গুরু মহারাজ স্বামী পরমানন্দ ব্রহ্মচর্যাশ্রম সহ চতুরাশ্রম সম্বন্ধে অনেক কথাই বলেছিলেন। এখন অন্য একটা প্রসঙ্গ লিখতে গিয়ে সেসব কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। কিন্তু সব কথা এখানে লেখা ঠিক হবে না – তাই কিছু কিছু তুলে ধরা হচ্ছে ! ব্রহ্মচর্য আশ্রমে ব্রহ্মচারী বালকদের শিক্ষাদানের যে পদ্ধতির কথা গুরুমহারাজ আমাদের বলেছিলেন, তারমধ্যে একটি হোল – প্রথমেই ছাত্রদের শরীর ও মনের লক্ষন অনুযায়ী তাদের কর্মের বিভাগ করে দেওয়া হতো। যেমন ধরুন – কারো জল আনা, কারো ফুল তোলা, তোলা কারো সমিধ জোগাড় করা, কারো যজ্ঞবেদী সাজানো ইত্যাদি ইত্যাদি।
ছাত্ররা তাদের জন্য নির্দিষ্ট কাজটি তো সচেতনতার সঙ্গে করত‌ই এবং সেই সঙ্গে তারা তাদের দৈনিক বিদ্যাশিক্ষার পাঠ‌ও সুন্দরভাবে চালিয়ে যেত। অতি প্রত্যুষে স্নানান্তে এবং বৈদিক শান্তিপাঠের পর ছাত্ররা যখন গুরুদেবের সামনে এসে সমবেত হোতো (এক একটা age-group বালকদের জন্য পৃথক পৃথক শিক্ষাগুরুর ব্যবস্থা ছিল।) তখন গুরুদেব প্রতিদিন তাদেরকে বেদের এক একটি সূত্র (ধরা যাক বেদের যে কোন একটি ব্রহ্মসূত্র) শিক্ষা দিতো এবং সকলে তখনই সেটি মুখস্ত করে নিতো। এরপর গুরুদেব ছাত্রদেরকে উদ্দেশ্য করে বলতেন – ” বাবারা ! আজকে যে সূত্রটি শিখলে , তার কি মানে হতে পারে, এর ব্যাখ্যা কি হতে পারে – তা তোমরা নিজেরা নিজেরা চিন্তাভাবনা করে বের করোগে যাও! দিনান্তে আশ্রমের প্রার্থনার পর, যখন আবার তোমরা আমার কাছে আসবে – তখন এটির পাঠ নেওয়া হবে।”
সমস্ত ছাত্ররা গুরুর কাছে পাঠ গ্রহণ করে আপন আপন কাজে লিপ্ত হয়ে গেল, কিন্তু অন্তরে চলতে থাকলো চিন্তা! যে পাঠ গুরুর কাছে সে পেয়েছে – তার ব্যাখ্যার চিন্তন সারাদিন ধরে চলতেই থাকলো। দিনের শেষে সন্ধার প্রার্থনার পর সবাই যখন আবার গুরুর কাছে ফিরে এলো, গুরু প্রত্যেককে পৃথক পৃথক ভাবে জিজ্ঞাসা করতেন – “তোমরা ঐ পাঠের কি ব্যাখ্যা করেছো তা আমাকে বলো “!
প্রত্যেক ছাত্র তাদের সারাদিনের মনন এবং নিদিধ্যাসনের ফল গুরুদেবকে জানাতো ।৷ গুরুদেব সবার কথা শুনতেন এবং শেষে সেই গুলির সাথে আরও কিছু ওই সংক্রান্ত যথার্থ ব্যাখ্যা যোগ করে দিতেন। এভাবে বৈদিক প্রতিটি সুক্তের ব্যাখ্যার একটা সিন্থেসিস হয়ে যেতো – এবং এতে সব ছাত্রের‌ই কিছু না কিছু contribution থাকতো। ঋষিদের প্রবর্তিত শিক্ষাদানের এই যে পদ্ধতি অর্থাৎ শ্রবন, মনন এবং নিদিধ্যাসন – এইটাই ঠিক ঠিক ব্রেন ডেভেলপমেন্ট এর বিজ্ঞানসম্মত উপায় !!
গুরু-আশ্রমের যাবতীয় কাজ ওই ব্রহ্মচারী ছেলেরাই করতো, তাছাড়া নিয়মিত ধ্যান-জপ, আসন-প্রাণায়াম করার ফলে তাদের ছোটবেলা থেকেই শরীর-স্বাস্থ্য খুবই মজবুত হোত। শরীরের সাথে সাথে তাদের মন এবং প্রাণ নির্মল হয়ে উঠতো, সকল ছাত্রদের মধ্যে একটা সৌভ্রাতৃত্ববোধ জাগ্রত হোত,সমাজজীবনেও এর প্রভাব পড়তো_সব ছাত্ররাই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বার্থচেতনার ঊর্ধ্বে উঠে সমষ্টিচেতনায় উন্নীত হোত। এইভাবে গুরু আশ্রম থেকে একটি ছাত্র সুস্বাস্থ্য এবং সুমেধার অধিকারী হয়ে সমাজে ফিরে আসতো।
গুরুকুলের শিক্ষকেরা যেহেতু সকলেই বানপ্রস্থী, তাই তারা কোনো পারিশ্রমিক গ্রহণ করত না! ছাত্রদের অভিভাবকেরা এবং রাজন্যবর্গের দায়িত্বে ঐ আশ্রমগুলি চলতো। ফলে আবাসিক ছাত্র ও শিক্ষকদের ভরণপোষণের ভার ছিল বেশিরভাগটা রাজার ওপরেই (যেহেতু তখন সমাজে রাজতন্ত্র ছিল), সাধারণ গৃহস্থীরাও পালা-পার্বনে ‘সিধা'(একটা বড় ধামায় করে চাল, ডাল, শাকসবজি ইত্যাদি) পাঠাতো_এতেই ঐ সহজ সরল সাধুসন্ত ত্যাগী মানুষজনেদের ভালোভাবেই চলে যেতো।।
বানপ্রস্থী – যারা ওখানে শিক্ষকতা করতেন, তাদের অনেকেই ষাটোর্ধ্ব বয়স হয়ে গেলে সন্ন্যাস গ্রহণ করতেন এবং আশ্রম ছেড়ে দূরে কোন নির্জন স্থানে আত্মচিন্তায় নিমগ্ন হয়ে যেতেন । এদের মধ্যে যারা আত্মবোধ বা সত্যের বোধ করতে সমর্থ হোতেন, তারা আবার সমাজে ফিরে এসে তাদের ‘বোধে’-র কথা পরবর্তী প্রজন্মকে বলে যেতেন ! এই ভাবেই “উপলব্ধ সত্য” পরম্পরায় বাহিত হয়ে তৈরি হয়েছিল শ্রুতি বা বেদ।৷
আর এই বৈদিক একটি পরম্পরার (চতুরাশ্রম) কথাই এতক্ষণ ধরে বলা হোল। এইবার আমরা ফিরে যাব সেই আলোচনায় – যেখানে বলা হয়েছিল , গুরু মহারাজ একবার বলেছিলেন – যে সমস্ত সন্তানেরা বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে দেখে না, তাদের দুঃখে দুঃখী হয় না, বরং তাদেরকে অবহেলা করে, হেনস্থা করে – তারা ‘জারজ সন্তান’!!
গুরুজী এই কথা বলার সাথে সাথে – ঐ দিনের সিটিং-এ বসে থাকা অনেক ভদ্রলোকই একেবারে ‘হৈ-হৈ’ করে উঠেছিল – “এটা কি বলছেন, গুরু মহারাজ !! জারজ সন্তান ?? – মানে bustard ??”
গুরু মহারাজ দৃঢ় ব্যক্তিত্বপূর্ণ কন্ঠে বললেন – “হ্যাঁ, ঠিকই বলেছি – এমন সন্তানেরা জারজ, bustard !!!” এরপর উনি ওনার কথার সপক্ষে যে যুক্তি উপস্থাপন করেছিলেন – সেটা বলছি। গুরু মহারাজ বললেন – সাধারন দম্পতিরা তো জানতেই পারে না, কবে-কখন-কোন দিনের মিলনে তাদের সন্তান গর্ভে এসেছে !! এইজন্য আগেকার দিনে তিথি-নক্ষত্র দেখে পুত্রেষ্ঠি যজ্ঞ করা হোত – শুধুমাত্র পুত্র কামনাতেই দম্পতিকে ধ্যান-জপ, পুজো-আচ্চা, যাগ-যজ্ঞ করতে হোত (গুরু মহারাজ নিজে উদ্যোগ নিয়ে বনগ্রামের মুখার্জী বাড়ির মেয়ে অরুনার পুত্রেষ্ঠি যজ্ঞ করিয়েছিলেন – এই পরম্পরাটি বজায় রাখার জন্য)। এই সবের অন্তে কুলগুরুর নির্দেশ ও শুভ দিন বা ক্ষন মেনে_ হোত মিলন। ফলে সেখানে স্বামী-স্ত্রী উভয়ের মনে একটা পবিত্র ভাব বজায় থাকতো এবং পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা, ভালবাসা, বিশ্বাস থাকতো – উভয়ের এক‌ই মনোষ্কামনা, এক লক্ষ্য, ইশ্বরের নিকট একটাই প্রার্থনা – “একটি সুসন্তান লাভ হোক।” এই ধরনের সন্তানেরা ধর্মপরায়ণ হবেই হবে – কখনোই সে তার পিতা-মাতার প্রতি বা পরিবারের অন্য সদস্যদের প্রতি অকর্তব্যপরায়ণ হবে না৷৷
অপরপক্ষে, নিজেদের স্বকীয়তা হারিয়ে শুধুমাত্র কামলিপ্সা চরিতার্থ করতে গিয়ে হঠাৎ করে ‘কনসিভ’ – হয়ে যাওয়ার ফলে ভূমিষ্ঠ সন্তান তো – ‘জারজ’-ই হয়ে গেল ৷৷ কারণ সেই ব্যক্তির বংশমর্যাদা, শিক্ষা-দীক্ষা, তার নিজস্বতা অর্থাৎ যেগুলি দিয়ে সে সমাজে তার পরিচয় দেয় – সেই মুহূর্তে (মিলনকালে) এগুলোর কোনটাই তার পরিচয়ে ছিল না – ছিল অন্যকিছু ! সেই মুহুর্তের ব্যক্তিটি – যেন অন্য কেউ !! তাই “জারজ”!! এখানে সন্তানের কোন দোষ নাই – পিতামাতার ত্রুটি, তাই কষ্টটাও তারাই পায়।। … [ক্রমশঃ]