গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দ, বনগ্রাম পরমানন্দ মিশনে বা অন্যত্র “নারী পুরুষের সম্পর্ক”, “শৃঙ্গার সাধন”- ইত্যাদি বিষয়ক বিভিন্ন বিষয়ে যে সমস্ত আলোচনা করেছিলেন, সেগুলিকেই এক জায়গা করে এখানে পরিবেশন করা হচ্ছিল । গুরুমহারাজ বলেছিলেন – “এই পৃথিবীতে জড়-চেতন যা কিছু রয়েছে, সে সবকিছুই প্রাকৃতিক নিয়মের অধীন অর্থাৎ এককথায় প্রকৃতির অধীন।” সেই হিসাবে জীবশরীরধারী সকলেই – তাতে তিনি কোন মহাপুরুষ, মহাত্মা বা অবতারপুরুষ হোলেও__ তাঁকে শরীর ধারণ করে মহাপ্রকৃতির অধীনেই থাকতে হয় ! আর যৌবনে কাম রিপুর প্রভাবও যেহেতু natural, তাই সেটাতে তাঁদের‌ও প্রভাব পড়ে ! কিন্তু সাধারণ জীবের সঙ্গে তাঁদের পার্থক্য এই যে, তাঁরা খুব দ্রুত প্রকৃতির এই বাঁধন কাটিয়ে, সমস্ত রকম অধীনতা থেকে মুক্ত হয়ে_অচিরেই সম্পূর্ণরূপে স্বাধীন হয়ে ওঠেন । অপরপক্ষে, সাধারণ জীব মায়া-মোহের বাঁধনে আটকে পড়ে এবং ষড়রিপুর তাড়ণায় জ্বলে পুড়ে মরে।
যেহেতু স্বাধীনতাই জীবের অন্তিম লক্ষ্য, যে স্বাধীনতা প্রাপ্ত হবার জন্য__ চলে জীবের লক্ষ লক্ষ জন্ম-জন্মান্তরের পরিক্রমা, সেই স্বাধীনতা মহাপুরুষেরা প্রথম জীবনের সাধনার দ্বারা অল্পায়াসে বা অনায়াসে লাভ করেন ! আর অবতার পুরুষেরা যখন যখন পৃথিবীর মানুষদেরকে মোহগর্ত থেকে, প্রকৃতির অধীনতা থেকে মুক্ত করার জন্য শরীর ধারণ করেন – তখন তাঁরাও প্রকৃতির অধীনতা ইচ্ছা করেই স্বীকার করে নেন ! কিন্তু আবার প্রয়োজনে মাঝেমাঝেই সকল অধীনতার পারেও চলে যান – অর্থাৎ তাঁরা যেন ‘অধীনতা’ এবং ‘স্বাধীনতা’- এই দুটোরই ঊর্ধ্বে !
উপক্রমণিকায় এই আলোচনাগুলি কেনো করলাম – তার কারণটা এখন বলি ! বহু পূর্ব পূর্ব মহাপুরুষদের (শ্রীচৈতন্য বা তাঁর পূর্ববর্তী) জীবনের সমস্ত ঘটনা সম্বন্ধে আমাদের অতটা জানা নাই, কিন্তু আধুনিক মহাপুরুষদের অনেক কথাই লিপিবদ্ধ হয়েছে — তাই সেগুলি আমাদের অনেকটাই জানা ! আর সেখান থেকেই আমরা দেখতে পাই যে, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ, স্বামী বিবেকানন্দ, লোকনাথ বাবা প্রমুখরাও তাঁদের জীবনে প্রকৃতির প্রভাবকে অস্বীকার করেন নি । ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের শরীরে যখন কাম রিপুর প্রাবল্য দেখা দিয়েছিল – তখন উনি মাটিতে মুখ ঘষে ঘষে, মুখে রক্ত বের করে ৺রী মা জগদম্বার কাছে প্রার্থনা করে, এটা থেকে মুক্ত হয়েছিলেন – এমনটাই ঠাকুর পরবর্তীকালে ভক্তদের কাছে বর্ণনা করেছিলেন ৷ স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা বোঝাতে গিয়ে বলেছিলেন – তাঁর শরীরে একবার যখন এই রিপুর প্রবল বেগে এসে গেছিল – তিনি তখন কোন কিছু চিন্তা না করেই জ্বলন্ত কয়লার আঁচে গিয়ে বসে পড়েছিলেন ! এতে তাঁর শরীরের কিছু অংশ নিশ্চয়ই পুড়ে গেছিল বা ফোস্কা পড়েছিল – কিন্তু শরীরে বা মনে ওই বিশেষ রিপুর প্রভাব আর সহজে পড়তে পারে নি ।
সাক্ষাৎ শিবস্বরূপ লোকনাথ বাবার জীবনেও পড়েছিল এই রিপুর প্রভাব ! ওনার গুরুদেব স্বয়ং উপস্থিত থেকে যুবককে শিষ্যকে allow করেছিলেন প্রায় এক বৎসরকাল এই রিপুর প্রভাবে রত থাকতে ! এই উদাহরণগুলি এখানে তুলে ধরা হোল এইজন্য যে, তাহলে দেখা যাচ্ছে – কাম-রিপুর প্রভাবে প্রভাবান্বিত হওয়াটাই স্বাভাবিক । এইসমস্ত মহাত্মা-মহাপুরুষরা নিজের শরীরে এগুলির প্রকাশ ঘটিয়ে উত্তরকালের মানুষদের জন্য, সাধকদের জন্য একটা রক্ষাকবচ রেখে গেলেন । আজও কোন সাধক, কোন ব্রহ্মচারী বা সন্ন্যাসীর জীবনে যদি কোন সময় কাম-রিপুর প্রাবল্য দেখা দেয় – তাহলে যেন তারা ভেঙে না পড়ে, আত্মগ্লানিতে না ভোগে !
‘জীবসকল প্রকৃতির অধীন’__ একথা ঠিকই, কিন্তু প্রকৃতির অধীনতা কাটিয়ে স্বাধীন হয়ে ওঠাই মানব জীবনের একমাত্র লক্ষ্য ! গুরুমহারাজ বলেছিলেন – need of life , necessity of life এবং purpose of life ! এই purpose of life -ই হলো জীবের সম্পূর্ণরূপে স্বাধীন হয়ে ওঠা ! নিত্যমুক্ত-শাশ্বত-সনাতন ব্রহ্মস্বরূপ হয়ে ওঠা বা আত্মস্বরূপ হয়ে ওঠাতেই জীবের পরিপূর্ণতা ! আর এই লক্ষ্যে সকল জীবকেই একদিন না একদিন পৌঁছাতেই হবে ৷ তা আজই হোক অথবা কাল । …[ক্রমশঃ]