গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের বলা কথা নিয়ে এখানে বিভিন্ন প্রসঙ্গের আলোচনা করা হচ্ছিলো ৷ এখন প্রসঙ্গ চলছে ‘ভয়’ নিয়ে ! ‘ভয়’ জীবের একটা অন্যতম জৈবিক প্রবৃত্তি হোলেও এবং এর মূল উৎস মৃত্যুভয় হোলেও – জীবনের বিভিন্ন স্তরে ‘ভয়ে’র রূপভেদ ঘটে । ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রে এরও প্রকার ভিন্ন ভিন্ন হয় । সেইসব নিয়েই এখানে আলোচনা চলছিল ।
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে যখন নরেন্দ্রনাথ প্রথম প্রথম আসছিলেন, তখন ঠাকুর একদিন নরেন্দ্রনাথ সম্বন্ধে তাঁর যে দর্শন হয়েছিল – সেটা ঠিক কিনা তার পরীক্ষা করেছিলেন। এটা করার জন্য নরেন্দ্রনাথকে বসিয়ে – পা দিয়ে তাঁর বুকটা স্পর্শ করেছিলেন ৷ এতেই নরেন্দ্রনাথের কুলকুণ্ডলিনী জাগ্রত হয়ে সঙ্গে সঙ্গে এটি ঊর্ধ্বগতি লাভ করে এবং হু – হু করে তা আজ্ঞাচক্রে গিয়ে পৌঁছায় ! এখানেই জীবত্বের নাশ হয়, আমিত্বের লয় হয় ৷ এই স্থান শিবের স্থান, লয়কারী দেবতা শিব । সঙ্গে সঙ্গে অকুতোভয় নরেন্দ্রের মনোজগতে কোথা থেকে একরাশ ভয় এসে বাসা বাঁধলো ! চিৎকার করে উনি বলে উঠেছিলেন – ” ওগো ! তুমি আমার এ কি করলে ! আমার যে মা-বাবা রয়েছেন !” ঠাকুর পুনরায় স্পর্শ করে তাঁকে আবার স্বাভাবিক করে দিয়েছিলেন !
এই যে ‘ভয়’, আগের দিন এই ভয়েরই কথা বলা হচ্ছিল ! ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে যখন তোতাপুরী অদ্বৈত তত্ত্বের শিক্ষা দিয়ে তাঁকে নির্বিকল্পের জন্য নির্জন স্থানে আসন করে বসিয়ে দিলেন – তখন ঠাকুর যতই মনোসংযোগ করছেন – ততই তাঁর চেতনা ঊর্ধ্বমুখী হয়ে আজ্ঞাচক্রে এসে আটকে যাচ্ছে । তোতাপুরী একদিন, দুদিন, তিনদিন অপেক্ষা করে ঠাকুরকে জিজ্ঞাসা করলেন – ” তোমার শরীরে নির্বিকল্পের সম্পূর্ণ লক্ষণ রয়েছে, কিন্তু সেটা হচ্ছে না কেনো ?” ঠাকুর তখন বলেছিলেন – ” বারবার মা এসে আমার পথ আটকাচ্ছে – যেতে দিচ্ছে না !”
আমরা এই কথাটার অর্থ গুরুমহারাজকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম । উনি বলেছিলেন – ” এখানে ‘মা’ বলতে মা মহামায়া ! আজ্ঞাচক্র অতিক্রম মানেই এই জগৎ সংসারের মায়া-মোহের জাল কেটে বেরিয়ে যাওয়া ! মা মহামায়া কখনোই চান না – তাঁর এই জগতের খেলা ভেঙে যাক্ বা কেউ সেখান থেকে বেরিয়ে যাক্ !”
যাইহোক, এ কথা শুনে তোতাপুরী সেইখানে পড়ে থাকা একটা ভাঙ্গা কাঁচের টুকরো (বা ভাঙ্গা হাঁড়ি_কলসীর টুকরো) তুলে নিয়ে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের দুই ভ্রু-র মধ্যিখানে ঢুকিয়ে দিয়ে বলেছিলেন – ” এইখানে মনঃসংযোগ করো ! সব ঠিক হয়ে যাবে ।” ঠাকুর তাই করেছিলেন এবং এরপর যখন আবার তার সামনে মাতৃমূর্তি বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তখন তিনি জ্ঞানকে খড়গ বা অসিরূপে কল্পনা করে ওই কাল্পনিক মাতৃমূর্তিকে দ্বিখণ্ডিত করেছিলেন ! সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মন হু – হু করে ঊর্ধ্বগতি লাভ করেছিল এবং তিনি অনন্তের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গিয়েছিলেন ৷
গুরুমহারাজ বলেছিলেন – সাধারণ মানুষের মৃত্যুটা দেহের মৃত্যু, কিন্তু সাধকের আজ্ঞাচক্র ভেদটাই হলো “মহামৃত্যু”! সাধারণত ascending সাধকেরা সাধনার দ্বারা এতদূরই পৌঁছাতে পারে – এখানে পৌঁছালেই তার জীবত্বের মৃত্যু ঘটে ৷ সেখানে পৌঁছে এই জীব-ই ‘শিব’ হয়ে যায় ৷ বাউল গানে রয়েছে, ” ছেলে মরে মাকে ছুঁলে ৷” অজ্ঞানরূপ শরীরের নাশ হয় এবং জ্ঞানরূপ নতুন শরীরের প্রকাশ ঘটে ।৷ … [ক্রমশঃ]