গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের করা আলোচনা নিয়ে কথা হচ্ছিল । “আহার-নিদ্রা-মৈথুনঞ্চ-ভয়ম্”– এই নিয়ে এখন চলছে আমাদের আলোচনা । কথাটি আমরা প্রথম গুরুমহারাজের কাছে শুনেছিলাম কিন্তু কথাগুলি হয়তো Originally কোন উপনিষদের অংশ । কোন ঋষি তাঁর শিষ্যদের কাছে জীবের বৃত্তি বা প্রকৃতি বোঝাতে এই শ্লোকটি উদ্ধৃত করেছিলেন । কিন্তু উপনিষদে প্রবৃত্তি ছাড়াও আর একটি কথার‌ও উল্লেখ রয়েছে – সেটি হলো “নিবৃত্তি” ! নিবৃত্তি মার্গ-ই হলো ‘সংযম’ ! যে কোন ব্যাপারে ‘না’ বলতে শেখা – এটাই সংযম! আর সংযম-অভ্যাস সভ্য মানুষের – উন্নত মানুষের পরিচায়ক !
সাধারণত মানুষ কামনা ও বাসনার দাসত্ব করেই জীবন কাটিয়ে দেয় – মনুষ্যেতর জীবের ‘কামনা’ এই ব্যাপারটার কিছুটা থাকলেও ‘বাসনা’ বা ইচ্ছাশক্তি থাকে না ! গুরু মহারাজ বলেছিলেন_”ভাবনা-ইচ্ছা-ক্রিয়া”! মানুষের অন্তঃকরণে প্রথমে কোন কিছু পাবার বা কোন কিছু লাভ করার ভাবনা আসে এবং সেটি ইচ্ছায় রূপ পেলেই _ইচ্ছাটি ক্রিয়ায় আসে। কিন্তু মনুষ্যেতর প্রানীর এই ভাবনাই আসে না _ কিন্তু আহার, নিদ্রা, মৈথুন ও ভয় সমস্ত জীবের-ই স্বাভাবিক স্বভাবের মধ্যে পড়ে ! গুরুমহারাজ বলেছিলেন – জৈবিক এই সকল প্রবৃত্তির দাসত্ব করাটা মানুষের সাজে না ৷ যেহেতু মানুষ সমস্ত জীব অপেক্ষা উন্নত তাই সে কেন ওইগুলির ‘দাস’ হবে, সে কেন কামনা-বাসনার দাসত্ব করবে ? তাকে তো এই প্রবৃত্তিগুলির ‘প্রভু’ হয়ে উঠতে হবে – তবেই তো সে সর্বোন্নত জীব-মানুষ !
আগের দিন আমরা ‘আহার সংযম’ নিয়ে কিছুটা আলোচনা করেছিলাম – আজকে সেটিকে আরেকটু বিস্তারে নিয়ে যাওয়া যাক্ ! গুরুমহারাজ বলেছিলেন – জীবের আহার্যের প্রয়োজন হয় শরীর রক্ষার জন্য, যেহেতু জীবের শক্তি সাধারণত সরাসরি আসে আহার্য থেকে ৷ কিন্তু সর্বোন্নত জীব মানুষ যখন থেকে চেতনায় উন্নত হোতে শুরু করল – সে চেষ্টা করতে লাগল প্রচলিত ‘ধারা’-র বিপরীতে গিয়ে ‘রাধা’ হয়ে উঠতে ! সব জীব-ই সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শুধু গিলেই চলেছে, সদাসর্বদা শুধু খাবার জোগাড়ের জন্যই যেন ব্যস্ত !
মানব শরীর লাভ করার পরও সেই একই প্রবৃত্তি কেন থাকবে – তাই চেতনায় উন্নত মানবেরা শুরু করলেন খাদ্যসংযম ! তাঁরাই প্রথম খাদ্যের প্রতি লোভ না দেখিয়ে ‘না’- বলতে শুরু করলেন _ এই খাদ্যে আমার প্রয়োজন নাই – ওটাতেও না ! তাঁরা শরীর ধারণ এবং উন্নত চিন্তার (সাধন-ভজন) জন্য যতটুকু খাদ্যের প্রয়োজন ততটুকু-ই গ্রহণ করতে থাকলেন, তাও খাদ্যগুলির বর্ণ, গন্ধ এবং স্বাদ অক্ষুন্ন রেখে । গুরুমহারাজ এরূপ খাদ্যকে বলেছিলেন সাত্ত্বিক আহার ! খাদ্যের সঙ্গে উগ্র ঝাল-মশলা, তেল-ঘি যোগ করলে – সেই খাদ্য হয়ে গেল রাজসিক, এবং খাদ্যকে বিকৃত করে খেলে অর্থাৎ খাদ্যকে রেখে দিয়ে বাসি-কটু করে খেলে তা হয় তামসিক খাদ্য ! সাত্ত্বিক প্রকৃতির মানুষের সাত্ত্বিক আহার পছন্দের, রাজসিক ব্যক্তিদের রাজসিক আহার এবং তামসিক ব্যক্তিদের তামসিকভাবে প্রস্তুত আহার-ই পছন্দের হয়ে থাকে ৷ এইজন্যেই বলা হয় – “আপ রূচি খানা !”
ভারতবর্ষে যখন থেকে যোগবিজ্ঞান উন্নত হলো – তখন থেকেই ভারতীয় যোগীরা স্থূল আহার্য্য গ্রহণের বিকল্প খুঁজে বের করে ফেললেন ! ওঁরা দেখলেন প্রকৃতির মাটি, জল, হাওয়া, সূর্যালোক, চন্দ্রালোক – ইত্যাদির মধ্যে খাদ্যগুণ রয়েছে – তা গ্রহণ করেই শরীর ধারণ করা সম্ভব ৷ গুরু মহারাজ বলেছিলেন সূর্যবিজ্ঞানের কথা ! সূর্যই পৃথিবীর সকল শক্তির উৎস ! খাদ্যের মধ্যেও সবুজ উদ্ভিদ সালোকসংশ্লেষের মাধ্যমে সেই সৌরশক্তিই খাদ্যশক্তিরূপে আবদ্ধ করে রাখে – তাহলে সরাসরি সেই শক্তি বা তার থেকেও বেশি শক্তি যদি উন্নত মানবেরা হঠাৎ যোগীরা সরাসরি গ্রহণ করতে পারে – তাহলে স্থূল আহার্য্যের কি-ই প্রয়োজন । এছাড়াও রয়েছে সহস্রার নিসৃত: চন্দ্রবারুণী সুধা – তার খবর পরের দিন ৷ … [ক্রমশঃ]