গুরু মহারাজ স্বামী পরমানন্দ তার নিজের জীবনে তিনটি ‘ভয়’ পাওয়ার ঘটনা উল্লেখ করেছিলেন এবং তিনি এটাও বলেছিলেন যে,– প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি লক্ষ্য করেছিলেন যে, অতিরিক্ত ভয়ে ওনার কুলকুণ্ডলিনী ক্রিয়াশীল হয়ে উঠেছিল এবং সেখান থেকে উষ্ণ স্রোত সৃষ্টি হয়ে ভয়জনিত কারণে সৃষ্টি হওয়া শরীরের নিম্নগামী একটা তুহিন শীতল স্রোতকে প্রতিহত করে – শরীরকে আবার সতেজ করেছিল । এইজন্যই গুরুমহারাজ প্রায়ই বলতেন – “অতিরিক্ত ভয়ে, অতিরিক্ত আনন্দে, অতিরিক্ত উচ্ছ্বাসে বা শোকে – যে কারো কুলকুণ্ডলিনী জাগ্রত হতে পারে।”
যাইহোক, কথা হচ্ছিল ‘ভয়’ নিয়ে এবং গুরুমহারাজ বলেছিলেন – ” সমস্ত ‘ভয়ে’র মূলে রয়েছে মৃত্যুভয়। মৃত্যুকে যদি ভয় না পেতো – তাহলে কোনো জীবের অন্তঃকরণে-ই ‘ভয়`– এই ব্যাপারটাই থাকতো না ৷ কোনো জীব-ই মরে যেতে চায় না, সকলেই মৃত্যুকে ভয় পায় অথচ আশ্চর্য এটাই যে, সব জীবেরই মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী ! কিন্তু কেনো সকল জীব মরতে ‘ভয়’ পায় – কারণ বাঁচা এবং বাড়া-ই সাধারণ জীবের ধর্ম – “Live and Groth”। সেইজন্য সকল জীব-ই চায় একটা সুস্থ-সবল শরীর পেতে এবং সেই শরীর দিয়ে জনন কার্য সম্পাদন করে তারই মত সুস্থ-সবল “next generation” রেখে যেতে ! এই ভাবেই সকল জীব চায় তার পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে দিয়ে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে । এইভাবেই জীব তার অমরত্ব বজায় রাখতে চায় বংশ-পরম্পরার মাধ্যমে ।
মনুষ্যেতর প্রাণীদের মধ্যে এই সুস্থ-সবল অর্থাৎ ‘survival of the fittest’-রা পরবর্ত্তী generation রেখে যাওয়াটাই একমাত্র উদ্দেশ্য হোলেও__ পৃথিবী গ্রহের সর্বোন্নত জীব মানুষের ক্ষেত্রে সেটাই উদ্দেশ্য হোতে পারে না । তা হয়ও নি ! আদিম মানব সমাজ থেকে বেরিয়ে এসে যখন মানুষ ঘর বাঁধলো, সমাজ তৈরী করলো, নিজেদের খাদ্য নিজেরা উৎপাদনের জন্য ফল, ফুল, সবজি এবং শস্য চাষ করতে শুরু করলো । তখন থেকেই সমাজের কিছু মানুষ শুধু দৈহিক শ্রম করার সাথে সাথে মনেরও exercise করতে শুরু করেছিল ৷ সেই চিন্তাশীল ব্যক্তিদেরই চিন্তাজগতের উৎকর্ষতার ফসল হিসাবে পরবর্তীকালের মানুষ পেয়েছিল একটি একটি করে বেদের ন্যায় মহাগ্রন্থ এবং যার সারভাগ হিসাবে পাওয়া গিয়েছিল উপনিষদ !
সেই ঋষিরাই উচ্চারণ করেছিল – “মৃত্যোর্মা অমৃতংগময়ঃ”– তাঁদের প্রার্থনা ছিল – মৃত্যুর জগত থেকে আমাকে অমৃতত্ত্বে নিয়ে চলো ! তাঁদের পথ ধরেই পরবর্তীকালের জ্ঞানীগণ সাধনার দ্বারা মৃত্যুকে জয় করতে চেয়েছেন – হয়ে উঠতে চেয়েছেন মৃত্যুঞ্জয় এবং হয়েছেনও – অনেকেই হয়েছেন ! এখনও হচ্ছেন এবং এখনও অনেকে মৃত্যুঞ্জয় হয়ে উঠতেও পারেন ।
সে যাই হোক, যে কথা গুরুমহারাজ বলেছিলেন যে, ” সমস্ত ভয়ের মূলে রয়েছে মৃত্যুভয় “– সেই কথাকে প্রামাণ্য ধরলে এটা সহজেই বোঝা যাচ্ছে যে, মৃত্যুকে যিনি জয় করেছেন – তিনিই একমাত্র পারেন ‘ভয়’-কে জয় করতে ! গুরু মহারাজের কথা অনুযায়ী – ” তখনই একমাত্র নির্ভয় নয় অভয় হওয়া যায় ৷” একান্ত নির্ভরতা, বিশ্বাস, ভক্তি থেকে নির্ভয় হওয়া যায়, কিন্তু “অভয়” হতে পারেন তিনিই যার ‘ব্রহ্মজ্ঞান’ হয়েছে বা ‘আত্মজ্ঞান’ হয়েছে !
গুরুমহারাজের কাছে শুনেছিলাম – আচার্য শঙ্করের জীবনের একটা ঘটনা ৷ আচার্য শঙ্কর যখন তাঁর জীবনের সমস্ত কাজ সমাপন করে মহাপ্রস্থানের পথে (কেদারনাথ পর্বতের দিকে) যাত্রা করছিলেন, তখন তিনি যেন কারও সাথে কথা বলতে বলতে যাচ্ছিলেন । এইটা লক্ষ্য করে ওনার শিষ্যরা যখন ওনাকে জিজ্ঞাসা করেন যে, ‘ আপনি কার সাথে কথা বলছিলেন ?’ আচার্য উত্তর দিয়েছিলেন, ” মৃত্যুর সঙ্গে “! উনি আরও বলেছিলেন, ” কোনো জীবের জন্মের সাথে সাথেই মৃত্যুও পাশাপাশি পথ চলতে শুরু করে । জীবনের সবচাইতে কাছে রয়েছে মৃত্যু ! তাই জীবন যতটা প্রিয় মৃত্যুও তাঁর কাছে ততটাই প্রিয় ।” এই মর্ত্তে অর্থাৎ এই মরজগতে এঁনারাই হলেন মৃত্যুঞ্জয় ! … [ক্রমশঃ]