গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দ বনগ্রাম পরমানন্দ মিশনে সকাল বিকাল সিটিংয়ে যে সমস্ত কথা আলোচনা করতেন – সেইগুলিই এখানে বলা হচ্ছিলো । আমরা এখন আলোচনা করছিলাম গুরুমহারাজের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গুলি কোন্‌ কোন্‌ দেব-দেবী বা মহাত্মা-মহাপুরুষদের কাছ থেকে নেওয়া হয়েছিল এবং কেনই বা সেগুলিকে মা জগদম্বা স্বামী পরমানন্দের জন্য select করেছিলেন ।
গুরুমহারাজের দাঁতগুলি ছিল সারদা মায়ের দাঁতের সঙ্গে সাদৃশ্যযুক্ত ! গুরুমহারাজ একবার বলেছিলেন – “এই যে বলা হয় ‘বত্রিশ পাটি দাঁত’– এটা তো ঠিক নয়, আসলে উপর পাটি এবং নিচের পাটি মিলে দুইপাটি দাঁত এবং প্রতিটি পাটিতে ষোল (১৬) টি করে দাঁত থাকা উচিত ! কিন্তু বেশিরভাগ মানুষেরই তা থাকে না !” কিন্তু গুরুমহারাজের দাঁতের দুপাটি মিলে বত্রিশ (৩২) টা দাঁত-ই ছিল ! একবার একটাআক্কেল দাঁত-ও উঠেছিল গুরুমহারাজের – ওটিকে উনি তুলে ফেলেছিলেন ৷ কি সুন্দর যে দাঁতের গঠন ছিল গুরুমহারাজের – তা আমি ভাষায় বর্ণনা করতে পারবো না ! উনি আমাদেরকে একবার মুখ ব্যাদান করে হাঁ করে বিভিন্ন angle থেকে ওনার দাঁতের গঠন বিন্যাস দেখিয়েছিলে । নিখুঁত সজ্জাপদ্ধতি ! ছোট থেকে বড় – পরপর সুন্দরভাবে সজ্জিত !
তাছাড়া ওনার দাঁতের ছিল অসম্ভব জোর ! উনি সত্যি সত্যিই একটা সুপারি আমাদের সামনে দাঁতে করে চেপে ধরে কেটে কেটে কুচি কুচি করে দিয়েছিলেন ! আর একবার আখরোট কামড়ে কামড়ে ফাটিয়ে কি করে খেতে হয় _তা দেখাচ্ছিলেন! উনি দেখালেও আমরা বেশিরভাগ‌ই(যে ক’জন সেদিন ওনার সামনে উপস্থিত ছিলাম) একটাও দাঁতে করে ভাঙতে পারি নি!
তাছাড়া আরও একবার আজিমগঞ্জ আশ্রম থেকে কাটোয়ার দিকে ফেরার পথে – ট্রেনে সিঙ্গুর আশ্রমের সঙ্গে যুক্ত বেশ কয়েকজন ইয়ং ছেলে-মেয়েদের সাথে গোটা আখ খাওয়ার একটা প্রতিযোগিতা হয়েছিল । গুরুমহারাজ সবার আগে গোটা একটা আখ ছিলকে ছাড়িয়ে খেয়ে নিলেন । এটা দেখে তপিমা সহ অন্যান্যরা যখন অনুযোগ করলেন, ” তুমি এতো তাড়াতাড়ি খেয়ে ফেললে? আমাদের তো এখনো আর্ধেকটাও হয়নি! তুমি নিশ্চয়ই ভালো করে না চিবিয়ে আখের টুকরোগুলো দু’একবার চুষে ফেলে দিয়েছো !” গুরু মহারাজ এর উত্তরে ওনার চিবিয়ে ফেলে দেওয়া আখের ছিবড়ে তুলে নিয়ে দেখিয়ে বলেছিলেন – ” দ্যাখ্ এগুলো ! এর থেকে পিঁপড়েও কোন রস খুঁজে পাবে কিনা সন্দেহ ! বরং তোদের ছিবড়েগুলোর দিকে তাকিয়ে দ্যাখ্ – ভিজে ভিজে লাগছে আর আমার গুলো একদম শুকনো !”
গুরুমহারাজের দাঁতগুলো ছিল মুক্তোর মতো সাদা ! সবসময় ঝকঝক করতো ! হাসলে কি সুন্দর যে লাগতো ! ভুবনভোলানো হাসি ছিল গুরুমহারাজের ! যদিও গুরুমহারাজের এই অপার্থিব হাসিটি উনি পেয়েছিলেন – বৃন্দাবনে, যখন ছোটবেলায় উনি ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন সেইসময় যাঁর কাছ থেকে পেয়েছিলেন – তিনি স্বয়ং বৃন্দাবনেশ্বরী অথবা অর্ধনারীশ্বর মূর্তিতে প্রকটিত ঈশ্বরীয় রূপের কোন প্রকাশ – সেটা গুরুমহারাজ ঠিক করে আমাদের বলেন নি ! তবে কি ঘটেছিল সেই ঘটনাটা সেটা গুরুমহারাজ আমাদেরকে বলেছিলেন ।
গুরুমহারাজ ওই ছোট বয়সেই ঘুরতে ঘুরতে বৃন্দাবনের বাঁকে-বিহারীর মন্দিরে ঝাঁকিদর্শন বা ঝলক-দর্শনের জন্য ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিলেন । হঠাৎ করে বিশালদেহী একজন ব্যক্তি গুরুমহারাজের গায়ের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায়! এতে গুরুমহারাজ বেশ আঘাত পেয়ে চেঁচিয়ে উঠে বলেন – ” তুমি কি অন্ধ নাকি ? দেখতে পাও না ?” লোকটি সত্যি সত্যিই অন্ধ ছিল ! এটা দেখে গুরুমহারাজ বিস্মিত হয়ে তাকে আবার জিজ্ঞাসা করেন – ” তুমি তো কিছুই দেখতে পাও না – তাহলে এখানে কি দেখতে এসেছো ?” সেই লোকটি উত্তর দিয়েছিল – ” আমি কিছু দেখতে আসিনি ! আমি নিজেকে দেখাতে এসেছি !” এই কথাগুলো গুরুমহারাজের কানে যেতেই ওনার কানে কথাগুলি বারবার অনুরণন হতে থাকে এবং ওনার বোধের জগৎ উন্মুক্ত হয়ে যায় । উনি বুঝতে পারলেন –’জগতে দেখার এমন কিছু নাই – কিন্তু মানুষ যদি নিজেকে তৈরি করতে পারে – তাহলে জগৎ তাকেই দেখবে ! এমনকি ঈশ্বরও তারই দিকে তাকিয়ে থাকবে !”
এরপর থেকে গুরু মহারাজের গায়ের উত্তাপ বেড়েই চলতে থাকলো ৷ উনি আর ওই মন্দিরে থাকতে পারলেন না – চলে গেলেন যমুনার তীরে ৷ ওখানে জলে ডুবে থেকে এবং ভিজে বালি গায়ে চাপিয়ে চাপিয়ে সারা দিন-রাত কাটিয়ে দিলেন ৷ পরের দিনেও একই অবস্থা – এইরকম অসহ্য জ্বালার মধ্যে কাটিয়ে তিনদিনের দিন _ভোরের দিকে একটা অপরূপ মূর্তি ওনার সামনে আবির্ভূত হয়ে, ওনার দিকে চেয়ে মৃদু মৃদু অপূর্ব সুন্দর মিষ্টি একটা হাসি হাসতে থাকলেন । ওই হাসি দেখে গুরুমহারাজের সেই অবস্থায় খুবই রাগ হচ্ছিলো – তাই উনি বলে উঠেছিলেন – ” আমার এতো কষ্ট হোচ্ছে, আর তুমি হাসছো ? এত হাসি তুমি পাও কোথা থেকে ?” গুরু মহারাজের মুখ থেকে এই কথা শেষ হোতে না হোতেই __ওই মূর্তির মুখের হাসি গুরুমহারাজের মধ্যে সঞ্চারিত হোতে লাগলো এবং ওনার শরীর ধীরে ধীরে শীতল হয়ে গেল ! গুরু মহারাজ নিজের হাসি প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে বলেছিলেন _ “এই হাসিই সেই হাসি!” … [ক্রমশঃ]