[মানব জীবনে_”আহার-নিদ্রা-মৈথুনঞ্চ-ভয়ম্ নিয়ে আলোচনায়_এখন ‘মৈথুন’ প্রসঙ্গ চলছে।]
গুরু মহারাজ স্বামী পরমানন্দ বলেছিলেন – মনুষ্য জীবনে ‘কাম’ রিপুকে বশ করার দুটো style রয়েছে, একটার উদাহরণ মদনভস্মকারী অর্থাৎ মদন-দমন শিব এবং অপরটি হলো মদনমোহন শ্রীকৃষ্ণ ! জ্ঞানী-যোগী-মুনি-ঋষিরা প্রথম style-কে গ্রহণ করে কামজয়ী হ’ন, আর ভক্তিকামী সাধকেরা শ্রীকৃষ্ণের style-কে অবলম্বন করার চেষ্টায় ব্রতী হ’ন ৷ তবে তন্ত্রের সাধকেরা বিশেষতঃ বীরাচারীরা (পশ্ব, বীর এবং দিব্য এই তিনপ্রকার মুখ্য আচার রয়েছে তন্ত্রে) বীরত্বের সঙ্গে গভীর নিশীথে উলঙ্গ ভৈরবীর সাথে রমণ-মুদ্রায় থেকেও সমস্ত রকম ভোগেচ্ছাকে প্রশমিত করে – নিম্নচেতনা থেকে উচ্চ-মানসলোকে অবস্থান করতে পারেন এবং সবচাইতে প্রবল রিপুকে জয় করে রিপুজয়ী হতে পারেন এবং সাধনপথের সবচাইতে প্রবল বাধাকে অতিক্রম করে তরতর করে পূর্ণত্বের দিকে এগিয়ে যান ।
মহাদেব শিবকে বলা হয় নটরাজ এবং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কে বলা হয় নটবর । ওই যে দুইপ্রকার style-এর কথা বলা হলো – এটাই দুটো পৃথক style ! নটরাজ ভঙ্গিমার নৃত্যের সাহায্যে জগতে যা কিছু ভোগ-ঐশ্বর্য্যের মোহ, কামনা-বাসনাদি রয়েছে সবই ধ্বংস করতে পারেন দেবাদিদেব শিব-শংকর, প্রকৃতপক্ষে সাধনার দ্বারা তৃতীয় নয়নের উন্মীলন অবস্থাই শিব অবস্থা ! এই তৃতীয় নয়ন থেকে উদ্গীরিত হুতাশনে মদন ভস্ম হয়ে যায় । এখানে কিন্তু গুরুমহারাজ এই ঘটনার ব্যাখ্যা হিসাবে বলেছিলেন – মদন ভস্ম হলো বটে কিন্তু মদন-বনিতা রতির প্রার্থনায় তাকে দেহহীন ভাবে শিব বাঁচিয়েও রাখলেন ! সেই জন্যই কামদেব মদনের আরেক নাম ‘অনঙ্গ’ ! অর্থাৎ অঙ্গ নাই কিন্তু existence রয়েছে, কার্যকারিতা রয়েছে !
প্রকৃতপক্ষে শরীরে কিন্তু ‘কাম’ কোথাও নাই – এর স্থান মনে । মন চঞ্চল হয় বলেই দেহের ইন্দ্রিয়াদিতে তার প্রভাব পরিলক্ষিত হয় ।
গুরুমহারাজ উদাহরণ হিসাবে বলেছিলেন – যৌবনকালে কোন নর এবং নারী কাছাকাছি এলে তাদের মধ্যে একটা কামভাব আসতে পারে কিন্তু ওই নর-নারী যদি পরস্পরে নিকটাত্মীয় হয় – তখন আর তাদের মধ্যে কোন negetive ভাব জাগে না । এর কারণ হচ্ছে – ওই দুই ব্যক্তির মনোজগতে ‘কাম’ কোন ক্রিয়া করে না । এছাড়াও গুরুমহারাজ উদাহরণ হিসাবে বলেছিলেন – কোন মানুষের চরম বিষাদের মুহূর্তে বা চরম শোকের মুহূর্তে যদি তাকে ( হয়তো তার অনেকদিনের প্রত্যাশিত কেউ)কোন বিপরীত লিঙ্গের কাছাকাছি এনে দেওয়া হয় – তাহলে দেখা যাবে ওই ব্যক্তির কোন আসক্তি তো জাগলই না বরং বিরক্তি উৎপাদিত হলো ! এইভাবেই গুরুমহারাজ আমাদের বুঝিয়েছিলেন যে, ‘কামরিপু’-র স্থান মনে – দেহে নয় !
বাউল সাধকেরা বৈষ্ণবীয়, শাক্ত ও বৌদ্ধ পরম্পরার সাধনাকে মিশ্রিত করে – তারা তাদের নিজের একটি নির্দিষ্ট পদ্ধতি তৈরি করে নিয়েছে ! এরা সহজপন্থী ! বৈষ্ণব সমাজে রয়েছে সহজিয়া বৈষ্ণব, বৌদ্ধদের একটা অংশ রয়েছে সহজযান –এইসব নামগুলি শুনেই বোঝা যায় যে, সহজপন্থী বাউলরাও এই তিন সম্প্রদায়ের সঙ্গে কোনো না কোনো ভাবে সম্পৃক্ত !
যাইহোক, আমাদের আলোচনা চলছিল ‘মৈথুন’ প্রসঙ্গে সেখান থেকে ‘রিপু’ কথাটি এসে গেল ৷ রিপু বা শত্রু ছয়টি ৷ কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ এবং মাৎসর্য । এগুলোকে শাস্ত্রে রিপু বলা হয়েছে, কারণ এরা মানবের সাধনায় বাধা দান করে ! সাধনা অর্থে চেতনার উৎকর্ষতা এবং আত্মিক উত্তরণ ঘটানোর যে অভ্যাস – তাই সাধনা । শাশ্ত্রমতে আদিম রিপু হোল কামরিপু!বৈষ্ণবীয় মতে যুগল-সাধনা হোল_ ষড়রিপুর মধ্যে আদিম ও সবচাইতে শক্তিশালী ঐ রিপুকে জয় করে মদনমোহন শ্রীকৃষ্ণ হয়ে ওঠার সাধনা এবং সঙ্গের সাধিকা সেই সাধনায় হয়ে ওঠে “প্রেমময়ী রাধা”! যুগল-সাধনকারী বৈষ্ণব-বৈষ্ণবী বা বাউল-বাউলিনী পরস্পর পরস্পরকে “কৃষ্ণ” বা “রাধা” হিসাবেই মান্যতা দান করে থাকে ৷ বৈষ্ণবী তার সঙ্গীকে “কৃষ্ণ” বলেই সম্বোধন করে এবং বৈষ্ণব তার সঙ্গিনীকে বলে “রাধা”।৷ ……. [ক্রমশঃ]