গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দ করেছিলেন – বৈদিক যুগে ঋষি-মুনি-বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণেরা প্রায় সকলেই বিবাহ করতেন, কিন্তু তাঁদের প্রত্যেকের জীবনেই সংযম বিদ্যমান ছিল । নারীশরীরের সম্ভোগের কোন বাসনাই তাদের ছিল না – “পুত্রর্থে ক্রিয়তে ভার্যা”– শুধুমাত্র বংশরক্ষার জন্য স্ত্রী গ্রহণ করা হতো । বৎসরান্তে একদিন স্ত্রীর ঋতুরক্ষা করতেন – এমন বহু তেজস্বী পুরুষ মানুষ সে যুগের সমাজে বাস করতো । “যোগী কথামৃত”-এর লেখক (যোগী শ্যামাচরণ লাহিড়ী পরম্পরার একজন বিখ্যাত যোগী)স্বামী যোগানন্দ পরমহংস – তাঁর পিতার সম্বন্ধে বলতে গিয়ে – এই রকমই উক্তি করেছিলেন ।
মুনি-ঋষিরা তো শুধুমাত্র সমাজের প্রয়োজনে সারা জীবনে একবার বা দু’বার হয়তো স্বস্ত্রীর সাথে বা অন্য কোন রমণীতে[বংশরক্ষার জন্য(ব্যাসদেব) অথবা সমাজে উন্নত কোনো মানব বা মানবী-কে জন্ম দেবার জন্য(পরাশর,জমদগ্নি) উপগত হয়েছিলেন – এমন রেকর্ডও ভারতীয় শাস্ত্রাদিতে উল্লেখ রয়েছে !
তবে সবার উপরে রয়েছেন এবং আমাদের হাতের কাছেই রয়েছেন – ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ! এযুগের যুগপুরুষ’ পরমপুরুষ শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ ! তিনি জগৎবাসীর কাছে প্রকাশ করলেন যথার্থ নারীর মহিমা ! নারী যে প্রকৃতপক্ষে মাতৃস্বরূপা – তাই তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন । শ্রী শ্রী চন্ডীর উল্লিখিত স্তোত্র – ” যা দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরূপেণ সংস্থিতাঃ”– এই স্তোত্রের সার্থক প্রমাণ দেখালেন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ! একদিন এক অর্বাচীন ভক্ত গুরুমহারাজকে জিজ্ঞাসা করেছিল – ” ঠাকুর নিজের স্ত্রীকে মাতৃজ্ঞানে পূজা করেছিলেন, এটা কি তার উচিত হয়েছিল ?” গুরুমহারাজ তার মুখের কথা শেষ না হতেই সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিয়েছিলেন – ” তুই ‘মা’-কে ‘মাগ’ ভাবিস, কারণ তুই অজ্ঞান, আর ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ছিলেন যথার্থ অধ্যাত্মবিজ্ঞানী তাই তিনি ‘মাগ’ কেও ‘মা’ হিসেবেই জানতেন ! তোরও যখন যথার্থ জ্ঞান হবে_ তখন তুই-ও বুঝতে পারবি “স্ত্রীয়াঃ সমস্তা সকলা জগৎসুঃ ৷”
গুরু মহারাজের সেদিনকার ঐরকম ঝাঁজিয়ে এবং একেবারে instantaneous উত্তর দেবার ভঙ্গিমা দেখে আমরা ওই সিটিংয়ে যারা উপস্থিত ছিলাম, তারা সত্যিই একেবারে ঘাবড়ে গিয়েছিলাম !
তারপরে অর্থাৎ সিটিং-এর শেষে আশ্রমের মাঠের প্রান্তে বটতলার ছায়ায় বসে যখন আমরা কয়েকজন মিলে গুরুমহারাজের বলা ঐ কথাগুলো নিয়ে পুনরায় আলোচনা করছিলাম, তখন ঠাকুরের_” ‘মাগ’-কে ‘মা’ ভাবার কথা”_ পর্যন্ত এসে আমাদের আর কারো মাথা কাজ করছিল না । শেষের সিদ্ধান্ত হয়েছিল – এটা ভগবানের পক্ষেই বলা সম্ভব বা কার্যকরী করা সম্ভব – সাধারণ জীবের পক্ষে এই ভাবনার চূড়ান্ত level-এ পৌঁছানো কখনোই সম্ভব নয় !
প্রকৃতপক্ষে কাম-কামনা ইত্যাদি পুরো ব্যাপারটাই ভাবনার উপর নির্ভর করে ৷ গুরুমহারাজ বলেছিলেন – এই যে প্রায়ই শোনা যায় বিভিন্নস্থানে কোন না কোন মহিলা raped হয়েছে – এগুলো কার্য-কারণ সূত্রে যেমন হয় তেমনি এগুলি অধিকতর ক্ষেত্রে তামসিক লোকেদের দ্বারাই সংঘটিত হয় ! রাজসিক ব্যক্তি ওখানে উপস্থিত থাকলে সে বাধা দেবে ! আর সে যদি কোনো নারীর প্রতি আকৃষ্ট হয় – তাহলে সরাসরি তাকে প্রস্তাব দেবে বা জোর করে তার ঘরে নিয়ে গিয়ে তুলবে ! সাত্ত্বিক ব্যক্তিরা ওই অবস্থায় পড়লে_কিছু নীতিবাক্য বলবে অথবা স্থান ত্যাগ করবে ! সামাজিক মর্যাদার ভয়, কুল বা বংশমর্যাদার ভয়, তার standard বা status হারানোর ভয় – ইত্যাদি ক্রিয়াশীল হওয়ায়, ঐরূপ ব্যক্তিরা সাধারণতঃ এই ধরনের কাজ থেকে সবসময়েই বিরত থাকে (ব্যতিক্রম থাকতেই পারে)। তবে ওই স্থানে যদি শুদ্ধসত্ত্ব ব্যক্তিরা থাকেন তাহলে তাঁরা ওই নারীকে মাতৃত্বের মর্যাদা দিয়ে তাকে রক্ষা করবেন । প্রয়োজনে নিজের জীবনের বা প্রাণের বিনিময়েও যে কোনো বিপন্ন নারীকে তারা উদ্ধার করবেন‌ই ৷
গুরুমহারাজ বলেছিলেন – পৃথিবীতে মানুষের দুটো জাতি রয়েছে_ পুরুষ এবং নারী । কিন্তু মানুষের প্রকৃতি ভিন্ন ভিন্ন হওয়ায় কখনোই সব পুরুষ মানুষ একই রকম হয় না, আবার সব নারীও কখনোই একই রকম হয় না । (নারী ও পুরুষের প্রকারভেদ পরের দিন)… [ক্রমশঃ]