গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দ নারী-পুরুষের মিলন এবং এখান থেকে যুগল-সাধনা নিয়ে যে সমস্ত আলোচনা করেছিলেন সেগুলি এখানে বলা হচ্ছে । এছাড়া স্বামী নিগমানন্দ সরস্বতীও যুগল-সাধনা বা শৃঙ্গার-সাধনা নিয়ে অনেক কথাই বলে গেছেন – তাই প্রাসঙ্গিক হিসাবে স্বামী নিগমানন্দের কিছু কিছু বিশ্লেষণও এখানে মাঝে মাঝেই যোগ করা হচ্ছে !
গুরুমহারাজ বলেছিলেন – যৌবনে নর-নারীর আকর্ষণ সবচাইতে প্রবল ! ধনলাভ, শক্তিলাভ – এগুলিও যৌবনের ধর্মের মধ্যেই পড়ে – কিন্তু যৌবন কালে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ সবচাইতে প্রবল থাকে ৷ ধনলাভ বা শক্তিলাভ হোলে এই আকর্ষণ বরং আরো বেড়ে যায় এবং সেখান থেকেই সমাজে নানারকম বিকৃতি দেখা যায় । যৌন বিকৃতির মধ্যে অন্যতম একটি সমকামিতা (এটি কখনোই স্বাভাবিক নয়)। যার সৃষ্টি হয়েছিল মধ্যযুগে ! কারাগার, সেনা ব্যারাক, হারেম – ইত্যাদি স্থান থেকে এইগুলির সৃষ্টি হয়েছিল – পরে তা practice-এ আসে বা কোন কোন মানবের সংস্কারে পরিণত হয়েছে ! অন্য আর একটি যৌন-বিকৃতির রূপ হলো নারী-নির্যাতন ৷ পুরুষের দেহের শক্তি রয়েছে, কিন্তু যৌনশক্তিতে নারীর কাছে সে প্রাকৃতিক ভাবে দুর্বল – এই দুর্বলতা কাটাতেই তামসিক প্রকৃতির পুরুষেরা যুগে যুগে নারীদের উপর নানারকম নির্যাতন কোরে, তার দুর্বলতা ঢাকার প্রচেষ্টা করেছে ৷ এইভাবেই সমাজে অনেক নারীরা আজো পুরুষের বিকৃতির শিকার হয়ে চলেছে ।
গুরুমহারাজ বলেছিলেন – মানুষ যদি আগে যোগ শিখে ভোগে প্রবৃত্ত হোতো – তাহলে ‘একজন পুরুষ’, ‘একজন নারী’-র দ্বারাই চরম তৃপ্তিলাভ কোরতো, উল্টো দিক থেকে বলতে গেলে ‘একজন নারী’-র ক্ষেত্রেও সারাজীবন ধরে তার জন্য উপযুক্ত ‘একটি পুরুষ’-ই যথেষ্ট বলে বিবেচিত হোত । এর ফলে মানবসমাজে কোনো পুরুষ বা কোনো নারী কখনোই ব্যভিচারী বা ব্যভিচারিনী হতো না বা হওয়ার কোনো প্রয়োজনই অনুভব কোরতো না ! বৈষ্ণবীয় যুগল-সাধনার অন্যতম উদ্দেশ্য এটাই ।
মনুষ্য সমাজে যত নারী-পুরুষ__ স্বামী-স্ত্রী হিসাবে বা life-partner হিসাবে জীবন কাটাচ্ছে – এগুলি সবই কিন্তু একটা পরিণতির দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য ! প্রতিটি পুরুষ তার স্ত্রীর মধ্যে রাধাকে (কৃষ্ণ style) অথবা মা জগদম্বাকে (শিব style) আবিষ্কার করতে চাইছে – কিন্তু পারছে না !তাই সমগ্র মানব সমাজে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে রয়েছে অপূর্ণতা, অপ্রাপ্তি, অসন্তুষ্টির জ্বালা, বেদনা ! এই জ্বালা বা বেদনা কোথাও ব্যক্ত, কোথাও হয়তো অব্যক্ত ! কিন্তু রয়েছে ! প্রতিটি নর বা নারী মনের কোণে, হৃদয়ের একান্ত গভীরে কোথায় যেন একটা অতৃপ্তি – তাকে সারাজীবন তাড়া করে ফেরে ! সে হাসি দিয়ে, কথার মালা গেঁথে, কর্মের দোহাই দিয়ে, গুরু মহারাজের কথায় “adjust”-কোরে – এক ছাদের তলায়, একটা ঘরে, হয়তো এক‌ই বিছানায় শুয়ে জীবনটা ঠিকই কাটিয়ে দেয় ! কিন্তু কখনো কখনো একান্তে বসে, তার অন্তরের অন্তঃস্থলের মুচড়ে ওঠা হৃদয়ের ব্যথায় ব্যথাতুর হয়ে, নিজের অজান্তেই কখন যেন একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অথবা দুফোঁটা চোখের জলও ফেলে ! নিজের অজান্তেই কোনো একটা করুন-সুরের সংগীতের মূর্ছনায় হৃদয়ের বেদনা কথায় রূপ পায়।
এই অপূর্ণতা, এই অতৃপ্তি-ই মানুষকে এক জন্ম থেকে অন্য জন্মান্তরে নিয়ে যায় ৷ আবার বড় হওয়া – আবার বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া – আবার নারীতে রাধা অথবা ৺রী মা খোঁজা অথবা পুরুষের মধ্যে শ্রীকৃষ্ণ বা শংকরকে খোঁজা শুরু হয় । এই যাত্রার শেষ হয় বৈষ্ণব বা বাউলমতে যুগল-সাধনায়।
তাছাড়া বেদান্তমতে (ভগবান বুদ্ধ, আচার্য শঙ্কর ইত্যাদি পরম্পরা) রয়েছে – নিজের মধ্যেই নারীকে (আর নারী হলে পুরুষকে) জাগ্রত করে অর্ধনারীশ্বর হয়ে ওঠা !গুরুমহারাজ এটাকে বলেছিলেন বাউলের ‘নারী বর্জিত সাধন’। ‘বাউল’ মানে কোন বিশেষ সম্প্রদায় নয় । ‘বাউল’ প্রকৃত অর্থ ‘ব্রহ্মজ্ঞ’ ! চৈতন্যচরিতামৃতে কৃষ্ণদাস কবিরাজ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুকে “মহাবাউল” বলে উল্লেখ করেছিলেন ।
সাধারণভাবে স্বামী-স্ত্রীর যে জীবন-যাপন – তা অতৃপ্তি, অপ্রাপ্তিজনিত কারণে অসম্পূর্ণ ! এইজন্যেই বারবার শরীর ধারণ করে স্বামী-স্ত্রীর role play করে যেতে হয়, যতদিন না কোন নারী-পুরুষ যুগল-সাধনার দ্বারা ‘রাধাকৃষ্ণ তত্ত্ব’ সিদ্ধ হয় । … [ক্রমশঃ]