গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দ বনগ্রাম পরমানন্দ মিশনে অথবা অন্যত্র যে সমস্ত কথা বলতেন, তাঁর সেই বলা কথা –তাও ‘তখন আমরা যতটা শুনে মনে রাখতে পেরেছিলাম’ , সেগুলি এখানে আলোচনা করা হচ্ছে ! এখন আমরা মানব সমাজের বিবর্তনের ইতিহাস নিয়ে কথা বলছিলাম। কথা হচ্ছিল Necessity of Life -এর অন্যতম শর্ত Health, Education এবং Security নিয়ে।এই তিনটি বিষয়ের উপরে গুরুমহারাজ কত বিস্তৃত আলোচনা যে করতেন – তা সব বর্ণনা করা সম্ভব নয় – একসাথে সব কিছু মনেও পড়ে না, তাই যেগুলি এখন মনে পড়ছে – সেগুলি পর পর বলে যাচ্ছি ! যেমন – এখন স্বাস্থ্য বিষয়ক ওনার বলা কিছু কথা মনে পড়ছে – তাই সেগুলি এখন বলে নিই ! – গুরু মহারাজ বলেছিলেন – ” এই যে শরীরের রোগ-ব্যাধির ব্যাপারে একটা কথা চালু আছে ‘ Prevention is better than cure ‘ – এই কথাটির অর্থ যথেষ্ট ব্যাপক ও গভীর ! যে কোন একটি বা দুটি রোগের Prevention নয়, শরীরকে এমনভাবে তৈরি করা যায় যে, ওই শরীর_ যে কোনো রোগের আক্রমণকে প্রতিহত করতে পারে – এটাই যথার্থ Prevention ! মানব শরীরে দুরকম energy-র প্রকাশ দেখা যায়, Potential energy এবং Kinetic energy ! Potential energy টা মানুষ পায় পৈত্রিকসূত্রে – জাতকের পিতা-পিতৃপুরুষের মাধ্যমে অর্থাৎ বংশপরম্পরায় যে অন্তঃস্থশক্তি (অর্থাৎ মস্তিষ্ককোষের শক্তি, জেনেটিক শক্তি) – সে প্রাপ্ত হচ্ছে এটাই Potential energy ! ভারতবর্ষের সনাতন ধর্মীয়দের মধ্যে পাওয়া যায়, যে কোন ব্যক্তি – তা সে যে বংশেরই জাতক হোক না কেন, তাদের বংশ পরিচয়ে গোত্রে-র উল্লেখ রয়েছে ৷ সেই গোত্র পিতা ছিলেন কোন না কোন ঋষি।।বহু পূর্বে অর্থাৎ আদিম মানবসমাজে আমরা দেখেছি, কোন দলে বা গোষ্ঠীতে সমস্ত নারীদের দ্বারা সন্তান উৎপাদন করার দায়িত্ব ছিল দলপতির (যেহেতু কোন দলে বা গোষ্ঠীতে – সেই দলের সবচাইতে শক্তিমান এবং বুদ্ধিমান ব্যক্তিটিই দলপতি হতো ৷ প্রকৃতিতে অন্যান্য বন্যপ্রাণীর মধ্যেও একই নিয়ম কার্যকরী রয়েছে । নিরোগ, শক্তিশালী, বুদ্ধিমান, সংযমীদের দ্বারা গর্ভ উৎপাদনের প্রধান কারণ হলো এই যে, এর ফলে যে সন্তান ভূমিষ্ঠ হবে সেটিও শক্তিশালী, বুদ্ধিমান ইত্যাদি হবে, অর্থাৎ এককথায় সমাজের আর পাঁচজনের থেকে উন্নত হবে ৷ এখনো হিমালয় সংলগ্ন অনেক জনজাতির মধ্যে নিয়ম রয়েছে – সেইসব গ্রামে কোন স্বাস্থ্যবান, সংযমী, নিষ্ঠাবান সাধু-সন্ত গিয়ে পৌঁছালে গৃহস্থরা তাদের বাড়ির কমবয়সী বৌমাকে ওই সাধুর সেবা-শুশ্রূষা করার জন্য গভীর রাত্রে তার ঘরে পাঠিয়ে দেয় ! তাদের এটাই ইচ্ছা যে সাধু যদি তার এতদিনের রক্ষা করা ব্রহ্মচর্য ভেঙে ওই মেয়েটির সাথে মিলিত হয় এবং যদি মেয়েটির গর্ভে সন্তান আসে – তাহলে ওই বংশটির ‘পরম্পরা’ উন্নত হবে ।), পরবর্তীতে যখন থেকে সমাজব্যবস্থায় শক্তিমান অপেক্ষা বুদ্ধিমানদের প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছিল (রাজতন্ত্র এবং পুরোহিততন্ত্রের সংঘাতের ব্যাপারটা বহুকালের ! শক্তিমান ও বুদ্ধিমান -এর লড়াই এবং তাদের মধ্যে গড়ে ওঠা আঁতাত, আবার সংঘাত – ফের একটা আপোষ, এইসব নিয়েই সমাজের বিবর্তন আর তারই ফল আজকের মানবসমাজ!) – তখন থেকেই গোত্রপিতা ব্যাপারটির উদ্ভব হয়েছিল । সাধারণত ভারতীয় সনাতন ধর্মীয়দের সকল ব্যক্তিরই বংশের একজন করে গোত্রপিতা রয়েছে । যেমন শান্ডিল্য, কাশ্যপ, ভরদ্বাজ, মধুকুল্য প্রমুখ অনেক গোত্রপিতার নাম আমাদের জানা । এঁরা সকলেই ছিলেন ঋষি !
‘ঋষি’ অর্থে – এইসব মানুষেরা ধ্যানের গভীরতায় ডুবে গিয়ে তাঁরা তাদের কুলকুণ্ডলিনীকে জাগ্রত করে একটি একটি চক্র (মূলাধার, স্বাধিষ্ঠান,মনিপুর, অনাহত, বিশুদ্ধ, আজ্ঞা, সহস্রার) অতিক্রম ও প্রস্ফুটিত করতে করতে স্থিত হয়েছিলেন সহস্রারে ! সম্পূর্ণ মস্তিস্ক কোষের বিকাশ ঘটিয়ে খুঁজে পেয়েছিলেন জগতের রহস্য, জীবনের রহস্য ! বোধ করেছিলেন ঈশ্বরতত্ত্ব – এই ভাবে তাঁরা বোধি হয়েছেন, জ্ঞানী হয়েছেন, নিজেই হয়ে উঠেছেন ঈশ্বর-স্বরূপ !
গুরু মহারাজ বলেছিলেন – এই যে ঋষিকুল এঁদের মধ্যে Potential energy ছিল 100% ! জীবের কল্যাণে, সৃষ্টিরক্ষার প্রয়োজনে এঁরা ইশ্বরের ইচ্ছাতেই ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর গোষ্ঠীপিতা বা গোত্রপিতা হয়েছিলেন। কারণটা হয়তো_ কোন সময় শক্তিমান দলপতিসহ ওই দলের পুরুষেরা কোন মহামারিতে বা জেনেটিকভাবে এমন রোগাক্রান্ত হয়ে পড়েছিল যে, সেই জনগোষ্ঠীটাই হয়তো লুপ্ত হতে বসেছিল ! তখন ওই মানবগোষ্ঠীকে টিকিয়ে রাখার প্রয়োজনে কোনো না কোনো 100% Potential energy বিশিষ্ট ঋষিকেই প্রজননের দায়িত্ব নিতে হয়েছিল – যাতে ওই গোষ্ঠীটি আবার প্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রাম করে টিকে যায় ৷ মহাভারতেও আমরা এই ধরনের দু-একটি ঘটনার উল্লেখ পাই ! কৌরববংশ যখন লুপ্ত হতে বসেছিল, কারণ ওই বংশের চিত্রবীর্য, বিচিত্রবীর্য-রা ছিল সন্তান উৎপাদনে অক্ষম । গুরুমহারাজ বলেছিলেন, “মহাভারতের রচয়িতার প্রতিভার অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রকাশ ছিল উল্লিখিত চরিত্রগুলির ‘নাম’ নির্বাচন ! ভীষণ প্রতিজ্ঞা কারী ‘ভীষ্ম’, যেকোনো বিষয়ে লক্ষ্যভেদকারী বা লক্ষ্য অর্জনকারী ‘অর্জুন’, ধীর-স্থির-শান্ত, রাজা হবার উপযুক্ত ‘যুধিষ্ঠির’, প্রবল পরাক্রমী, অমিত শক্তিশালী ‘ভীম’ – ইত্যাদি । এক্ষেত্রেও চিত্রবীর্য, বিচিত্রবীর্য নামগুলি থেকেই বোঝা যায় যে তাদের শুক্রাণু উৎপাদনে নানাবিধ সমস্যা ছিল ! সেই সমস্যা দূর করার জন্যই মহর্ষি ব্যাসদেবকে আমন্ত্রণ করে রাজপ্রাসাদে নিয়ে আসা হয়েছিল – তার ভ্রাতৃবধূদের গর্ভে সন্তান উৎপাদনের জন্য ! ধৃতরাষ্ট্র ও পান্ডু এইভাবেই জাত ব্যাসদেবের সন্তান। সেখানেও গল্প রয়েছে – যেহেতু ব্যাসদেব ছিলেন খুবই কৃষ্ণবর্ণের লোক এবং চুল-দাড়ি সমন্বিত – তাই শয়নকক্ষে তাঁকে দেখে পান্ডুর জননী (অম্বিকা এবং অম্বালিকার মধ্যে একজন, যাদেরকে ভীষ্ম স্বয়ংবর সভা থেকে হরণ করে নিয়ে এসেছিলেন) ভয়ে ফ্যাকাসে বা পান্ডুবর্ণ হয়ে গিয়েছিল এবং ধৃতরাষ্ট্রের জননী ভয়ে চোখ বুঝে ফেলেছিল ৷ তাই প্রথমজন পান্ডু অর্থাৎ শরীরে চামড়ায় মেলানিনের অভাবে যে সাদা মানুষদের আজও সমাজে দেখা যায় – সেই রকম হয়েছিল এবং ধৃতরাষ্ট্র জন্মান্ধ হয়েই জন্মেছিল । গুরু মহারাজ এটিকেও ‘আধুনিক বিজ্ঞানের গবেষণার বিষয়’ – হিসাবে চিহ্নিত করেছিলেন ৷ উনি বলেছিলেন – বেশিরভাগ স্বামী-স্ত্রীরা তো জানেই না কখন তাদের অজ্ঞাতসারে ‘কনসিভ’ হয়ে গেছে ! ফলে যে মুহূর্তে এ কাণ্ডটি ঘটেছে (শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর মিলন) – সেইমুহূর্তে স্বামী এবং স্ত্রীর শরীর-মন এবং তাদের আচরণের সম্পূর্ণ প্রভাব পড়ে ওই জাতকের মধ্যে ! কারণ সেই মুহূর্তে কিছু সূক্ষাতিসূক্ষ স্পন্দনের ক্রিয়ার ফলেই জাতকের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম দেহটির বিন্যাস নির্দিষ্ট হয়ে যায় । সুতরাং সন্তান জন্মানোর পর তাকে যে স্নেহ-ভালোবাসা দেখানো হয় – এটাকে গুরুমহারাজ বলতেন “আদিখ্যেতা”! যদি সত্যি সত্যিই ভালবাসতে হয় তাহলে আরও অনেক আগে থাকতে প্রস্তুতি নিতে হবে – সেই আলোচনা পরের দিন ৷৷ … [ক্রমশঃ]
‘ঋষি’ অর্থে – এইসব মানুষেরা ধ্যানের গভীরতায় ডুবে গিয়ে তাঁরা তাদের কুলকুণ্ডলিনীকে জাগ্রত করে একটি একটি চক্র (মূলাধার, স্বাধিষ্ঠান,মনিপুর, অনাহত, বিশুদ্ধ, আজ্ঞা, সহস্রার) অতিক্রম ও প্রস্ফুটিত করতে করতে স্থিত হয়েছিলেন সহস্রারে ! সম্পূর্ণ মস্তিস্ক কোষের বিকাশ ঘটিয়ে খুঁজে পেয়েছিলেন জগতের রহস্য, জীবনের রহস্য ! বোধ করেছিলেন ঈশ্বরতত্ত্ব – এই ভাবে তাঁরা বোধি হয়েছেন, জ্ঞানী হয়েছেন, নিজেই হয়ে উঠেছেন ঈশ্বর-স্বরূপ !
গুরু মহারাজ বলেছিলেন – এই যে ঋষিকুল এঁদের মধ্যে Potential energy ছিল 100% ! জীবের কল্যাণে, সৃষ্টিরক্ষার প্রয়োজনে এঁরা ইশ্বরের ইচ্ছাতেই ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর গোষ্ঠীপিতা বা গোত্রপিতা হয়েছিলেন। কারণটা হয়তো_ কোন সময় শক্তিমান দলপতিসহ ওই দলের পুরুষেরা কোন মহামারিতে বা জেনেটিকভাবে এমন রোগাক্রান্ত হয়ে পড়েছিল যে, সেই জনগোষ্ঠীটাই হয়তো লুপ্ত হতে বসেছিল ! তখন ওই মানবগোষ্ঠীকে টিকিয়ে রাখার প্রয়োজনে কোনো না কোনো 100% Potential energy বিশিষ্ট ঋষিকেই প্রজননের দায়িত্ব নিতে হয়েছিল – যাতে ওই গোষ্ঠীটি আবার প্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রাম করে টিকে যায় ৷ মহাভারতেও আমরা এই ধরনের দু-একটি ঘটনার উল্লেখ পাই ! কৌরববংশ যখন লুপ্ত হতে বসেছিল, কারণ ওই বংশের চিত্রবীর্য, বিচিত্রবীর্য-রা ছিল সন্তান উৎপাদনে অক্ষম । গুরুমহারাজ বলেছিলেন, “মহাভারতের রচয়িতার প্রতিভার অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রকাশ ছিল উল্লিখিত চরিত্রগুলির ‘নাম’ নির্বাচন ! ভীষণ প্রতিজ্ঞা কারী ‘ভীষ্ম’, যেকোনো বিষয়ে লক্ষ্যভেদকারী বা লক্ষ্য অর্জনকারী ‘অর্জুন’, ধীর-স্থির-শান্ত, রাজা হবার উপযুক্ত ‘যুধিষ্ঠির’, প্রবল পরাক্রমী, অমিত শক্তিশালী ‘ভীম’ – ইত্যাদি । এক্ষেত্রেও চিত্রবীর্য, বিচিত্রবীর্য নামগুলি থেকেই বোঝা যায় যে তাদের শুক্রাণু উৎপাদনে নানাবিধ সমস্যা ছিল ! সেই সমস্যা দূর করার জন্যই মহর্ষি ব্যাসদেবকে আমন্ত্রণ করে রাজপ্রাসাদে নিয়ে আসা হয়েছিল – তার ভ্রাতৃবধূদের গর্ভে সন্তান উৎপাদনের জন্য ! ধৃতরাষ্ট্র ও পান্ডু এইভাবেই জাত ব্যাসদেবের সন্তান। সেখানেও গল্প রয়েছে – যেহেতু ব্যাসদেব ছিলেন খুবই কৃষ্ণবর্ণের লোক এবং চুল-দাড়ি সমন্বিত – তাই শয়নকক্ষে তাঁকে দেখে পান্ডুর জননী (অম্বিকা এবং অম্বালিকার মধ্যে একজন, যাদেরকে ভীষ্ম স্বয়ংবর সভা থেকে হরণ করে নিয়ে এসেছিলেন) ভয়ে ফ্যাকাসে বা পান্ডুবর্ণ হয়ে গিয়েছিল এবং ধৃতরাষ্ট্রের জননী ভয়ে চোখ বুঝে ফেলেছিল ৷ তাই প্রথমজন পান্ডু অর্থাৎ শরীরে চামড়ায় মেলানিনের অভাবে যে সাদা মানুষদের আজও সমাজে দেখা যায় – সেই রকম হয়েছিল এবং ধৃতরাষ্ট্র জন্মান্ধ হয়েই জন্মেছিল । গুরু মহারাজ এটিকেও ‘আধুনিক বিজ্ঞানের গবেষণার বিষয়’ – হিসাবে চিহ্নিত করেছিলেন ৷ উনি বলেছিলেন – বেশিরভাগ স্বামী-স্ত্রীরা তো জানেই না কখন তাদের অজ্ঞাতসারে ‘কনসিভ’ হয়ে গেছে ! ফলে যে মুহূর্তে এ কাণ্ডটি ঘটেছে (শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর মিলন) – সেইমুহূর্তে স্বামী এবং স্ত্রীর শরীর-মন এবং তাদের আচরণের সম্পূর্ণ প্রভাব পড়ে ওই জাতকের মধ্যে ! কারণ সেই মুহূর্তে কিছু সূক্ষাতিসূক্ষ স্পন্দনের ক্রিয়ার ফলেই জাতকের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম দেহটির বিন্যাস নির্দিষ্ট হয়ে যায় । সুতরাং সন্তান জন্মানোর পর তাকে যে স্নেহ-ভালোবাসা দেখানো হয় – এটাকে গুরুমহারাজ বলতেন “আদিখ্যেতা”! যদি সত্যি সত্যিই ভালবাসতে হয় তাহলে আরও অনেক আগে থাকতে প্রস্তুতি নিতে হবে – সেই আলোচনা পরের দিন ৷৷ … [ক্রমশঃ]