গুরু মহারাজ স্বামী পরমানন্দের বিভিন্ন সিটিংয়ে করা আলোচনা সমূহ নিয়ে এখানে আলোচনা হচ্ছিল । আমরা বেশ কিছুদিন আগে একটা আলোচনা শুরু করেছিলাম আদিম মানব সমাজ থেকে বিবর্তনে আজকের সভ্য (!) সমাজ কিভাবে ধীরে ধীরে রূপ পেয়েছিল – সেই সব কথা নিয়ে ! সেখান থেকে আমরা আলোচনাক্রমে এসেছিলাম মানুষের জীবনে প্রধান যে চাহিদাগুলি অর্থাৎ Need of Life বা খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান এবং Necessity of Life অর্থাৎ স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সুরক্ষা – এইগুলির আলোচনায় ৷ এসব আলোচনা করতে গিয়ে শিক্ষা প্রসঙ্গে বৈদিক গুরুকুলপ্রথার শিক্ষার প্রসঙ্গ চলে এসেছিল ৷ আসলে গুরুমহারাজ এইসব নিয়ে কতবার যে বিভিন্ন সিটিংয়ে আলোচনা করেছিলেন – তার ইয়ত্তা নাই ৷ আর উনি প্রতিবার নতুন নতুন তথ্য দিয়ে, নতুন নতুন ভাবে_একই কথার আলোচনা করতেন ৷ আর আমরা যারা শুনতাম তারা প্রতিবারই ঐ একই ধরনের কথা শুনতাম – কিন্তু মনে হতো যেন সম্পূর্ণ আলাদা কোনো প্রসঙ্গ শুনছি ! ওনার কথা শুনতে কখনও কাউকে Bore হতে দেখিনি – বরং কোন ফাঁকে সিটিংয়ে উপস্থিতজনেদের দিকে চোখ পড়ে গেলে দেখতাম সকলেই কেমন যেন বড় বড় চোখ করে একেবারে ‘হাঁ’- করে অবাক বিস্ময়ে গুরু মহারাজের মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে !
যাইহোক, যা আলোচনা হচ্ছিল সেইখানেই ফিরে যাই ! Need of Life এবং Necessity of Life নিয়ে আগে অনেকটাই আলোচনা হয়ে গেছে – এখন যে আলোচনা শুরু হওয়া উচিত সেটা হলো Purpose of Life ! পৃথিবী গ্রহের সবচাইতে উন্নত জীব মানুষ ! বিবর্তনের ধারা বেয়ে বেয়ে এককোষী প্রাণী থেকে শুরু করে উন্নত হতে হতে সে সবচাইতে অধিক অভিযোজনক্ষম, সবচাইতে নিরাপদ, সবচাইতে বুদ্ধিমান, চিন্তাশীল, বিচক্ষন জীবের রূপ পেয়েছে। গুরুমহারাজ বলেছিলেন – বর্তমান মানুষের যে আকার বা আকৃতি, সেইটাই জীব বিবর্তনের সর্বোচ্চ ক্রম হবারই উপযুক্ত ! কারণ এই মহাবিশ্ব-ব্রহ্মান্ডও নাকি #নরাকার ! প্রাচীন যুগ থেকেই মহাকাশ গবেষণাকারীরাও সপ্তর্ষিমণ্ডলের সাথে কালপুরুষের যে কাল্পনিক চিত্র বানিয়েছে তাও একটি #নরাকার চিত্র বিশেষ । গীতায় অর্জুন ভগবানের যে বিশ্বরূপ দর্শন করেছিল তাও ছিল এক বিশালাকার নরমূর্তি ! ভারতীয় ঋষিরা মহাকালকে শিবমূর্তি দিয়ে বর্ণনা করেছিলেন ৷ সেমেটিক চিন্তাতেও রয়েছে সর্বশক্তিমান ঈশ্বর (আল্লাহ বা গড) #নরাকার। এইভাবে দেখা যায় মহাবিশ্ব প্রকৃতিতেও এই #নরাকার ব্যাপারটা রয়েই গেছে ! এই হিসাবে জীব বিবর্তনের মানুষের শরীর পাওয়াটাই বাহ্যিক বিবর্তনের শ্রেষ্ঠ প্রকাশ ৷ এর থেকে ভালো শরীর এই পৃথিবীগ্রহে আর পাওয়াটা আর সম্ভব ছিল না ।।
তাহলে এবার কিসের বিবর্তন ? শরীরের বিবর্তন তো শেষ বা অন্তিম পর্যায়ে পৌঁছালো – তাহলে এবার কিসের বিবর্তন ? গুরুমহারাজ বললেন – এবার অন্তর্জগতের বিবর্তন, এটা আর evolution নয় ,এটা involution ! অন্যান্য সমস্ত জীবের তুলনায় মানুষের যেটা বেশি আছে সেটা তো তার অন্তর্জগৎ ! মন-বুদ্ধি-চিত্ত-অহংকার এই অন্তঃকরন চতুষ্টয়-ই অন্য জীব থেকে মানুষকে পৃথক রাখতে সাহায্য করেছে, তাকে সবার থেকে উন্নত হতে সাহায্য করেছে । মানুষ নিম্নতর জীব থেকে সর্বোন্নত জীব হয়ে ওঠার পর থেকে যখন সে এবার ‘উন্নত মানুষ’- হয়ে ওঠার চেষ্টা করলো, তখন থেকেই মানুষের মন-বুদ্ধির বিবর্তন বা envolution হতে শুরু করল ।
তাই ‘উন্নত মানুষ”-এই কথাটির অর্থই হচ্ছে – উন্নত মনের মানুষ, উন্নত বুদ্ধির মানুষ অর্থাৎ এককথায় বলা হয় উন্নত চেতনার মানুষ ! গুরুমহারাজের কাছে শুনেছিলাম, ” Thousand faculties of mind “. গুরুমহারাজ মনকে বলেছিলেন – যেন কালীয়নাগ, যার সহস্রফণা !এমনিতে কালীয়নাগের সমুন্নত ফণা থেকে শুধু বিষ-ই ঝরে, কিন্তু যখন কালীয় দমনে শ্রীকৃষ্ণ ফণায় ফণায় নেচে বেড়ান – একমাত্র তখন-ই কালীয়নাগের ফণা অবনত, সে ফণায় আর বিষ থাকে না । মানুষের মনও সদাসর্বদা হাজার বিষয়ে নিবদ্ধ হয় এবং মনে তার ছাপ পড়ে পড়ে_ মন মলিন হয় ৷ গুরুমহারাজ মনকে Unit ধরে বুঝিয়েছিলেন যে, একটা মন যখন হাজার বিষয়ে নিবদ্ধ হয় – তখন সেই Ratio হয়ে যায় _1/1000_, ফলে তার মান হয় খুবই কম অর্থাৎ হাজার হাজার বিষয়ে মন নিবদ্ধ হওয়ায়, কোন বিষয়টি-ই ভালোভাবে রপ্ত করা যায় না ! এবার এই মনের বিষয়কে যদি সংযমের দ্বারা কমানো যায় অর্থাৎ ধরা যাক, মনের বিষয় কমে যদি 100 হয়ে যায় তাহলে তখন মান দাঁড়ায় _1/100_, এই মান পূর্বের থেকে বেশি। এইভাবে যদি মনের বিষয় কমতে কমতে 10 হয়, তাহলে সেই মান দাঁড়ায় _1/10 অর্থাৎ যার মান আরো অনেক বেশি ৷ এইভাবে দেখা যায়_সংযত মানুষের মন ধীরে ধীরে উন্নত হতে থাকে এবং ওই মানুষটি মানবসমাজে ‘উন্নত মানুষ’ হিসাবে বিবেচিত হতে থাকে ৷ এইবার যদি ওই উন্নত মানুষটি তার মনকে শুধুমাত্র একটি বিষয়ে – হ্যাঁ মাত্র একটিই বিষয়ে নিবদ্ধ রাখতে পারে, একমাত্র তখনই _1/1_= 1 অর্থাৎ সেই মন দ্বারা ওই বিষয়টির পরিপূর্ণ জ্ঞান লাভ করা সম্ভব হয় । আর যদি ওই সাধক অর্থাৎ ওই উন্নত মানব তার মনকে বিষয়শূন্য করে দিতে পারে – তাহলে তার মান হয় _1/0_= ∞ অর্থাৎ infinity বা অসীম! তখনই ওই মহাসাধক অনন্তের আস্বাদ পায় বা বলা যায় সেই সাধকের আত্ম-সাক্ষাৎকার বা ব্রহ্ম-সাক্ষাৎকার হয়।(ক্রমশঃ)