গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দ বর্তমান পৃথিবীর অবস্থার কথা বহুবার বহুভাবে আলোচনা করতেন – আমাদের মোটা মাথায় সবসময় সেসব স্থান পেতো না – হয়তো আমরা তাঁর সব কথা বুঝতেই পারতাম না আবার এটাও ঠিক যে, সেভাবে আমরা তখন বুঝতে চাইতামও না ! কারণ আমাদের একটা বিশাল ভরসা, বিশ্বাসের, নির্ভরতার পাহাড়প্রতিম জায়গা ছিলেন গুরুমহারাজ ! আমরা তখন ভাবতাম অতো কথা মনে রেখে বা বুঝেই বা কি করবো – গুরুমহারাজ তো স্বয়ং রয়েছেনই ! উনি তো এইরকম কথা আরও কতোই বলবেন – আমরা এসব কথা এবং আরো কতো কথা, নতুন নতুন কথা অনন্তকাল ধরে শুনেই যাবো ! কিন্তু উনি (গুরুমহারাজ) যে এমনি করে হঠাৎ করে আমাদেরকে ‘অনাথ’ করে দিয়ে চলে যাবেন – তা তখন বুঝতে পারিনি ! আসলে ভগবানকে কি ধরা যায় – আর যা দিয়ে তাকে ধরা যায় – সেই ভক্তিসম্পদ, জ্ঞানসম্পদ এগুলিই বা আমাদের কোথায় ? এসব কথা এখন থাক – এর আগে একদিন যে কথা হচ্ছিল সেই কথায় আসি । ইহুদীদের ধর্মগ্রন্থ “ওল্ড টেস্টামেন্ট”, খ্রিস্টানদের ধর্মগ্রন্থ “নিউ টেস্টামেন্ট” এবং ইসলামীয়দের ধর্মগ্রন্থ “আল-কোরআন” -এর মধ্যে যথেষ্ট সাদৃশ্য রয়েছে – কারণ এই তিন ধর্মমতই মূলতঃ সেমিটিক, অর্থাৎ এই তিনটি গ্রন্থের উৎস এক‌ই ! গুরুমহারাজ অবশ্য ‘ইসলাম’-কে ধর্ম বা ধর্মমত হিসাবে বলেন নি – উনি বলেছিলেন, “ইসলাম একটা মজহব !” যাইহোক, এসব কথাও আমাদের আলোচ্য ছিল না – আমরা আলোচনা করছিলাম যে, প্রাচীনকাল থেকেই দেখা যায় – পৃথিবীর বিভিন্ন শক্তিশালী ব্যক্তি, মতবাদ বা গোষ্ঠী বারবার পৃথিবীতে নিজের বা নিজের দলের কর্তৃত্ব কায়েম করতে চায় এবং তাদের অনুসারীরা সেই কায়েম-অবস্থাটি দেখতে চায় । কিন্তু এদের কারো ধারণাই নাই__এইরকমটা করা সম্ভব কি না, মহাপ্রকৃতি এই ব্যাপারটা আদৌ Allow করবে কি না,এইটা করতে গিয়ে কত শত-সহস্র মানুষের রক্ত ঝরবে, কত শত-সহস্র নারী এবং শিশুর চোখের জল ঝরবে – আর যদিও বা তেমনটা হয় অর্থাৎ সমগ্র বিশ্ব একটা যে কোন মতের অধীনে বা ব্যক্তির অধীনে আসেও – তাতেই কি পৃথিবীর সমস্ত সমস্যা দূর হয়ে যাবে_কি না ? কোন ব্যক্তি কি আর __কখনোই কোন দুঃখে কাঁদবে না, কোন সমস্যায় জর্জরিত হবে না, পৃথিবীতে কি প্রকৃতই সত্যি সত্যিই একটা শান্তির বাতাবরণ বিরাজ করবে ? এদের কারোরই সুদূরপ্রসারী এইসব চিন্তার বালাই নাই ! ফলাফল কি হতে পারে সেই নিয়ে কোন মাথাব্যাথাই নাই ! শুধুমাত্র ‘আপন ভালোলাগা’-টা বাকিদের মধ্যে সঞ্চারিত করার নেশা ! এটাকে বলা হয়েছে Complex ! গুরুমহারাজ বলেছিলেন প্রকৃতিতে দুটো Complex রয়েছে – Inferior Complex এবং Superior Complex ! দুটোই মারাত্মক ! এতক্ষণ যাদের কথা বলা হলো – শক্তিশালী, ক্ষমতালোভী, স্বৈরাচারী, একনায়কতন্ত্রে বিশ্বাসীরা __Superior Complex -এর উদাহরণ ! যত যুদ্ধের ধ্বংসলীলা, অত্যাচার, অনাচার, সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা, নরসংহার ইত্যাদি যতকিছু হয়েছে – এগুলি সবই হয়েছে ঐ Superior Complex যুক্ত ব্যক্তিদের জন্য ! ছোট ছোট আকারেও সমাজে, পরিবারে এই ধরনের ব্যক্তিদের দেখা পাওয়া যায় – যারা সবসময় চায় তার চারপাশের লোকেদের dominate করে রাখতে চায়! Inferior Complex -এ ভোগা ব্যক্তিরা সর্বদাই একটা হীনমন্যতায় ভোগে – সে সবসময় তার চারপাশের লোকেদের কাছে বিরক্তির কারণ, অশান্তির কারণ ! এদের নিজেদের উপর কোন confidence থাকে না_অথচ মনে অনেক সাধ, যেগুলো পূর্ণ হবার কোন উপায় নাই।এখান থেকেই শুরু হয়_বিকৃতি বা pervertion ! তাই নিজেদের কামনা বাসনা চরিতার্থ করার জন্য ওরা কোন না কোন দলে নাম লেখায়। বৃহত্তর রূপে এই perverted লোকেরাই Superior Complex -এ ভোগা স্বৈরতন্ত্রী, অত্যাচারীদের দলের সৈনিক হয়ে যায় এবং চিৎকার করে দলের শ্লোগান দিয়ে অথবা ঈশ্বরের নাম মুখে নিয়ে_ঘুমন্ত সাধারণ মানুষের ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়, নিরীহ মানুষের গলায় অক্লেশে ছুড়ি বসিয়ে দেয়, মায়ের কোল থেকে শিশুকে কেড়ে নিয়ে উদ্যত তরোয়ালে গেঁথে দেয় ! … [ক্রমশঃ]