গুরু মহারাজ স্বামী পরমানন্দ মন আর চিত্তের পার্থক্য আমাদেকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন।ভারতীয় শাস্ত্রাদির উল্লেখ করে গুরুমহারাজ বলেছিলেন – চিত্ত হ্রদে যেন মন, বুদ্ধি এবং অহংকার তরঙ্গায়িত হয়ে রয়েছে ! সংকল্প-বিকল্পাত্মিকা বৃত্তি-কে বলা হচ্ছে মন, নিশ্চয়াত্মিকা বৃত্তি-কে বলা হচ্ছে বুদ্ধি এবং অভিমানাত্মিকা বৃত্তি-কে বলা হচ্ছে অহংকার । সুতরাং মন, বুদ্ধি এবং অহংকার হচ্ছে চিত্তের বৃত্তিসমূহ ! এই চিত্ত হ্রদ কখন নিস্তরঙ্গ হয় , – যখন ‘চিত্তবৃত্তি নিরোধ’ অবস্থা প্রাপ্ত হওয়া যায় ! এই ‘চিত্তবৃত্তি নিরোধ’- অবস্থাই সাধকের সমাধি অবস্থা বা সর্বোচ্চ স্থিতি । সমাধিকে আবার সাধারণত দুই ভাগে ব্যাখ্যা করা হয় – সবিকল্প এবং নির্বিকল্প ! সহজ সমাধি বা সবিকল্প সমাধি অবস্থার স্থায়িত্বকাল বেশি হয় না – কিছুক্ষণের জন্য অদ্বৈতভূমিতে অবস্থানের পর আবার দ্বৈতভূমিতে ফিরে আসা ৷ কিন্তু নির্বিকল্প সমাধি অবস্থাতে আর কোন বিকল্প থাকে না – তখন শুধুই ব্রহ্ম ! ব্যক্তিসত্তা ব্রহ্মসত্তায় মিশে এক আকার প্রাপ্ত হয় ৷
সাধারন সাধক বা Accending-রা এই অবস্থা প্রাপ্ত হলে আর শরীরে মনোনিবেশ করতেই পারে না অর্থাৎ আর দ্বৈতভূমিতে ফিরতেই পারে না,শরীর পাত হয়ে যায় । কিন্তু অবতার পুরুষ বা decending যাঁরা, তাঁরা ওই অদ্বৈতভূমি থেকে আবার দ্বৈতভূমিতে ফিরে আসেন এবং ফিরে এসে সেই ‘অপরূপ লোক’, যে লোকের কথা সাধারণের কাছে চিরদিনের অজানা-অচেনা-রহস্যেঘেরা, সেই ‘লোকে’-র কথা মানুষকে জানান ! সাধারণ মানুষকে ‘অমৃতের পুত্র’ বলে সম্বোধন করে – সবাইকে সেই অমৃত লোকের অধিকারী হবার আহ্বান জানান, সকলকে সেই অমৃতত্ত্ব লাভ করার লোভ ধরিয়ে যান ।
যাইহোক, কথা হচ্ছিল মন এবং চিত্ত নিয়ে – আমরা সেই Point-এ ফিরে যাই ৷ তাহলে দেখা গেল মন হোল চিত্তের একটি বৃত্তি বা চিত্ত হ্রদে উত্থিত একটি তরঙ্গ । বাংলায় মন এবং চিত্ত পৃথক পৃথক দুটি শব্দ হলেও ইংরেজিতে মন এবং চিত্ত উভয়েরই প্রতিশব্দ ‘mind’ – যার জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বয়ং তাঁর কবিতা “চিত্ত যেথা ভয়শূণ্যে”-র ইংরেজি অনুবাদ করেছেন – “Where the mind is without fear!” কিন্তু গুরু মহারাজ বললেন – চিত্তের ইংরেজি প্রতিশব্দ হওয়া উচিত mindstuff ! চিত্তের প্রকৃত অবস্থা নিস্তরঙ্গ-শান্ত-সুস্থিত । কিন্তু মানুষের চিত্তবৃত্তিসমূহ (মন, বুদ্ধি, অহংকার) সর্বদা এত বেশি ক্রিয়াশীল যে সেই শান্ত চিত্ত হ্রদে তরঙ্গের পর তরঙ্গ উঠেই চলেছে – আর চিত্ত হ্রদ সদাসর্বদা আলোড়িত হয়েই চলেছে ৷ গুরু মহারাজের মুখে শুনেছিলাম চিত্তের ভিন্ন ভিন্ন অবস্থার কথা – মূঢ় চিত্ত, ক্ষিপ্ত চিত্ত, বিক্ষিপ্ত চিত্ত, শান্ত চিত্ত ও নিরূদ্ধ চিত্ত ! নামগুলি শুনেই আমরা প্রত্যেকেই বুঝতে পারছি আমাদের নিজ নিজ চিত্তের কোন অবস্থায় আমরা রয়েছি !
মনে হয় আমরা বেশিরভাগই ওই প্রথম তিনটির দলে ! চিত্ত শান্ত হওয়া মানেই চিত্ত হ্রদের নিস্তরঙ্গ অবস্থা ! তার মানে হল, আমি এটা করব – ওটা করবো না, এটা বলব – ওটা বলবো না এইরূপ) সংকল্প-বিকল্পাত্মক বৃত্তি-র কোন ক্রিয়া নাই, (আমি এটাই করব, অর্থাৎ এইভাবেই বলবো –এইরূপ) নিশ্চয়াত্মক বৃত্তি-র কোন ক্রিয়া নাই এবং ‘আমি-ই আমার জীবনের সব ক্রিয়াকর্মের কর্তা’– এইরূপ অভিমানাত্মক বৃত্তিরও কোন ক্রিয়া নাই ! কিন্তু এইরূপ প্রাপ্ত হওয়া কি সাধারনের পক্ষে সম্ভব ? এর-ও উপরের অবস্থা নিরুদ্ধ-চিত্ত অবস্থা – যেটি নির্বিকল্প সমাধি অবস্থার কথা !
এখন একটা জিজ্ঞাসা এখানে আসতেই পারে যে, মানুষের Parpose of Life যে পূর্ণতা বা আত্মসাক্ষাৎকার অথবা ব্রহ্মসাক্ষাৎকার অথবা বলা যায় নির্বিকল্প অবস্থা-লাভ – এর প্রয়োজনীয়তাই বা কি ? মানুষ তো বেশ ভালো-ই আছে – ঠিকই তো চলছে জীবনের গতি ! কিন্তু সত্যিই কি তাই ? সত্যিই কি সকল মানুষ ভালো আছে, সুখে আছে, শান্তিতে আছে, আনন্দে আছে ? না – তা নেই ! বেশিরভাগ মানুষেরই (99.9%) বাইরেরটা হয়তো একটা সুখ-শান্তি-আনন্দের ছদ্ম আবরণে ঢাকা – কিন্তু ভিতরটা, অন্তরটা ? সেখানে একটু প্রবেশ করলেই দেখা যাবে প্রত্যেকে কোন না কোন জ্বালায় জ্বলছে, আর শুধু জ্বলছে বললেই ঠিক বলা হবে না – জ্বলে-পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে ! ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের ভাষায় – উটের কাঁটাগাছ খাওয়ার মতো আমাদের অবস্থা ! বারবার কাঁটাগাছ খেতে গিয়ে মুখ রক্তাক্ত হচ্ছে কিন্তু ক্ষুধার তাড়নায় আবার খাবার স্পৃহা জাগছে ! গুরু মহারাজ এই ব্যাপারটাকেই__ মহাভারতে উল্লেখিত শরশয্যায় শায়িত মহামতি ভীষ্মের পান্ডবদেরকে দেওয়া উপদেশের কথাগুলি উল্লেখ করে সেই গল্পটি বলতেন __যেখানে একজন ব্যক্তি বুনোহাতির তাড়া খেয়ে বনের মধ্যে অবস্থিত একটি পরিত্যক্ত কূপের দড়ি ধরে ঝুলতে ঝুলতে দেখল কূপের তলদেশে জল নাই কিন্তু সেখানে উদ্যত ফণা কালসর্প রয়েছে – যার এক ছোবলেই ছবি !
এদিকে লোকটি দড়ি ধরে ঝুলতে শুরু করার সাথে সাথেই একটি সাদা ইঁদুর এবং একটি কালো ইঁদুর ঐ দড়িটা কাটতে শুরু করল অর্থাৎ মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী হয়ে গেল, কিন্তু ভয়ে-ক্লান্তিতে সে এমন তৃষ্ণার্ত , যে মনে হচ্ছে – একটু কিছু আহার্য বা পানীয় না পেলে প্রানটা এক্ষুনি চলে যাবে । হটাৎ সে দেখল নাকের ডগাতেই একটা প্রাচীন মৌচাক, তাতে মধু ভর্তি রয়েছে ! মধু !! আর যায় কোথায় ? আঙ্গুলের খোঁচা দিতেই – আঙ্গুল ভর্তি মধু! আর সেটা জিভে দিতেই মনটা খুব খুশি হয়ে গেল – আঃ ! কি আস্বাদ ! প্রাণটা জুড়ালো রে ! কিন্তু ততক্ষণে মধু রক্ষাকারী মৌমাছির দল চোখে-মুখে হুল ফোটাতে শুরু করে দিল –আর সাথে সাথেই “বাবা রে! মলুম রে! গেলুম রে!”_এটাই সাধারণ সংসারীদের অবস্থা!!(ক্রমশঃ)
সাধারন সাধক বা Accending-রা এই অবস্থা প্রাপ্ত হলে আর শরীরে মনোনিবেশ করতেই পারে না অর্থাৎ আর দ্বৈতভূমিতে ফিরতেই পারে না,শরীর পাত হয়ে যায় । কিন্তু অবতার পুরুষ বা decending যাঁরা, তাঁরা ওই অদ্বৈতভূমি থেকে আবার দ্বৈতভূমিতে ফিরে আসেন এবং ফিরে এসে সেই ‘অপরূপ লোক’, যে লোকের কথা সাধারণের কাছে চিরদিনের অজানা-অচেনা-রহস্যেঘেরা, সেই ‘লোকে’-র কথা মানুষকে জানান ! সাধারণ মানুষকে ‘অমৃতের পুত্র’ বলে সম্বোধন করে – সবাইকে সেই অমৃত লোকের অধিকারী হবার আহ্বান জানান, সকলকে সেই অমৃতত্ত্ব লাভ করার লোভ ধরিয়ে যান ।
যাইহোক, কথা হচ্ছিল মন এবং চিত্ত নিয়ে – আমরা সেই Point-এ ফিরে যাই ৷ তাহলে দেখা গেল মন হোল চিত্তের একটি বৃত্তি বা চিত্ত হ্রদে উত্থিত একটি তরঙ্গ । বাংলায় মন এবং চিত্ত পৃথক পৃথক দুটি শব্দ হলেও ইংরেজিতে মন এবং চিত্ত উভয়েরই প্রতিশব্দ ‘mind’ – যার জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বয়ং তাঁর কবিতা “চিত্ত যেথা ভয়শূণ্যে”-র ইংরেজি অনুবাদ করেছেন – “Where the mind is without fear!” কিন্তু গুরু মহারাজ বললেন – চিত্তের ইংরেজি প্রতিশব্দ হওয়া উচিত mindstuff ! চিত্তের প্রকৃত অবস্থা নিস্তরঙ্গ-শান্ত-সুস্থিত । কিন্তু মানুষের চিত্তবৃত্তিসমূহ (মন, বুদ্ধি, অহংকার) সর্বদা এত বেশি ক্রিয়াশীল যে সেই শান্ত চিত্ত হ্রদে তরঙ্গের পর তরঙ্গ উঠেই চলেছে – আর চিত্ত হ্রদ সদাসর্বদা আলোড়িত হয়েই চলেছে ৷ গুরু মহারাজের মুখে শুনেছিলাম চিত্তের ভিন্ন ভিন্ন অবস্থার কথা – মূঢ় চিত্ত, ক্ষিপ্ত চিত্ত, বিক্ষিপ্ত চিত্ত, শান্ত চিত্ত ও নিরূদ্ধ চিত্ত ! নামগুলি শুনেই আমরা প্রত্যেকেই বুঝতে পারছি আমাদের নিজ নিজ চিত্তের কোন অবস্থায় আমরা রয়েছি !
মনে হয় আমরা বেশিরভাগই ওই প্রথম তিনটির দলে ! চিত্ত শান্ত হওয়া মানেই চিত্ত হ্রদের নিস্তরঙ্গ অবস্থা ! তার মানে হল, আমি এটা করব – ওটা করবো না, এটা বলব – ওটা বলবো না এইরূপ) সংকল্প-বিকল্পাত্মক বৃত্তি-র কোন ক্রিয়া নাই, (আমি এটাই করব, অর্থাৎ এইভাবেই বলবো –এইরূপ) নিশ্চয়াত্মক বৃত্তি-র কোন ক্রিয়া নাই এবং ‘আমি-ই আমার জীবনের সব ক্রিয়াকর্মের কর্তা’– এইরূপ অভিমানাত্মক বৃত্তিরও কোন ক্রিয়া নাই ! কিন্তু এইরূপ প্রাপ্ত হওয়া কি সাধারনের পক্ষে সম্ভব ? এর-ও উপরের অবস্থা নিরুদ্ধ-চিত্ত অবস্থা – যেটি নির্বিকল্প সমাধি অবস্থার কথা !
এখন একটা জিজ্ঞাসা এখানে আসতেই পারে যে, মানুষের Parpose of Life যে পূর্ণতা বা আত্মসাক্ষাৎকার অথবা ব্রহ্মসাক্ষাৎকার অথবা বলা যায় নির্বিকল্প অবস্থা-লাভ – এর প্রয়োজনীয়তাই বা কি ? মানুষ তো বেশ ভালো-ই আছে – ঠিকই তো চলছে জীবনের গতি ! কিন্তু সত্যিই কি তাই ? সত্যিই কি সকল মানুষ ভালো আছে, সুখে আছে, শান্তিতে আছে, আনন্দে আছে ? না – তা নেই ! বেশিরভাগ মানুষেরই (99.9%) বাইরেরটা হয়তো একটা সুখ-শান্তি-আনন্দের ছদ্ম আবরণে ঢাকা – কিন্তু ভিতরটা, অন্তরটা ? সেখানে একটু প্রবেশ করলেই দেখা যাবে প্রত্যেকে কোন না কোন জ্বালায় জ্বলছে, আর শুধু জ্বলছে বললেই ঠিক বলা হবে না – জ্বলে-পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে ! ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের ভাষায় – উটের কাঁটাগাছ খাওয়ার মতো আমাদের অবস্থা ! বারবার কাঁটাগাছ খেতে গিয়ে মুখ রক্তাক্ত হচ্ছে কিন্তু ক্ষুধার তাড়নায় আবার খাবার স্পৃহা জাগছে ! গুরু মহারাজ এই ব্যাপারটাকেই__ মহাভারতে উল্লেখিত শরশয্যায় শায়িত মহামতি ভীষ্মের পান্ডবদেরকে দেওয়া উপদেশের কথাগুলি উল্লেখ করে সেই গল্পটি বলতেন __যেখানে একজন ব্যক্তি বুনোহাতির তাড়া খেয়ে বনের মধ্যে অবস্থিত একটি পরিত্যক্ত কূপের দড়ি ধরে ঝুলতে ঝুলতে দেখল কূপের তলদেশে জল নাই কিন্তু সেখানে উদ্যত ফণা কালসর্প রয়েছে – যার এক ছোবলেই ছবি !
এদিকে লোকটি দড়ি ধরে ঝুলতে শুরু করার সাথে সাথেই একটি সাদা ইঁদুর এবং একটি কালো ইঁদুর ঐ দড়িটা কাটতে শুরু করল অর্থাৎ মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী হয়ে গেল, কিন্তু ভয়ে-ক্লান্তিতে সে এমন তৃষ্ণার্ত , যে মনে হচ্ছে – একটু কিছু আহার্য বা পানীয় না পেলে প্রানটা এক্ষুনি চলে যাবে । হটাৎ সে দেখল নাকের ডগাতেই একটা প্রাচীন মৌচাক, তাতে মধু ভর্তি রয়েছে ! মধু !! আর যায় কোথায় ? আঙ্গুলের খোঁচা দিতেই – আঙ্গুল ভর্তি মধু! আর সেটা জিভে দিতেই মনটা খুব খুশি হয়ে গেল – আঃ ! কি আস্বাদ ! প্রাণটা জুড়ালো রে ! কিন্তু ততক্ষণে মধু রক্ষাকারী মৌমাছির দল চোখে-মুখে হুল ফোটাতে শুরু করে দিল –আর সাথে সাথেই “বাবা রে! মলুম রে! গেলুম রে!”_এটাই সাধারণ সংসারীদের অবস্থা!!(ক্রমশঃ)