শ্রী শ্রী গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দ বনগ্রাম পরমানন্দ মিশনে সকালে বিকালে যে সমস্ত কথা ভক্তদের জিজ্ঞাসার উত্তরে বলতেন সেগুলিই এখানে আলোচনা হচ্ছিল । যদিও আমাদের সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ Covid-19 -এর জন্য গোটা বিশ্বব্যাপী মানুষের মনে যে আশঙ্কা বা ভয়ের সঞ্চার হয়েছে – সেই ‘ভয়’ -এর উৎস এবং তার প্রতিকারের কথা আলোচনা করতেই এই প্রসঙ্গের অবতারণা! সেইটা করতে গিয়ে আমরা আমরা এখন স্বামী পরমানন্দের দ্বারস্থ হয়েছি ! তিনি এই ব্যাপারে কি বলেছিলেন বা কি কি বলেছিলেন এই নিয়েই চলছে আলোচনা ! কিন্তু শুধু ‘ভয়’ নয়, জীবের প্রবৃত্তিতে রয়েছে আহার, নিদ্রা, মৈথুন ও ভয় – এই চারটি বৈশিষ্ট্য অর্থাৎ জীব মাত্রই এই চারটি তার স্বাভাবিক বা সহজাত প্রবৃত্তি ! গুরুমহারাজ বলেছিলেন_ “মানুষ যেহেতু জীবকুলের মধ্যে সর্বোত্তম – তাই সাধারন জৈব প্রবৃত্তিগুলিকে অতিক্রম করে অসাধারণ হয়ে ওঠাটাই মানবজীবনের সার্থকতা” !
গুরুমহারাজ মানবজীবনের চারটি অনুশীলনের কথা বলেছিলেন ৷ – (১) সত্যের অনুশীলন – সদাচার, (২) ত্যাগের অনুশীলন – পরোপকার, (৩) প্রেমের অনুশীলন – ভালোবাসা এবং (৪) শান্তির অনুশীলন – সংযম । আমাদের আলোচনায় এখন এসেছিল এই সংযমের কথা । কিন্তু সেই আলোচনাতে আমরা অবশ্যই আসবো – তার আগে বলে নিই, মানব উপরোক্ত ঐ চারটি অনুশীলন করেনা বলেই_ সে ঠিক ঠিক ‘মানুষ’ হয়ে উঠতে পারে না !
সদাচারের অনুশীলনের অভাবে মানুষ মিথ্যাচারী হয়ে ওঠে, ফলতঃ সে নিজে সারাজীবন জ্বলে এবং অপরকে জ্বালায় ! পরোপকার – এই অনুশীলনটির অভাবে মানুষ স্বার্থপর হয়ে ওঠে, ফলে সে সারাজীবন ধরে নিজে ঠকে এবং অপরকে ঠকায় আর কর্মফল সঞ্চয় করে ! মানুষের উচিত ছিল ‘আত্মপর’ হওয়া – তা না হয়ে সে হলো ‘স্বার্থপর’– তাতেই দুর্গতি !
তৃতীয়তঃ__ মানব ভালোবাসার অনুশীলনের অভাবে পাশবিকতা সম্পন্ন হয়ে ওঠে ! ফলে বিবর্তনের সর্বশ্রেষ্ঠ শরীর পাওয়া সত্ত্বেও মানুষ নিম্নতর চেতনাসম্পন্ন জীবের ন্যায় আচরণে অভ্যস্ত হয় এবং সমাজের অন্যান্য মানুষকে নানা রকম নির্যাতন করে ! সবশেষ অনুশীলনটি ছিল_ ‘সংযম’, এইটির অভাবে মানুষ অসংযমী হয়ে ওঠে – ফলে ওই ব্যক্তি ব্যভিচারী হয় এবং তার দ্বারা সমাজের বহু মানুষ নিপীড়িত হয় অত্যাচারিত হয়, লাঞ্ছিত হয় ।
এই সংযমের কথা বলতে গিয়েই গুরুমহারাজ বলেছিলেন – ‘না’ বলতে শেখা ! যেখানে সমগ্র মানব সমাজের অধিকাংশ সদস্যরা সবসময় ‘দেহি’ ‘দেহি’ করছে – মায়া, মোহে, ভোগে, ঐশ্বর্য্যে, লালসায় জর্জরিত হয়ে পড়েছে – সেখানে এই মানব সমাজেরই কতিপয় সদস্য এই প্রচলিত জগৎ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে – ভোগের ব্যাপারে, লোভের ব্যাপারে, ঐশ্বর্য্যের ব্যাপারে, সুখস্পৃহায় ‘না’ বলতে শেখেন এবং অপরকেও শেখান! তাঁরাই সংযমী, তাঁরাই সমাজের সভ্য মানুষ, তাঁরাই উন্নত মানুষ । আর এই ‘না’ বলা মানুষগুলি যখন ‘না’ বলাতে সিদ্ধ হয়ে যান তখন তাঁরাই “সোনার মানুষ” হয়ে ওঠেন । আমরা যুগে যুগে তাঁদেরই বন্দনাগান গাই – তাঁদেরই স্তুতি করি – কিন্তু নিজেদের জীবনে ওই অনুশীলনগুলি আনতে পারি না ! আর এর ফলেই আমাদের মতো সাধারন মানুষদের জীবনেও “আহার-নিদ্রা-মৈথুনঞ্চ-ভয়ম্”– অন্যান্য জীবের ন্যায় এই জৈবিক প্রবৃত্তির প্রকটতা দেখা যায় ৷
আমরা আগের দিন আহার-সংযম আলোচনা করতে গিয়ে যোগীদের বিভিন্নভাবে স্থূল আহার পরিত্যাগ করে কিভাবে প্রকৃতিদত্ত আহারেই শরীর ধারণ করা যায় তার আলোচনা শুরু করেছিলাম এবং “চন্দ্রবারুনী সূধা”র কথাও বলেছিলাম–কিন্ত স্বামী পরমানন্দের ‘কথাসরিৎসাগর’-এ একবার নেমে পড়লে_”ও তার তল নাই,কূল নাই__রে!” তাই আর কথা দেবোনা_পরের পরের সংখ্যায় ওটি বলে “আহার প্রসঙ্গ” শেষ করার চেষ্টা করবো ! আর যা নিয়ে আলোচনার শুরু সেই “ভয়” যে কখন জয় হবে _তা পরম করূনাময় ভগবান স্বামী পরমানন্দ‌ই জানেন! … [ক্রমশঃ]