গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দ বলেছিলেন – “রসো বৈ সঃ”(শ্রুতি) ; ‘সঃ’ বা তিনি অর্থে ব্রহ্ম‌। ব্রহ্মানন্দামৃতরূপ রস । আর এই রসের পিপাসা জীবের প্রাণে প্রাণে ! বাসনাবিদ্ধ হয়ে জীব যে রসের পিপাসায় ঘুরে মরছে – একমাত্র গোপীভাবের সাধনায় সেই রস-রতির জ্ঞান হয় । রাধার সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের যে ব্রজলীলা – তাই রস-সাধনা !
বৈষ্ণব মতে রয়েছে__ প্রকৃতপক্ষে রাধা-কৃষ্ণ আত্মাস্বরূপে প্রতি জীবের হৃদয়ে অধিষ্ঠিত রয়েছেন । ফলে নিজের মধ্যে রাধাকৃষ্ণতত্ত্বের বিকাশ ঘটাতে পারলেই পূর্ণ রস ও আনন্দের অধিকারী হওয়া যায় । কিন্তু বহির্জগতের কামরিপুর নাশ না হলে আত্মস্বরূপ প্রকাশিত হয় না । নারী-পুরুষের আসঙ্গলিপ্সাই ‘কাম’– এটিই আদিম রিপু, জীবকুল সহজে এর হাত থেকে নিস্তার লাভ করতে পারে না ! নারী ও পুরুষের পারস্পরিক মিলনেচ্ছা বা এই তীব্র আসঙ্গলিপ্সা-র কারণটাই বা কি ? এই কথার উত্তরে গুরুমহারাজ একবার বলেছিলেন – ” ভালো করে লক্ষ্য করে দেখবি, প্রতিটি পুরুষশরীর বা নারীশরীর যেন আধখানা ! প্রতিটা শরীরের পিছন দিকটা বদ্ধ আর সামনের দিকটা যেন উন্মুক্ত ! কিন্তু ঐ দুটি বিপরীত লিঙ্গের শরীর যদি সামনাসামনি মিলিত হয় – তাহলে যেন তা একটা closed circuit হয়ে যায় – একটা সম্পূর্ণতা পায় । প্রকৃতিতে রয়েছে রমণী-মায়ার মোহিনীশক্তি ; এই রমণীকে আত্মশক্তিতে মেশাতে পারলে – সেই শক্তি আত্মভূত হয় এবং তখনই জীব সম্পূর্ণ হয় ৷”
যুগল সাধনে (বৈষ্ণব মতে) কামবীজ, কামগায়ত্রী রাধাকৃষ্ণের যুগল মন্ত্র ! গুরুমহারাজ ‘বাউল কথা’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছিলেন – ” বৃন্দাবনে অপ্রাকৃত নবীন মদন, কামবীজ কামগায়ত্রী যাঁর উপাসন ৷৷” গুরুর কাছ থেকে কামবীজ, কামগায়ত্রী লাভ করে ভক্ত সাধক নিজেকে গোপী অর্থাৎ কৃষ্ণের সখীর ন্যায় বোধ করেন এবং সদাসর্বদা বাহ্যজগতে ও অন্তর্জগতে কৃষ্ণের সেবা করে যান । সখীভাবে রাধাকৃষ্ণের সেবাধিকার লাভই “সাধ্য-সাধন”। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার মিলনই – রাধাকৃষ্ণের যুগল মিলন !
আগেই বলা হয়েছিল – আত্মায় নারী-পুরুষের ভেদ হয় না । স্ত্রী ও পুরুষ চৈতন্যেরই প্রকাশ তবু স্থূলভাবে নারী-পুরুষের মধ্যে এরূপ প্রবল আকর্ষণই বা কেন ? এর কারণ হিসাবে বৈষ্ণবশাস্ত্র বলেছে – নরে চিৎশক্তির এবং নারীতে আনন্দশক্তির প্রকাশের আধিক্য থাকে । এইজন্যেই স্বাভাবিকভাবেই নর নারীর প্রতি বা নারী নরের প্রতি আকৃষ্ট হয় ! উদ্দেশ্য হলো – উভয়ে আত্মসংমিশ্রণ করে আপন আপন অভাব পূরণ করে পূর্ণত্ব লাভ করা!
বৈষ্ণবশাস্ত্রে পরকীয়াকে এত প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে কেন ? – এর উত্তরে বলা হয়েছে – আপন বিবাহিত স্ত্রী-কে রাধাজ্ঞান করেও এই সাধনা করা যায় কিন্তু এই স্বকীয়া রমণীর উচ্চ-নীচ জ্ঞান থাকে এবং পারিবারিক, সামাজিক নানান অপেক্ষা থাকে – কিন্তু সমাজবিরুদ্ধ বলে পরকীয়া নারীতে প্রেমের উদ্দাম-উচ্ছ্বাস প্রবল হয় এবং লোকলজ্জা, ভয়-ঘৃণা, বেদ-বিধি কিছুরই বালাই থাকে না । কিন্তু এই পরকীয়া যে কোন রমণীর সাথে যেন না হয় – সে ব্যাপারে বৈষ্ণবশাস্ত্রে সাধককে চরমভাবে সতর্ক করা হয়েছে – ” ব্যভিচারী নারী না হয় কান্ডারী / নায়িকা বাছিয়া লবে । / তার আবছায়া পরশ করিলে / পুরুষ-ধরম যাবে ।৷”
গুরুমহারাজ বলেছিলেন – যুগল সাধনায় স্ব-দারায় সিদ্ধ সাধক ছিলেন, জয়দেব-পদ্মাবতী এবং পরকীয়ায় সিদ্ধ ছিলেন চন্ডীদাস-রজকিনী এবং বিল্বমঙ্গল-চিন্তামণি ! চন্ডীদাস তাঁর কাব্যে লিখেছেন – ” বাশুলী কহিছে কহিব কি, মরিয়া হইবে রজক ঝি । / পুরুষ ছাড়িয়া প্রকৃতি হবে, এক দেহ হয়ে নিত্যেতে যাবে ৷”
সাধারণ মানুষের যে ইন্দ্রিয়চরিতার্থতা বা আসঙ্গলিপ্সা – তাতে পুরুষের সর্বনাশ হয় – তার বাহ্যিক এবং আধ্যাত্মিক শ্রী নষ্ট হয়ে যায়, দেহ-মন ধীরে ধীরে অকর্মণ্য হয়ে পড়ে । এই ধরনের শরীরকেই স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন – “বজ্রাহত বৃক্ষ”! অপরপক্ষে প্রেম সাধনায় যাঁর কাম ভস্মীভূত হয়েছে – সেইরূপ ভক্ত যথেচ্ছভাবে শৃঙ্গারাদি দ্বারাও তার সাথীর সেবা করতে পারেন । সাধন বলে শুক্রের অধঃস্রোত রুদ্ধ হাওয়ায় এই যুগল সাধকেরা রতি রসে মত্ত হলেও ক্ষতির কোনো কারণ থাকে না বরং তা সাধনায় রূপ নেয় ! … [ক্রমশঃ]