প্রভাবিত ।
যাইহোক, আমাদের আলোচনা হওয়া উচিত রাবণকে নিয়ে – তাই সেখানেই ফিরে যাই । রাবণের সাম্রাজ্যে ঐশ্বর্য এবং শক্তির প্রাচুর্য ছিল, রাবণের নিজের কিছু সাধন-শক্তিও ছিল, ইন্দ্রজিৎ-বীরবাহু-র মতো বীরপুত্র ছিল, শক্তিশালী নামকরা সেনানায়ক বা সমর বিশেষজ্ঞেরা ছিল, দেব-দেবীরা সবসময় তার রাজপুরীতে বাঁধা থাকতো__ তাই তার তো অহংকার হবার-ই কথা । গুরুমহারাজ বলেছিলেন – রাবনের অহংকারে তখন যেন পৃথিবী কম্পিত হতো ! যেখানে যত কিছু ‘ভালো’ – সবকিছুই সে শক্তির বলে ‘হরণ’ করে নিজের রাজ্যে নিয়ে চলে যেতো । সবার কাছ থেকে ‘কর’ বা ‘খাজনা’ আদায় করতো ! এমনকি মুনি-ঋষি যাঁরা অরণ্যে বা তপোবনে থাকতেন – তাদেরকেও রেয়াৎ করতো না ! একবার নৈমিষারণ্যে মুনি-ঋষিরা ‘কর’ দিতে পারেনি বলে তাদের শরীরের রক্ত “কর” হিসেবে আদায় করেছিল । কত নারীকে যে ‘হরণ’ করেছিল – তার ইয়ত্তা নাই ! কিন্তু এত ‘অহংকারে’-রও পতন হয়ে গেল । গুরুমহারাজ বললেন – ” রাবণ জীবনে অনেক নারীর চুলের মুঠি ধরে টেনে নিয়ে গিয়েছিল – কিন্তু জীবনের মারাত্মক ভুলটি করল সাক্ষাৎ ভগবতী স্বরূপা মাতা ‘সীতা’-র চুলে হাত দিয়ে !! সেই মুহুর্তেই রাবণের অহংকারের পতন অনিবার্য হয়ে উঠেছিল । রাবণের মৃত্যুর পর তার মৃতদেহটি যখন যুদ্ধক্ষেত্রে নিথর অবস্থায় পড়েছিল, তখন হনুমান সেই দেহটি অনেকক্ষণ ধরে ভালোরকম উল্টেপাল্টে পরীক্ষা করছিল দেখে ভগবান রামচন্দ্র তাকে – অমন করে কি দেখছে – তা জিজ্ঞাসা করায়, হনুমান উত্তর দিয়েছিল – ” দেখছি – এত শক্তি, এত গর্ব, এত অহংকার – কি রকম শান্ত, স্থির-নিথর হয়ে মাটিতে শান্ত হয়ে পড়ে আছে !”
গুরুমহারাজ মহাভারতের দুর্যোধনের মদগর্বিতা বা অহংকারের কথাও বলেছিলেন ! অহংকারে মদমত্ত দুর্যোধন পিতা-মাতা, গুরু, গুরু স্থানীয়দের কোন কথা কোনদিন গ্রাহ্য-ই করে নি ! মহামতি ভীষ্ম – যাঁর উপদেশ নেবার জন্য যার জন্য স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ পান্ডবদের পাঠিয়েছিলেন, সেই ভীষ্মের কথাও সে কর্ণপাত করে নি । দ্রোণাচার্য, কৃপাচার্য, মহামতি বিদুর, ভক্তিমতি সতীশ্রেষ্ঠ নারী মাতা গান্ধারীর কথাও সদম্ভে বারবার অগ্রাহ্য করেছে ! কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ যাতে না হয় – তার জন্য শেষ চেষ্টা করতে আসা দূতরূপী ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে ভরা রাজসভায় সদম্ভে বলেছিল – ” বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী !” তারপর ভগবান তাকে নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেছিল এবং দুর্যোধনের রাজসভায় বসে থাকা সমস্ত বয়স্ক সভাসদরা (ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপাচার্য, বিদুর – প্রমুখরা) যখন দুর্যোধনের আচরণের নিন্দা করছিল – ঠিক তখনই অহংকারে উন্মত্ত দুর্যোধন তার প্রহরী-দ্বাররক্ষীদের আদেশ দিয়েছিল – ” এই প্রগলভ দূতকে (ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, যিনি সম্পর্কে পান্ডব বা কৌরবদের মামাতো ভাই ছিল)- বন্দী করো, বেঁধে ফেলো ওকে !” দুর্যোধনের অহংকারের এই ভয়ঙ্কর প্রকাশ দেখে সেদিন রাজসভায় বসে থাকা ভদ্রজন সত্যি সত্যিই আঁতকে উঠেছিল । আর একদিনও এমনি ভাবেই তাঁরা আঁতকে উঠেছিল , যেদিন দুর্যোধন নিজের ভাতৃবধূ দ্রৌপদীকে প্রকাশ্য রাজসভায় বিবস্ত্র করার আদেশ দিয়েছিল । কিন্তু কালের নিয়মে এইসব চরম অত্যাচারী, অনাচারী ব্যক্তিদের অহংকারেরও পতন হয়েছিল – সুতরাং এখনকার কোন অত্যাচার, অনাচার বা ব্যক্তি-অহংকারেরও পতন অনিবার্য্য – শুধু কাল প্রসন্ন হবার অপেক্ষা ! … [ক্রমশঃ]
গুরু মহারাজ বলেছিলেন রাবণের অহংকারের কথা ! তার অহংকার করার যথেষ্ট কারণ ছিল কারণ তৎকালীন সময়ে (আজ থেকে প্রায় দশ হাজার বছর আগে ভগবান রামচন্দ্রের লীলা-র কাল ছিল, – এটাই গুরু মহারাজ বলেছিলেন) উত্তর ভারত বা আর্যাবর্তের সভ্যতা এবং দাক্ষিণাত্যের দ্রাবিড় সভ্যতা অপেক্ষাও রাবণের রাজধানীর সভ্যতা , বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে অনেক বেশি উন্নত ছিল ! তৎকালীন ‘মায়া’ সভ্যতা (দক্ষিণ আমেরিকার মেস্কিকোর সভ্যতা)-র সাথে যুক্ত হয়ে রাবনের লঙ্কা , বিজ্ঞান ও প্রযুক্ততে এতটা উৎকর্ষতা লাভ করেছিল। মায়া সভ্যতার প্রযুক্তিবিদদের মধ্যে দু-তিনজনের নাম পাওয়া যায় – ময়দানব, মারীচ এবং কালনেমি ৷ এরা সবাই ‘মায়া’-বিদ্যা জানতো, তাছাড়া ময়দানব তার জামাতা (তৎকালীন যুগে এক শক্তিশালী দেশের সাথে অন্য আরেকটি শক্তিশালী দেশের মিত্রতা স্থাপনের অন্যতম একটা মাধ্যম ছিল বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন । এমনকি মুঘল আমলেও সম্রাট আকবর শক্তিশালী রাজপুত জাতিকে নিজের অধীনে আনার জন্য যোধাবাঈ-এর সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিল) – রাবনকে “পুষ্পক” রথ দান করেছিল, যা আকাশমার্গ অবলম্বন করে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাতায়াত করতে পারতো । তাছাড়া তৎকালে রাবন পুত্র ইন্দ্রজিৎ-কে ‘মেঘনাদ’ নামে অভিহিত করা হতো এবং বলা হতো সে মেঘের আড়াল থেকে যুদ্ধ করতে পারে ! এসব থেকে সহজেই বোঝা যাচ্ছে যে রাবণের “প্রযুক্তি” কতটা উন্নত ছিল – তারা যুদ্ধ বিমান বা ছোট যাত্রী বিমান ব্যবহারে স্বচ্ছন্দ ছিল, তাদের বর্তমানের NASA-র ন্যায় গবেষণাগার ছিল, অত্যাধুনিক যুদ্ধাস্ত্রের (অগ্নিবান, বরুণবান যেগুলি আজকের মিসাইল এবং নাগবান, গরুড়বান – এগুলি রাসায়নিক অস্ত্র বা জীবাণুঅস্ত্র, ব্রহ্মাস্ত্র- পাশুপত অস্ত্র হোল আজকের পরমাণু অস্ত্র – গুরু মহারাজ এইভাবেই এগুলোর ব্যাখ্যা করেছিলেন)– ব্যবহার ছিল ।
তুলনায় আর্যাবর্তের রাজাদের (দশরথ), নিষাদরাজের (মধ্য ভারতের গুহক), দাক্ষিণাত্যের দ্রাবিড় রাজাদের (কিষ্কিন্ধ্যার রাজা বালি) প্রযুক্তি অতটা উন্নত ছিল না । গুরুমহারাজ বলেছিলেন – রামচন্দ্রের সময়ে ভারতবর্ষে তিনটি সভ্যতা ছিল – আর্য সভ্যতা, নিষাদ সভ্যতা ও দ্রাবিড় সভ্যতা । আর তৎকালীন ভারতবর্ষের বাইরেও পৃথক পৃথক সভ্যতা ছিল ৷ সব সময়েই পৃথিবীতে দুটি সংস্কৃতির ধারা প্রবহমান। এই দুই সংস্কৃতির জনক-ই ছিল প্রাচীন ভারতের দুজন ঋষি – দেবগুরু বৃহস্পতি এবং দৈত্যগুরু বা রাক্ষসগুরু শুক্রাচার্য ! তৎকালীন যুগে আর্য এবং দ্রাবিড় রাজাদের অধিকাংশরাই দেবগুরু বৃহস্পতির নীতি follow কোরতো, কিন্তু ভারতের ভিতরেই এবং বাইরের বেশিরভাগ রাজ্যে (দেশে) শুক্রাচার্য্যের নীতিই বেশি চলত ৷ বৃহস্পতির নীতি ছিল – বাইরের উন্নতির দিকে মন না দিয়ে নিজের অন্তর্জগতের উন্নতি করো, তাহলেই জীবন সুখময় ও শান্তিময় হয়ে উঠবে । কিন্তু শুক্রাচার্যের নীতি ছিল ভোগ-ঐশ্বর্য্যের দিকে মন দাও, বাহ্যিক উন্নতি করো, স্বাস্থ্যবান হও – যতদিন বেঁচে থাকবে স্ফূর্তিতে বাঁচো, মৌজ-মস্তিতে বাঁচো ! ভারতীয় দর্শনগুলির মধ্যে চার্বাক-দর্শন কিছুটা শুক্রাচার্যের দ্বারা প্রভাবিত ।
যাইহোক, আমাদের আলোচনা হওয়া উচিত রাবণকে নিয়ে – তাই সেখানেই ফিরে যাই । রাবণের সাম্রাজ্যে ঐশ্বর্য এবং শক্তির প্রাচুর্য ছিল, রাবণের নিজের কিছু সাধন-শক্তিও ছিল, ইন্দ্রজিৎ-বীরবাহু-র মতো বীরপুত্র ছিল, শক্তিশালী নামকরা সেনানায়ক বা সমর বিশেষজ্ঞেরা ছিল, দেব-দেবীরা সবসময় তার রাজপুরীতে বাঁধা থাকতো__ তাই তার তো অহংকার হবার-ই কথা । গুরুমহারাজ বলেছিলেন – রাবনের অহংকারে তখন যেন পৃথিবী কম্পিত হতো ! যেখানে যত কিছু ‘ভালো’ – সবকিছুই সে শক্তির বলে ‘হরণ’ করে নিজের রাজ্যে নিয়ে চলে যেতো । সবার কাছ থেকে ‘কর’ বা ‘খাজনা’ আদায় করতো ! এমনকি মুনি-ঋষি যাঁরা অরণ্যে বা তপোবনে থাকতেন – তাদেরকেও রেয়াৎ করতো না ! একবার নৈমিষারণ্যে মুনি-ঋষিরা ‘কর’ দিতে পারেনি বলে তাদের শরীরের রক্ত “কর” হিসেবে আদায় করেছিল । কত নারীকে যে ‘হরণ’ করেছিল – তার ইয়ত্তা নাই ! কিন্তু এত ‘অহংকারে’-রও পতন হয়ে গেল । গুরুমহারাজ বললেন – ” রাবণ জীবনে অনেক নারীর চুলের মুঠি ধরে টেনে নিয়ে গিয়েছিল – কিন্তু জীবনের মারাত্মক ভুলটি করল সাক্ষাৎ ভগবতী স্বরূপা মাতা ‘সীতা’-র চুলে হাত দিয়ে !! সেই মুহুর্তেই রাবণের অহংকারের পতন অনিবার্য হয়ে উঠেছিল । রাবণের মৃত্যুর পর তার মৃতদেহটি যখন যুদ্ধক্ষেত্রে নিথর অবস্থায় পড়েছিল, তখন হনুমান সেই দেহটি অনেকক্ষণ ধরে ভালোরকম উল্টেপাল্টে পরীক্ষা করছিল দেখে ভগবান রামচন্দ্র তাকে – অমন করে কি দেখছে – তা জিজ্ঞাসা করায়, হনুমান উত্তর দিয়েছিল – ” দেখছি – এত শক্তি, এত গর্ব, এত অহংকার – কি রকম শান্ত, স্থির-নিথর হয়ে মাটিতে শান্ত হয়ে পড়ে আছে !”
গুরুমহারাজ মহাভারতের দুর্যোধনের মদগর্বিতা বা অহংকারের কথাও বলেছিলেন ! অহংকারে মদমত্ত দুর্যোধন পিতা-মাতা, গুরু, গুরু স্থানীয়দের কোন কথা কোনদিন গ্রাহ্য-ই করে নি ! মহামতি ভীষ্ম – যাঁর উপদেশ নেবার জন্য যার জন্য স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ পান্ডবদের পাঠিয়েছিলেন, সেই ভীষ্মের কথাও সে কর্ণপাত করে নি । দ্রোণাচার্য, কৃপাচার্য, মহামতি বিদুর, ভক্তিমতি সতীশ্রেষ্ঠ নারী মাতা গান্ধারীর কথাও সদম্ভে বারবার অগ্রাহ্য করেছে ! কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ যাতে না হয় – তার জন্য শেষ চেষ্টা করতে আসা দূতরূপী ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে ভরা রাজসভায় সদম্ভে বলেছিল – ” বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী !” তারপর ভগবান তাকে নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেছিল এবং দুর্যোধনের রাজসভায় বসে থাকা সমস্ত বয়স্ক সভাসদরা (ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপাচার্য, বিদুর – প্রমুখরা) যখন দুর্যোধনের আচরণের নিন্দা করছিল – ঠিক তখনই অহংকারে উন্মত্ত দুর্যোধন তার প্রহরী-দ্বাররক্ষীদের আদেশ দিয়েছিল – ” এই প্রগলভ দূতকে (ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, যিনি সম্পর্কে পান্ডব বা কৌরবদের মামাতো ভাই ছিল)- বন্দী করো, বেঁধে ফেলো ওকে !” দুর্যোধনের অহংকারের এই ভয়ঙ্কর প্রকাশ দেখে সেদিন রাজসভায় বসে থাকা ভদ্রজন সত্যি সত্যিই আঁতকে উঠেছিল । আর একদিনও এমনি ভাবেই তাঁরা আঁতকে উঠেছিল , যেদিন দুর্যোধন নিজের ভাতৃবধূ দ্রৌপদীকে প্রকাশ্য রাজসভায় বিবস্ত্র করার আদেশ দিয়েছিল । কিন্তু কালের নিয়মে এইসব চরম অত্যাচারী, অনাচারী ব্যক্তিদের অহংকারেরও পতন হয়েছিল – সুতরাং এখনকার কোন অত্যাচার, অনাচার বা ব্যক্তি-অহংকারেরও পতন অনিবার্য্য – শুধু কাল প্রসন্ন হবার অপেক্ষা ! … [ক্রমশঃ]