গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের বলা কথা নিয়েই এখানে আলোচনা করা হচ্ছিল ৷ আমরা ‘সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ’-এ কথা শুরু করেছিলাম “ভয়” নিয়ে ! সেখান থেকে “আহার-নিদ্রা-মৈথুনঞ্চ-ভয়ম্” – এই শাস্ত্রীয় শ্লোকটির শব্দগুলির ব্যাখ্যা করতে করতে আমরা অনেক দূরে চলে এসেছি ! “মৈথুন” প্রসঙ্গে আলোচনায় আমরা নারী-পুরুষের সম্পর্ক এবং যুগল সাধনার কথা এবং শরীরে বা মনে কাম-রিপুর প্রভাব এবং সেখান থেকে মুক্তির নানা উপায় নিয়েও আলোচনা করেছি ! এবার শুরু হোক “ভয়” প্রসঙ্গ !
গুরু মহারাজ বলেছিলেন – “সমস্ত ভয়ের উৎস মৃত্যুভয়” ! খুব নিম্নতর প্রাণী, উদ্ভিদ ইত্যাদি থেকে শুরু করে উচ্চতর প্রাণী পর্যন্ত সকলের ক্ষেত্রেই এই নিয়ম খাটে – “জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কথা হবে।” শ্রীমদ্ভগবদগীতাতেও ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন – ” জাতস্য হি ধ্রুবং মৃত্যু – ধ্রুবং জন্ম মৃতস্য চ ।” জীবিত প্রাণী মাত্রের মৃত্যু হবেই ৷ আর মৃত্যু থাকলে মৃত্যুভয়ও থাকবেই । এইজন্যেই বলা হয়েছে যে, জীবের চারটি স্বাভাবিক ধর্মের মধ্যে “ভয়” অন্যতম । যে কোন প্রাণীর ক্ষেত্রেই দেখা যায় শিশু অবস্থায় “ভয়” -ব্যাপারটা অনেক কম থাকে – কারণ হিসেবে বলা যায় জাগতিক অভিজ্ঞতা, বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ এগুলি যতক্ষণ না পুষ্ট হচ্ছে ততক্ষণ জীবের শরীরে বা মনে শুধু ভয় কেন – অনেক কিছুই তথা জৈবিক ক্রিয়া বা গুণের প্রকাশ ঘটে না ৷ সাধারণত পূর্ণ বয়স্ক হবার পরই জীবের শরীরে বা মনোজগতে এই সবকিছুই প্রকটিত হয় ৷ তবে যে সমস্ত জীবে মনের ক্রিয়া নাই, অর্থাৎ বেদোক্ত পঞ্চকোষের (অন্নময়, প্রাণময়, মনোময়, বিজ্ঞানময় ও আনন্দময় কোষ) মধ্যে যে জীবের মধ্যে মনোময় কোষের ক্রিয়ার প্রকাশ থাকে না – সেখানে ভয়েরও প্রকাশ কম থাকে – কিন্তু তবুও থাকে ! কারণ ওই যে বলা হলো – যেখানে মৃত্যু রয়েছে সেখানে মৃত্যুভয়ও রয়েছে !
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন – ” লজ্জা-ঘৃণা-ভয়, তিন থাকতে নয় ৷” ঠাকুর এখানে এই তিনটিকে সাধন পথের বাধাস্বরূপ হিসাবে উল্লেখ করেছেন । সাধন পথের বাধাস্বরূপ ‘অষ্টপাশ’-এর কথা বলা হয়েছে । এই অষ্টপাশ (কুল, শীল, মান, লজ্জা, .. ইত্যাদি)-কে জয় করা বা বশ মানানোই সাধনা ! ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ছিলেন যুগপুরুষ – যুগপুরুষ হলেন তিনি, যিনি সবকিছুকেই যুগোপযোগী করে, সেই যুগের গ্রহণযোগ্য করে, সেই কালের মানুষের কাছে সহজলভ্য করে দিয়ে যান । সুতরাং ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ তাই অতকিছুতে না গিয়ে শুধু তিনটে জিনিসকে জয় করতে বললেন – ” লজ্জা-ঘৃণা-ভয়, তিন থাকতে নয় ৷”
আমাদের এখনকার আলোচনার বিষয় হোল “ভয়”, তাই আমরা শুধু এইটা নিয়েই কথা বলব । গুরু মহারাজ বলেছিলেন – অতিরিক্ত আনন্দে, অতিরিক্ত দুঃখে, অতিরিক্ত ভয়ে-ও মানুষের কুলকুণ্ডলিনী জাগ্রত হয়ে যেতে পারে । গুরুমহারাজ নিজের জীবনের একটা ঘটনা বলে এই ব্যাপারটা আমাদের বুঝিয়েছিলেন ৷ খুব ছোটবেলায় উনি গভীর রাত্রে ওনার জন্মভূমির বাড়ি কৃষ্ণদেবপুর (কালনার সন্নিকট) বাঘনাপাড়া স্টেশনের কাছে যে একটি কালভার্ট ছিল – সেইখানে উনি প্রায়ই একা একা বসে থাকতেন ৷ তখনকার দিনে সন্ধ্যার পর আর কোন ট্রেন চলতো না – তাই ওই স্থান একেবারে নির্জন থাকতো !
কিন্তু সেদিন রাত্রি ১২টা/১টার পর উনি একটা “গোঁ-ও-ও-ও-ও” এমনি একটা তীব্র আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলেন এবং যেটা তীব্রবেগে রেললাইন বরাবর ছুটে তাঁর নিকটবর্তী হচ্ছিল ! বালক গুরুজী অকস্মাৎ এমন অভূতপূর্ব ঘটনায় খুবই কৌতুহলী এবং উৎকর্ণ হয়েছিলেন ! কিন্তু সেই বিকট শব্দের উৎস যখন তাঁর কাছে গিয়ে pass করে চলে গেল – তখন সেটা দেখে তিনি এ অল্প বয়সে প্রকৃতপক্ষেই “ভয়” পেয়ে গেছিলেন !
কি এমন দেখেছিলেন_উনি!!উনি দেখলেন একটি বিশাল আকার “স্কন্ধকাটা কবন্ধ” প্রেতযোনি প্রচন্ড গতিতে রেললাইন বরাবর দৌড়ে দৌড়ে তার কাটা মুন্ডুটাকে ধরার চেষ্টা করছে, আর কাটা মুন্ডুটা প্রচন্ড গতিতে “গোঁ-ও-ও-ও” শব্দ করতে করতে ড্রপ খেতে খেতে আগে আগে যাচ্ছে ! বিশালকায় স্কন্ধকাটা কবন্ধটা যতবার মুন্ডুটাকে ধরতে চাইছে ততবার ব্যর্থ হচ্ছে, আর ধপ্ ধপ্ করে শব্দ করে ছুটছে ৷ একেবারে গুরুজীর তিন-চার হাত দূরে__ চোখের সামনে এমন একটা বীভৎস ঘটনা দেখে বালক গুরুজী ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন ! উনি আমাদের বলেছিলেন – ” ঐ অবস্থায় আমার শরীরে নজর দিয়ে কি দেখলাম জানিস ! একটা প্রচন্ড ঠান্ডা শীতল স্রোত আমার শরীরের উপর থেকে নিচ পর্যন্ত এসে আমার সমস্ত শরীরকে একেবারে যেন জমিয়ে দিতে লাগলো ! ফলে আমি কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গই আর নাড়াতে পারছিলাম না ! আমার গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল,ফলে চিৎকার করতেও পারছিলাম না! আমার নিঃশ্বাস এত দ্রুত পড়ছিল যে, আমার হৃৎপিন্ডের ধক্-ধক্ শব্দ আমি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম । আমি বুঝতে পারছিলাম – এই অবস্থা আর কিছুক্ষণ চলতে থাকলেই আমার শরীরপাত হয়ে যাবে ! এমনটা ভাবতে ভাবতেই দেখলাম – আমার মূলাধার থেকে একটা উষ্ণ স্রোত উপরের দিকে প্রবাহিত হতে থাকলো । সেইটি আমার শরীরের শীতলতাকে গ্রাস করে নিল ! আমার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের lock-গুলো খুলে যেতে থাকলো ! যেই মাত্র আমি হাত-পা একটু নাড়াতে সক্ষম হলাম – অমনি লাগালাম দৌড় ! এক দৌড়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকে, ঘরে গিয়েই বাবার বুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম !” ( গুরুমহারাজের ‘ভয়’-সংক্রান্ত বাকি কথা পরের দিন ।) … [ক্রমশঃ]