গুরু মহারাজ স্বামী পরমানন্দের বিভিন্ন সিটিং-এ করা বৈদিক চতুরাশ্রম প্রথা সম্বন্ধীয় আলোচনা নিয়ে কথা হচ্ছিল। শৈশবকাল পিতা-মাতা সহ পরিবারের সকলের (দাদু-ঠাকুমা, কাকা-জ্যাঠা, কাকিমা-জ্যেঠিমা, নিজস্ব এবং ‘তুতো’ ভাই-বোনেরা) সাথে কাটিয়ে কৈশোর থেকে যৌবনের প্রথম কাল পর্যন্ত গুরুগৃহে থেকে বিদ্যাশিক্ষা, শরীর শিক্ষা, অস্ত্রশিক্ষা সহ জীবনমুখী সমস্ত রকম শিক্ষা-ই দেওয়া হতো _ব্রহ্মচর্য আশ্রমে! ২১–২৪ বছর বয়স পর্যন্ত গুরুগৃহে কাটানোর পর (ব্রহ্মচর্য্য আশ্রম) ঐ ছাত্র বা ছাত্রী যখন পুনরায় সমাজে (গৃহস্থাশ্রমে) ফিরে যেতো, তখন সে যেন একটি প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ মানুষ ! যে ছাত্র বা ছাত্রীর যে বিষয়ে ঝোঁক – তাকে সেই বিষয়েই অধিক পাঠ এবং practical Training দেওয়া হতো গুরুগৃহে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়_ বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা করা যাদের স্বভাবে ছিল, তাদেরকে এমনভাবে শিক্ষা দেওয়া হতো যাতে করে তারা সমাজে ফিরে গিয়ে পরামর্শদাতা,মন্ত্রণাদাতা (বিভিন্ন দপ্তরের মন্ত্রী বা মন্ত্রিপরিষদের সদস্য), গবেষণাবিদ্, চিন্তাবিদ্, লেখক, শিল্পী, আচার্য্য ইত্যাদি নানা ধরনের পেশায় নিজেদেরকে নিয়োজিত রাখতে পারে ।
অস্ত্রশিক্ষা, শরীর শিক্ষার ব্যাপারে যারা খুব বেশি interested – তাদেরকে সেনাবাহিনীর সদস্য হিসাবে তৈরি করা হতো ! এই ব্যাপারে যোগ্যতার তারতম্য অনুসারে ওই গুরু-আশ্রম থেকেই তাদের gradation নির্ণয় করে দেওয়া হতো – অর্থাৎ ঐ ছাত্রদের মধ্যে যার Leadership দেওয়ার ক্ষমতা বেশি রয়েছে – তাকে ছোট ছোট দলের সেনানায়কের পদ দেওয়া হতো ! এইভাবে নগরপাল, সেনাপতি, প্রধান সেনাপতি এবং সৈন্য বাহিনী র সাধারণ সদস্য ইত্যাদি সকলকে শিক্ষাঙ্গন থেকেই সরাসরি নির্বাচন করে নিয়ে যাওয়া হোতো ! শুধু নিয়োগের পরে কিছুটা Practical Training দিয়ে দিলেই তারা একেবারে Fit !
গণিতশাস্ত্রে পারদর্শীদেরকে নির্বাচন করা হতো খাজাঞ্চি রূপে বা হিসাবরক্ষক রূপে ৷ এইভাবে ছাত্রাবস্থায় ছেলেমেয়েরা যে যে-বিষয়ে পারদর্শী, পরবর্তীতে তারা সেইসব সংশ্লিষ্ট কর্মক্ষেত্রে কাজে রত হোত । ফলে তাদের প্রত্যেকের কর্মের “Best Performance-টা পেতো সমাজ ৷৷
যাইহোক, কথা হচ্ছিল ব্রহ্মচর্য্য আশ্রম নিয়ে,_ সেখানকার যারা Teacher হিসাবে থাকতেন তাঁরা ছিলেন হয় বাণপ্রস্থী অথবা সন্ন্যাসী, তবে বেশিরভাগই বানপ্রস্থী ! চতুরাশ্রম প্রথায় একটা নিয়ম ছিল “পঞ্চাশোর্ধে বনং ব্রজেৎ” ৷ ব্রহ্মচর্য্য আশ্রমে ছাত্ররা জীবনের ২১–২৪ বছর বয়স পর্যন্ত থাকার পর – সমস্ত ধরনের শিক্ষা এবং বিশেষত ‘ব্রহ্মচর্য্য’ শিক্ষা গ্রহণ এবং জীবনে পালন করার পর সংসার জীবনে এবং কর্ম জীবনে এসে প্রবেশ করতো ! ফলে তাদের প্রত্যেকের-ই দাম্পত্য জীবনে এবং কর্ম জীবনে সব সময়েই একটা ‘বাঁধ’ অর্থাৎ সংযমের বাঁধ, শৃঙ্খলার বাঁধ বজায় থাকতো ৷ গুরুগৃহে পাঠকালে তারা যেহেতু ঋষিদের শিক্ষায় শিক্ষিত হতো (কারণ তখনও ইউরোপ বা অন্যান্য দেশের পণ্ডিতদের পুস্তক ভারতে প্রবেশ করার প্রয়োজন বা সুযোগ কোনটাই ছিল না ! বরং ভারতবর্ষ থেকে আচার্য্য-রা বিভিন্ন দেশে গিয়ে জ্ঞান-বিজ্ঞান অর্থাৎ বিভিন্ন বিষয়ের বিদ্যা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন ৷ সেইসব দেশের বহু ছাত্র-ছাত্রীরাও এ দেশের বিভিন্ন ইউনিভার্সিটিতে পড়তে আসতো এবং তারাও নিজ নিজ দেশে ফিরে গিয়ে – ভারতবর্ষের বিদ্যাসমূহ-কে তাদের সমাজে্ নিয়ে গিয়ে ছড়িয়ে দিতো ৷ গুরুমহারাজ বলেছিলেন – এদের মধ্যে যে কয়জন কিছু ইতিহাস লিখে রেখেছিল – তাদের কথাই পণ্ডিতরা জানতে পেরেছে, কিন্তু আরো কত শত ছাত্ররা এখানে পড়াশোনা করে এখানকার বিভিন্ন বিষয়ের বিদ্যাকে মগজে ভরে তাদের নিজেদের দেশে নিয়ে গিয়েছিল – তাদের খবর আর কজন রাখে !) – তাই তাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নিষ্ঠা, সংযম, শৃঙ্খলা, সর্বদা বিদ্যমান থাকতো ৷
এরফলে ওই যুবকদের কাছ থেকে সমাজ পেতো একনিষ্ঠ কর্মীদেরকে, পরিবার পেতো একজন আদর্শ সদস্যকে অর্থাৎ মাতা-পিতা পেতো একজন আদর্শ সন্তানকে, স্ত্রী পেতো একজন আদর্শ স্বামীকে, সন্তান-সন্ততিরা পেতো একজন আদর্শ পিতা বা মাতাকে ৷
ব্রহ্মচর্য পালনকারী এই সব ছেলে বা মেয়েদের অধিকাংশরাই _গার্হস্থ আশ্রমে কিছুদিন কাটিয়ে ,পঞ্চাশ বছর বয়স হয়ে গেলে “পঞ্চাশোর্ধে বনং ব্রজেৎ” করতো, এবং বানপ্রস্থ অবলম্বন করে , পূর্বে উল্লেখিত কোন না কোন ঋষি প্রতিষ্ঠিত আশ্রমে গিয়ে নিজ নিজ পেশার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন শিক্ষক হিসাবে যোগদান করতো ! এরাই ছিল ideal শিক্ষক, কারণ এরা ছোটবেলায় যে যে বিষয়ে শিক্ষালাভ করেছিল – কর্মজীবনে বা সংসারজীবনে সেই পেশাতেই নিযুক্ত ছিল এবং বানপ্রস্থ এসে সেই একই বিষয়ে শিক্ষাদান করতো। এর ফলে এদের Theoritical এবং Practical দু-ধরনের জ্ঞান একত্র বিদ্যমান থাকায় – এরা হয়ে উঠতো সত্যিকারের আদর্শ শিক্ষক ৷৷ গুরু মহারাজ বনগ্রাম পরমানন্দ মিশনের অনাথ ছাত্র ভবনে দায়িত্বপ্রাপ্ত এক সন্ন্যাসীকে(তখন ব্রহ্মচারী) একবার বলেছিলেন_”তোরা এক একজন শিক্ষক, এক একটা শ্রেনীর ছাত্রদেরকে সারাদিন ধরে একটাই subject-এর কোন একটা চ্যাপ্টার পড়াবি। যেদিন যে বিষয় পড়াবি _সেখান থেকে ছাত্রদের মধ্যে থেকেই জিজ্ঞাসা-উত্তর তুলে এনে_প্রয়োজনে উত্তর গুলো লিখিয়ে নিবি। তাহলে ছাত্রদের, আলাদা করে সময় দিয়ে পড়া মুখস্থ করার প্রয়োজন হবে না এবং পড়াশোনা কে ভার-বোঝা বলেও মনে হবে না।।” গুরু মহারাজের এই কথায় আমরা বৈদিক পরম্পরার-ই অনুরণন দেখতে পাই।।… [ক্রমশঃ]