গুরু মহারাজ স্বামী পরমানন্দ বলেছিলেন ‘Test of death’ ! উনি বলেছিলেন – আমার পূর্ব পূর্ব জীবনের জন্ম এবং মৃত্যুর অভিজ্ঞতা রয়েছে — সেখান থেকেই তোমাদের কাছে আমি এই ‘test of death’-এর কথা বর্ণনা করলাম ৷ কি সুন্দর কথা ! সেই মহান কথার জাদুকরের কাছে আমরা নতুন নতুন কথা শিখতাম, নতুন করে নিজেকে, নিজের জীবনকে, জগৎ সংসারকে যেন আবিষ্কার করতাম ! সে আমাদের এক দিন গিয়েছে ! আমাদের যত গুরু ভাই-বোন রয়েছে – তারা সকলেই স্বীকার করবে যে, আমাদের জীবনের সেই সময়গুলোই শ্রেষ্ঠ সময় ছিল – যখন আমরা সকলে স্বামী পরমানন্দের পদপ্রান্তে বসে বসে তার শ্রীমুখ থেকে অমৃতময় বাণী শুনতাম II
যাইহোক, গুরুমহারাজের কথা অনুযায়ী সাধারণ মানুষের মৃত্যুর পূর্বে যখন তার চোখে অন্ধকার নেমে আসে, তার মনে হয় সে কোন গভীর থেকে গভীরতর অন্ধকারে প্রবেশ করছে – তখন এক অজানা আতঙ্কে সে চিৎকার করে উঠতে চায় – কিন্তু সেটাও সে পারে না, কেবল একটা গোঁ-গোঁ করে গোঙানির আওয়াজ হতে দেখা যায় ! এই ভাবেই একটা অসহায়তা, একটা আতঙ্কের মধ্যে দিয়েই সাধারণত মানুষের শরীরপাত হয় – যদি না সে কোন সদ্গুরুর আশ্রিত হয় ! সুতরাং মৃত্যুভয় যেমন সারাজীবন মানুষকে তাড়া করে করে বেড়ায় তেমনি মৃত্যুকালেও আতঙ্ক বা ভয় সাধারণ মানুষকে গ্রাস করে ৷
আমরা পূর্ব পূর্ব আলোচনায় যে জৈব প্রবৃত্তিগুলির কথায় ছিলাম তার অন্যতম একটি উপাদান ছিল ‘ভয়’। আমরা সেই আলোচনাতেই আসবো ৷ তার আগে অর্জুনকে ‘গুড়াকেশ’ এবং ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে ‘ঋষিকেশ’ কেন বলা হয়েছে, সে সম্বন্ধে গুরুমহারাজ কি বলেছিলেন – তা বলে নিই ! ‘গুড়াকেশ’- অর্থাৎ নিদ্রজিৎ ! যিনি ‘নিদ্রা’-কে জয় করেছেন ! উনি রামানুজ লক্ষণেরও উল্লেখ করেছিলেন যিনি নিদ্রজিৎ ছিলেন । ‘নিদ্রজিৎ’- অর্থে একেবারেই নিদ্রা যাবে না, তা নয় – কাজের অবসরে শুধুমাত্র বিশ্রাম নেবে – কিন্তু প্রয়োজন পড়লেই আবার কাজে সচেষ্ট ! উনি বলেছিলেন – সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে কোন মানুষ ঘুমিয়ে পড়লে তাকে ঘুম থেকে তোলাটাই একটা কষ্টকর কাজ ! তারপর_ যদিও বা ঘুম ভাঙলো কিন্তু ঘুমের ঘোরটা কাটতেই চায় না – অনেকক্ষণ পর যেন ওই ব্যক্তি বাস্তবে ফিরতে পারে ৷ কিন্তু ‘নিদ্রজিৎ’-এর ক্ষেত্রে এমনটি হবে না – সে সব সময় fit, ঘুম ভেঙেই সঙ্গে সঙ্গে ছুটতে পারে !
উদাহরণ হিসাবে উনি বলেছিলেন – কুকুরের বিশ্রামের কথা ! কুকুর যখন কুকুরকুণ্ডলী পাকিয়ে নিদ্রা যায় তখন দেখে মনে হবে – বোধহয় প্রচন্ড ঘুমোচ্ছে, কিন্তু ‘খুট্’ করে একটি শব্দ হলেই উৎকর্ণ হয়ে যায়, এবং পুনরায় কোন শব্দ হলে বা কোন কিছুর নাড়াচাড়া হলেই–চিৎকার করতে করতে একেবারে দৌড়ে গিয়ে –ঘঠনার জায়গায় গিয়ে হাজির ! এটাকেই গুরুমহারাজ ‘নিদ্রজিৎ’ অবস্থা বলেছিলেন | যোগীরা বিভিন্ন পশুর কাছে যেসব শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন – তার মধ্যে কুকুরের কাছ থেকে ছয়টি গুণ নিয়েছিলেন, বলা হয় ‘ষট্-শুন'[ স্বরোদয় শাশ্ত্রে রয়েছে ” সিংহাদেকং বকাদেকং ষট্ শুনস্ত্রীনি গর্দভাৎ ।
বায়সাৎ পঞ্চ শিক্ষতে চত্বারি কুক্কুটাদপি ॥”
—–অর্থাৎ, সিংহের কাছ থেকে ১টা,
বকের কাছ থেকে ১টা,
কুকুরের কাছ থেকে ৬ টা,
কাকের কাছ থেকে ৫ টা, আর মোরগের কাছ থেকে ৪ টা গুণ শেখার আছে । যথা — (১) সিংহ কোন কাজে ত্রুটি
রাখেনা। মানুষেরও উচিত ত্রুটিবিহীন কর্ম সম্পাদন করা ।
(২) বক এর কাছ থেকে শেখার বিষয় ইন্দ্রিয়াদি সংযত রেখে বিচক্ষণতার সহিত কাজ করা এবং তার একাগ্রতা ।
(৩) শুনঃ অর্থাৎ কুকুরের কাছ থেকে শেখার ৬ টা জিনিস — ১। সর্বদা প্রভুর মঙ্গল চিন্তা করা,
২। অল্পে সন্তুষ্ট থাকা ,
৩। সহজেই ঘুমিয়ে পড়া ,
৪। তাড়াতাড়ি জেগে ওঠা
৫। প্রভুভক্তি, এবং
৬ । সাহসিকতা ।
গাধার কাছে ৩ টা (চারটা ) শেখার আছে — ১। অবিশ্রান্ত ,ক্লান্তিহীনভাবে ভার বহনের ক্ষমতা, ২। শীত-গ্রীষ্মে নরমেগরমে কখনোই কষ্টবোধ না করা, (৪) সর্বদা তুষ্ট থাকা ;
কাকের কাছ থেকে শেখার আছে ৫ টা জিনিস, যথা —– ক্ষিপ্রতা বা চটপটে ভাব ;
ঠিক সময়ে খাবার সংগ্রহ;
গোপনে মৈথুনক্রিয়া, সদা সচেতনভাব, আর আলসেমি না করা ।
কুক্কুটাদপি অর্থাৎ মোরগের কাছ থেকে ৪টা শেখার জিনিস আছে —– যুদ্ধ, প্রভাতে জাগরণ, বন্ধুদের সঙ্গে একত্রে ভোজন এবং বিপদে পতিত স্ত্রী কে রক্ষা করা । ]
‘শুনঃ’- কুকুরের সংস্কৃত নাম ! ছয়টা গুন কি কি তাও গুরুমহারাজ বলেছিলেন – সেগুলির একটা তো বলা হলো, বাকিগুলি হল – অসম্ভব প্রভুভক্তি, অল্পে সন্তুষ্টি, অপরের বিপদে তৎক্ষণাৎ সাহায্য করার প্রবৃত্তি, একাধিক জ্ঞানেন্দ্রিয় জাগরণ (রাত্রেও চোখের দৃষ্টি প্রবল, যেখানে চোখের দৃষ্টি চলে না সেখানে গন্ধ তন্মাত্রাকে কাজে লাগিয়ে যথার্থতা নির্ণয়ের ক্ষমতা, দূরাগত শব্দের গ্রহণ ক্ষমতা), অসাধারণ অভিযোজন ক্ষমতা (কুকুর পৃথিবীর সব অঞ্চলেই survive করতে পারে)! গুরুমহারাজ এ কথাও বলেছিলেন যে, মানব সভ্যতার প্রথমাবস্থায় অর্থাৎ আদিম মানুষের সময়__ সবচাইতে প্রথম পোষ মেনেছিল যে প্রাণীটি _সেটি ছিল “কুকুর” ! … [ক্রমশঃ]