গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের করা আলোচনা থেকে আমরা বার্ধক্যের যন্ত্রণা নিয়ে কথা বলছিলাম । একজন গ্রামে বাস করা বৃদ্ধের উদাহরণ দিয়ে গুরুমহারাজ আমাদেরকে পুরো ব্যাপারটা বোঝাচ্ছিলেন (হয়তো সেদিন সিটিংয়ে উপস্থিত লোকজনেদের বেশিরভাগই গ্রামের মানুষ ছিল)। বৃদ্ধ পিতাটি সারাদিন পুত্রের আগমনের অপেক্ষায় ছটফট করছে – সে মনে মনে ভেবেছে, “আমার ছেলে বড় হয়েছে, রোজগার করতে শিখেছে, ফলে গায়ের জোর – অর্থের জোর সবই তার আছে ! এখন প্রতিবেশীরা আর অকারণে তাকে চোখ রাঙাতে পারবে না, ওই সবল-সুস্থ-যৌবনোচ্ছল ছেলেটির কাঁধে ভর দিয়ে সে বাইরে বেরোবে – সবাইকে চিৎকার করে বলবে,- দ্যাখো ! এইটা আমার ছেলে ! ছেলের গৌরবে বাবা গৌরবান্বিত হবে এবং পুত্রও বাবার মহিমা কৃতজ্ঞচিত্তে সবার কাছে পরিবেশন করবে ৷ –এই ধরনের অন্তরের অন্তঃস্থলের বাসনা ওই বৃদ্ধের !
কিন্তু কিছুই পূর্ণ হলো না – ছেলেটি একবার বাবার ঘরে ঢুকে, বাবাকে একটু জ্ঞান দিয়ে, একটা টর্চ হাতে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে গেল । সেখানে হয় ক্লাবে গিয়ে তাস বা ক্যারাম খেলে দু-তিন ঘণ্টা কাটালো অথবা কোন বন্ধুর নতুন বিবাহ হয়েছে – সেখানে নতুন বৌদির কাছে দিব্যি রাত্রি দশটা পর্যন্ত কাটিয়ে – বাড়ি ফিরে এল ! বৃদ্ধা মা(বা প্রৌঢ়া) ছেলের জন্য খাবার গরম করে বসে রয়েছে – ছেলে খেয়ে দিয়ে তার নিজের ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল ! বাবার তো চোখে ঘুম নাই, মা সব কাজ সেরে ঘরে ঢুকলে একবার খবর নিলো — “খোকা শুয়ে পড়েছে?”
তবে গুরুমহারাজ কিন্তু ওই ছেলেটির কোন দোষ দেখেন নি ! উনি বলেছিলেন – এটাই যৌবনের ধর্ম ! Health, strength and beauty – যৌবনকালের এই তিনটির প্রতিই আকর্ষণ প্রবল থাকে । গাল তোবড়ানো, শক্তিহীন হয়ে পড়া, কুঁথিয়ে কুঁথিয়ে কথা বলা কোন বৃদ্ধ বা বৃদ্ধার কাছে একটা যৌবনোচ্ছল ছেলে বা ছেলের বৌ অর্থাৎ বৌমা __কেন বেশিক্ষণ সময় কাটাবে ? এটাতো তাদের প্রকৃতিতেই নাই – তাইতো ব‌উমা বৃদ্ধের ঘরের দিকে ও হাঁটেনা অথবা ওই ছেলেটি ছুটে চলে যায় ক্লাবে সমবয়সী ইয়ার-বন্ধুদের কাছে বা পাশের বাড়ির কোন যৌবনবতী বৌদির কাছে ! তার সাথে কথা বলে সে দু-তিন ঘণ্টা দিব্যি কাটিয়ে দিতে পারে – বরং মনে হয় এই সময়টা বড়ই সংক্ষিপ্ত – আরো কিছুক্ষণ থাকতে পারলে আরো ভালো লাগতো । where as নিজের বৃদ্ধ পিতার বিছানায় দুদণ্ড বসে – একটু তার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেই পিতার মনটা শান্ত হয়ে যেতো – তার বার্ধক্যের একাকীত্বের যন্ত্রণার অনেকটা লাঘব হতো – কিন্তু সেইটুকু সময় ওই খোকা-র হাতে নাই ! গুরু মহারাজ ঐটাও বলেছিলেন_ যদি কোন বাড়ির যুবক ছেলে বা তার বৌ (ব‌উমা) কোন বৃদ্ধ পিতা বা বৃদ্ধা মাতার সেবা করে_তাহলে জানতে হবে সেই ব্যতিক্রমী ছেলে বা মেয়েটি আধ্যাত্মিক!!
রোগশয্যায় শায়িত কোন বৃদ্ধের যদি বৃদ্ধা স্ত্রী-টি বেঁচে থাকে – তাহলে সেটাই তার জীবনে আশীর্বাদ ! কেন না যতই বকাঝকা করুক না কেন, বৃদ্ধটির সেবা-যত্নে ত্রুটি হতে দেবে না ঐ বৃদ্ধা স্ত্রী-টি ! হয়তো ছেলে-বৌমার সংসার, তবুও সেখান থেকেও বৃদ্ধের জন্য গরমজল, সময়মতো খাবারের জোগান দেওয়া, নিয়ম করে ঔষধ খাওয়ানো – সবই ওই বৃদ্ধা করে যাবে ।
তাই বুড়ো বয়সে স্ত্রী-বিয়োগ হলে বুড়ো-গুলোর সত্যিই বড্ড কষ্ট হয় ! কিন্তু যদি বুড়োটা মারা যায় – বৃদ্ধা মা-টি হয়তো বেঁচে রয়েছে – ওই মা কিন্তু পরিস্থিতির সাথে ঠিক adjust করে নেয় ! বৌমার অসুবিধা হলে নিজেরটা নিজেই করে নেয় – প্রয়োজনে ঝগড়া করেও নিজের দাবীর ন্যায্য অংশ আদায় করে নিতে কসুর করে না ! … [ক্রমশঃ]