গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের নারী-পুরুষের সম্পর্ক সংক্রান্ত আলোচনাগুলির কথা _এখানে পরিবেশন করা হচ্ছিল । গুরুমহারাজ “বাউলের মর্মকথা” গ্রন্থে বাউলের সাধন নিয়ে লিখেছিলেন – ” জননী মন্দিরে প্রবেশি দেখিনু কহিতে না মানে বাধা,/ শ্যামা হলো শ্যাম – চরণের শিব হইয়া উঠিল রাধা ।” জননী কি করে প্রেমময়ী হয়ে ওঠে অথবা সাধনসঙ্গিনী, সহধর্মিনী কি করে জননী হয়ে ওঠে – তাই বাউল-বৈষ্ণবের যুগল-সাধনার মূল রহস্য !
বৈষ্ণবীয় প্রেমসাধনায় মাতৃরূপিণী গুরু-ই হাতে ধরে শিষ্যকে প্রেম-সাধনা শেখায় এবং ধীরে ধীরে তিনিই শিষ্যের প্রেমময়ী হয়ে ওঠেন ৷ এইভাবে মাতৃরূপিণী গুরু হয় সাধনসঙ্গিনী সাক্ষাৎ প্রেমস্বরূপা ! আবার যুগল সাধনায় সাধনসঙ্গিনী-ই সাধককে সাধনার শীর্ষশিখরে পৌঁছে দেন, শৃঙ্গাররস থেকে তাকে পরমানন্দ রসের সাগরে নিমজ্জিত করে দেন – সাধকের পরিপূর্ণতা দান করেন ! এই ভাবেই ডিম ফুটে যেমন বাচ্চা প্রসব হয়, তেমনি সাধনসঙ্গিনী সাধককে অজ্ঞান-অন্ধকার থেকে, মায়া-মোহের আবর্ত থেকে উদ্ধার করে জ্ঞানালোকের জ্যোতিঃসমুদ্রে, অমৃতলোকের চিরশান্তির পাথারে পৌঁছে দেন । তখন সেই সাধক হয়ে ওঠেন এক নতুন মানুষ ! তিনি হয়ে ওঠেন ‘সোনার মানুষ’ ! এইভাবে সাধনসঙ্গিনী সাধকের নতুন জন্ম দিয়ে হয়ে ওঠেন জননী স্বরূপা ! প্রকৃতপক্ষে জননী হয়ে ওঠাই_ নারী-স্বরূপের প্রকৃত প্রকাশ !
তন্ত্র সাধনাতেও চক্রসাধনা রয়েছে, যেখানে একজন ভৈরবীর উপস্থিতিতে বেশ কয়েকজন তন্ত্রসাধক সাধন করেন এবং ঐ একজন ভৈরবী পারেন অনেক সাধককে সাধনার শীর্ষ শিখরে পৌঁছে দিতে – সেখানেও সাধনসঙ্গিনী সাধককে পূর্ণতা দান করে হয়ে ওঠেন জননী ! কিন্তু ‘শ্যামা’ কি করে ‘শ্যাম’ হয়ে ওঠেন বা “চরণের শিব” কোন সাধনে “রাধা” হয়ে ওঠেন – সেই তত্ত্বে যেতে হলে বুঝতে হবে সাধনার ক্রম । সাধনার ক্রমে প্রথমে তন্ত্র সাধনা এবং তন্ত্র সাধনায় সিদ্ধ হোলে _তারপর বৈষ্ণবমতে সাধন বা ‘প্রেম সাধন’ ! শাক্তমতে সাধনা কোরে সিদ্ধ হোতে না পারলে কখনই প্রেম-সাধনায় প্রবেশাধিকার লাভ হয় না ৷ এইজন্যেই বৈষ্ণবশাস্ত্রে বলা হয়েছে – ” রাসমঞ্চে প্রবেশের অধিকার সবার নাই ! সেখানে শুধু প্রেমময়ী রাধা আর গোপীদের অনুমতি রয়েছে ৷” বাউল বৈষ্ণব মতে রয়েছে ‘বিন্দু সাধন’ ! বিন্দু টললেই সিন্ধু টলে যায় ! তাই যার বিন্দু অটল হয়েছে – তিনিই সিদ্ধ, তিনিই প্রকৃত শাক্ত ! বিন্দু সাধনে সিদ্ধ (যার শুক্রের নিম্নধারার পথ সম্পূর্ণরূপে রুদ্ধ হয়ে তা ঊর্ধ্বগতি লাভ করেছে এবং ওজঃশক্তিতে পরিণত হয়েছে) সাধক-ই বৈষ্ণব-সাধনায় (প্রেম-সাধনা, যুগল-সাধনা, কিশোরী-সাধনা ইত্যাদি) ব্রতী হবার যোগ্যতা লাভ করতে পারেন ।
সমাজে বৈষ্ণব এবং শাক্তদের মধ্যে যে প্রচলিত বিরোধ রয়েছে – তা অজ্ঞতাপ্রসূত ৷ বৈষ্ণব হোতে গেলে আগে শাক্ত হোতেই হবে – না হলে শুধু তিলক কাটা, চৈতন্ রাখা, মালা জপাই সার হবে – কাজের কাজ কিছুই হবে না ! আগে বীর পরে ধীর ! গুরুমহারাজ একটি বাক্যে বলে দিয়েছিলেন – ” ধ্যানে ভর করুক জ্ঞান এবং জ্ঞানের সিংহাসনে বিরাজ করুক প্রেম !” সুতরাং প্রেমলাভ একেবারে শেষের অবস্থা ! বিন্দু অটল না কোরে যুগল-সাধনা কোরতে গেলে সাধক-সাধিকা উভয়েরই চরম অধোগতি হয় – আর এই রূপটাই আমরা সমাজে দেখতে পাই ! ভেকধারী, মালা-তিলকধারী, মুণ্ডিত-মস্তক বা চৈতনধারী বৈষ্ণব-বৈষ্ণবীতে ছেয়ে গেছে সমাজ ! কিন্তু কজন আর রসিকশেখর শ্রীকৃষ্ণ হয়ে উঠছে অথবা কজন হচ্ছে প্রেমময়ী রাধা ! যদি কোথাও এমনটা হয় – তাহলে সেই বিশেষ সাধক-যুগলকে দেখলেই চেনা যাবে । মহাজনগণ সংগীতের মাধ্যমে বুঝিয়েছেন –
” কৃষ্ণ প্রেম যার অন্তরে জেগেছে_ নয়ন দেখিলে যার জানা ৷/ পাখিধরা আঁখিদ্বয় সমর্থা ভাবময় / জগত-ছাড়া চোখের চাহনি ৷” এমন “সমর্থা ভাবময়”, “জগত-ছাড়া চোখের চাহনি”-ওয়ালা মানুষ হলেন ‘সহজ’ মানুষ ! সাধনার শীর্ষে পৌঁছে এঁনারা হয়ে ওঠেন ‘সোনার মানুষ’ ! আর শুধু ‘সোনার মানুষ’-ই নয় – এঁনারা যে যুগে যখন, যেখানে শরীর ধারণ করেন, তখন তিনি সেই যুগের আপামর মানুষ-জনকে অকাতরে প্রেম-ভক্তি দান কোরে হয়ে ওঠেন তাদের সবার ”মনের মানুষ”। … [ক্রমশঃ]
বৈষ্ণবীয় প্রেমসাধনায় মাতৃরূপিণী গুরু-ই হাতে ধরে শিষ্যকে প্রেম-সাধনা শেখায় এবং ধীরে ধীরে তিনিই শিষ্যের প্রেমময়ী হয়ে ওঠেন ৷ এইভাবে মাতৃরূপিণী গুরু হয় সাধনসঙ্গিনী সাক্ষাৎ প্রেমস্বরূপা ! আবার যুগল সাধনায় সাধনসঙ্গিনী-ই সাধককে সাধনার শীর্ষশিখরে পৌঁছে দেন, শৃঙ্গাররস থেকে তাকে পরমানন্দ রসের সাগরে নিমজ্জিত করে দেন – সাধকের পরিপূর্ণতা দান করেন ! এই ভাবেই ডিম ফুটে যেমন বাচ্চা প্রসব হয়, তেমনি সাধনসঙ্গিনী সাধককে অজ্ঞান-অন্ধকার থেকে, মায়া-মোহের আবর্ত থেকে উদ্ধার করে জ্ঞানালোকের জ্যোতিঃসমুদ্রে, অমৃতলোকের চিরশান্তির পাথারে পৌঁছে দেন । তখন সেই সাধক হয়ে ওঠেন এক নতুন মানুষ ! তিনি হয়ে ওঠেন ‘সোনার মানুষ’ ! এইভাবে সাধনসঙ্গিনী সাধকের নতুন জন্ম দিয়ে হয়ে ওঠেন জননী স্বরূপা ! প্রকৃতপক্ষে জননী হয়ে ওঠাই_ নারী-স্বরূপের প্রকৃত প্রকাশ !
তন্ত্র সাধনাতেও চক্রসাধনা রয়েছে, যেখানে একজন ভৈরবীর উপস্থিতিতে বেশ কয়েকজন তন্ত্রসাধক সাধন করেন এবং ঐ একজন ভৈরবী পারেন অনেক সাধককে সাধনার শীর্ষ শিখরে পৌঁছে দিতে – সেখানেও সাধনসঙ্গিনী সাধককে পূর্ণতা দান করে হয়ে ওঠেন জননী ! কিন্তু ‘শ্যামা’ কি করে ‘শ্যাম’ হয়ে ওঠেন বা “চরণের শিব” কোন সাধনে “রাধা” হয়ে ওঠেন – সেই তত্ত্বে যেতে হলে বুঝতে হবে সাধনার ক্রম । সাধনার ক্রমে প্রথমে তন্ত্র সাধনা এবং তন্ত্র সাধনায় সিদ্ধ হোলে _তারপর বৈষ্ণবমতে সাধন বা ‘প্রেম সাধন’ ! শাক্তমতে সাধনা কোরে সিদ্ধ হোতে না পারলে কখনই প্রেম-সাধনায় প্রবেশাধিকার লাভ হয় না ৷ এইজন্যেই বৈষ্ণবশাস্ত্রে বলা হয়েছে – ” রাসমঞ্চে প্রবেশের অধিকার সবার নাই ! সেখানে শুধু প্রেমময়ী রাধা আর গোপীদের অনুমতি রয়েছে ৷” বাউল বৈষ্ণব মতে রয়েছে ‘বিন্দু সাধন’ ! বিন্দু টললেই সিন্ধু টলে যায় ! তাই যার বিন্দু অটল হয়েছে – তিনিই সিদ্ধ, তিনিই প্রকৃত শাক্ত ! বিন্দু সাধনে সিদ্ধ (যার শুক্রের নিম্নধারার পথ সম্পূর্ণরূপে রুদ্ধ হয়ে তা ঊর্ধ্বগতি লাভ করেছে এবং ওজঃশক্তিতে পরিণত হয়েছে) সাধক-ই বৈষ্ণব-সাধনায় (প্রেম-সাধনা, যুগল-সাধনা, কিশোরী-সাধনা ইত্যাদি) ব্রতী হবার যোগ্যতা লাভ করতে পারেন ।
সমাজে বৈষ্ণব এবং শাক্তদের মধ্যে যে প্রচলিত বিরোধ রয়েছে – তা অজ্ঞতাপ্রসূত ৷ বৈষ্ণব হোতে গেলে আগে শাক্ত হোতেই হবে – না হলে শুধু তিলক কাটা, চৈতন্ রাখা, মালা জপাই সার হবে – কাজের কাজ কিছুই হবে না ! আগে বীর পরে ধীর ! গুরুমহারাজ একটি বাক্যে বলে দিয়েছিলেন – ” ধ্যানে ভর করুক জ্ঞান এবং জ্ঞানের সিংহাসনে বিরাজ করুক প্রেম !” সুতরাং প্রেমলাভ একেবারে শেষের অবস্থা ! বিন্দু অটল না কোরে যুগল-সাধনা কোরতে গেলে সাধক-সাধিকা উভয়েরই চরম অধোগতি হয় – আর এই রূপটাই আমরা সমাজে দেখতে পাই ! ভেকধারী, মালা-তিলকধারী, মুণ্ডিত-মস্তক বা চৈতনধারী বৈষ্ণব-বৈষ্ণবীতে ছেয়ে গেছে সমাজ ! কিন্তু কজন আর রসিকশেখর শ্রীকৃষ্ণ হয়ে উঠছে অথবা কজন হচ্ছে প্রেমময়ী রাধা ! যদি কোথাও এমনটা হয় – তাহলে সেই বিশেষ সাধক-যুগলকে দেখলেই চেনা যাবে । মহাজনগণ সংগীতের মাধ্যমে বুঝিয়েছেন –
” কৃষ্ণ প্রেম যার অন্তরে জেগেছে_ নয়ন দেখিলে যার জানা ৷/ পাখিধরা আঁখিদ্বয় সমর্থা ভাবময় / জগত-ছাড়া চোখের চাহনি ৷” এমন “সমর্থা ভাবময়”, “জগত-ছাড়া চোখের চাহনি”-ওয়ালা মানুষ হলেন ‘সহজ’ মানুষ ! সাধনার শীর্ষে পৌঁছে এঁনারা হয়ে ওঠেন ‘সোনার মানুষ’ ! আর শুধু ‘সোনার মানুষ’-ই নয় – এঁনারা যে যুগে যখন, যেখানে শরীর ধারণ করেন, তখন তিনি সেই যুগের আপামর মানুষ-জনকে অকাতরে প্রেম-ভক্তি দান কোরে হয়ে ওঠেন তাদের সবার ”মনের মানুষ”। … [ক্রমশঃ]