গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের বলা কথা নিয়ে এখানে নানান আলোচনা হচ্ছিল । এখন আমরা ‘ভয়’ প্রসঙ্গে আলোচনা করছিলাম । ‘ভয়’ জীবের একটা অন্যতম জৈবিক প্রবৃত্তি ! নিম্নতর প্রাণীদের মধ্যেও ‘ভয়’ বিদ্যমান । যে কোন ছোট ছোট কীটপতঙ্গকে আঘাত করলে বা আঘাত করতে উদ্যত হলে দেখা যায় যে, সেটি ভয় পাচ্ছে, ভয় পেয়ে পালিয়ে যাচ্ছে ! শিশুদের ভয় অনেকটা কম থাকে, সেটা অপরিণত বুদ্ধির জন্য !
স্বামী বিবেকানন্দ একটা উদাহরণ দিয়েছিলেন । উনি বলেছিলেন – ধরা যাক, একটা ঘরে একজন বৃদ্ধ একটা চৌকিতে শুয়ে রয়েছে, যে হাঁটা-চলা করতে পারে না – জোরে চিৎকার করার শক্তিও হারিয়েছে । আর ওই ঘরেই একজন শিশু শুয়ে রয়েছে যার এখনও কথা ফোটেনি – সেও ওই ঘরেই অন্য একটা চৌকিতে শুয়ে হাত-পা নাড়ছে ! এমন অবস্থায় ঐ ঘরে যদি একটা চোর প্রবেশ করে এবং ঘরের এটা ওটা দামি জিনিস হাতাতে শুরু করে – তাহলে ওই বৃদ্ধটির মধ্যে একটা প্রবল উত্তেজনা দেখা যাবে ! সে হয়তো কিছুই করতে পারবে না – তবুও আপ্রাণ সে চেষ্টা করে যাবে চিৎকার করার বা চোরটিকে আটকাবার হয়তো পারবে না, কিন্তু কষ্ট পাবে ! অপরপক্ষে শিশুটি চোরটিকে দেখে কেউ তাকে কোলে তুলে নিতে এসেছে ভেবে হয়তো আহ্লাদে আটখানা হবে ! চোরটির দিকে তাকিয়ে হাসতে থাকবে। হয়তো খুবই হাসবে এবং হাত-পা ছুঁড়ে ওই ঘরে ঢোকা নবাগতকে স্বাগত জানাতে থাকবে !
এখানে বৃদ্ধটি ভয় পাচ্ছে, তার পরিবারের জিনিস চুরি হয়ে যাচ্ছে বলে উত্তেজিত হয়ে পড়ছে । কিন্তু শিশুটির মনে ‘চুরি’ সম্বন্ধে কোনো ধারণা এখনও তৈরি হয়নি এবং সে জানে না__ ঘরে ঢোকা লোকটি ভালো না খারাপ – তাই তার ‘ভয়’-ও ছিলনা এবং কোনো উদ্বেগও কাজ করে নি ।
এখানে গুরু মহারাজ বলেছিলেন – কিন্তু ওই শিশুটির চোখের দিকে যদি বড় বড় চোখ করে তাকানো হয়, তাহলে সে কিন্তু ভয় পাবে ! অথবা যদি শিশুটিকে কোনোরূপ আঘাত করার ভান-ও করা হয় – তাহলেও দেখা যাবে শিশুটি চোখ বন্ধ করে ফেলছে বা সিঁটকে যাচ্ছে অর্থাৎ সে ভয় পাচ্ছে ! এটাকেই সংস্কার বা instinct বলা হচ্ছে ! এই শিশুটির পূর্ব পূর্ব জীবনের ‘ভয়ে’র অভিজ্ঞতা তার সংস্কারে রয়েছে – তাই জীবন সম্বন্ধে বিশেষ ধারণা তৈরি না হওয়া সত্ত্বেও তার মধ্যে একটা ‘ভয়’ কাজ করছে ।
বহু সাধু-সন্ত বিশেষ করে তান্ত্রিক-কাপালিক-অঘোরাচারীদের সাধনার সময় নানান রকম ভয়ানক কান্ড উপস্থিত হয় । নানারকমের প্রেতের তান্ডব নৃত্য, বীভৎস দর্শন মূর্তির আবির্ভাব — ইত্যাদি নানা রকম হয় বলে শোনা যায় । মা মহামায়া চেষ্টা করেন ওই সাধকদেরকে ভয় পাইয়ে সাধনা থেকে বিরত কোরতে – কারণ, তিনি চান না তাঁর এই মায়া-মোহের জগৎ থেকে, এই রূপ-রস-শব্দ-গন্ধ-স্পর্শের খেলা ছেড়ে কেউ বাইরে বেরিয়ে যাক্ । এই ধরনের ‘ভয়’ অতিক্রম করলে তিনি রূপ-রস-ধন-ঐশ্বর্য ইত্যাদির প্রলোভন দেখান ! অনেকে এতেই ফেঁসে যায়, কিন্তু কেউ কেউ এইসব আকর্ষণকে তুচ্ছ করে আরও গভীরভাবে সাধনায় আত্মনিয়োগ করেন – তখন উঠে আসে একটার পর একটা সিদ্ধি ! গুরুমহারাজ এটাকেই বলেছিলেন পুরাণে বর্ণিত সমুদ্রমন্থন – যেখান থেকে উঠে এসেছিল ঊর্বশী, ঐরাবত, কৌস্তুভ মণি, লক্ষ্মী ইত্যাদি আরও অনেক কিছু ! সাধকেরও এইগুলি লাভ হয় – সে যত উন্নত স্তরে উঠতে থাকে ।
এইভাবেই সাধনার প্রতিটি স্তরেও সাধকের জীবনে ‘ভয়’ কাজ করে – পদস্খলনের ‘ভয়’ ! শেষকালে জন্ম-জন্মান্তরের সমস্ত সংস্কার যখন নাশ হবার সময় উপস্থিত হয় – তখন এসে উপস্থিত হয় মহাভয় ।৷ … [ক্রমশঃ]