আমি যখন প্রথম আশ্রমে (বনগ্রাম) যাই , তখন ওখানে একমাত্র বয়স্ক বা বৃদ্ধ ছিলেন স্বামী তপেশ্বরানন্দ ৷ ওনার তখন বয়েস ৬০/৬৫ হবে , যেখানে গুরু মহারাজের বয়েস ছিল হয়তো মাত্র ৩০/৩১ ৷ তৃষাণ মহারাজ , স্বরূপানন্দ বা মুরারী মহারাজরাও প্রায় ঐরকমই ৷ হরি মহারাজ , দীপ্তি মহারাজরা হয়তো একটু কম । অখন্ডানন্দ , আত্মানন্দ মহারাজরা হয়তো দীপ্তিদা-দেরই বয়সী হবে ৷ মিহির মহারাজ-ও তাই ৷ তবে মামা মহারাজ বা স্বামী কেশবানন্দ এবং শংকরানন্দ মহারাজ একটু বেশি বয়সের ছিল ৷ তবু ৬০/৬৫ বছরের সাধু ছিল ঐ একজন-ই । আশ্রমের বটগাছটার শিকড়ের সঙ্গে তাল রেখে মাটি একটা গুহার মতো করে নিয়ে ঐ মহারাজ তার মধ্যে থাকতেন ৷ তখন তো সবার শোবার কোন আলাদা ব্যাবস্থা ছিল না ৷ তপেশ্বর মহারাজের ঐ ব্যাবস্থা ওনাকে আর সবার থেকে আলাদা থাকায় সাহায্য করেছিল ৷
তখন আশ্রমে লোকজন কমই আসত ,যারা আসত তারা একবার করে তপেশ্বরানন্দ মহারাজের গুহা দেখতে যেতো , আর মহারাজ ‘তা’ দেখাতেও ভালোবাসতেন ৷ তপেশ্বরানন্দ মহারাজ তখন সুর করে গীতা পাঠ করতেন বা বিভিন্ন শাস্ত্রপাঠ করতেন । গুরু বন্দনার গানটি অর্থাৎ ” শুদ্ধং-বুদ্ধং …..” ওনারই রচনা এবং সুর দেওয়া ৷ মহারাজ পূর্ব বাংলার লোক ছিলেন, সম্ভবত ওনার পিতামাতাও ওখানেই থাকতেন — তাই ওনার কথায় পূ্ব্ বাংলার টান ছিল ৷ ছোটবেলাতেই সন্ন্যাসধর্ম গ্রহণ করে উনি ভারত সেবাশ্রম সংঙ্ঘে যোগ দেন , দীর্ঘদিন ঐ সংঙ্ঘের বিভিন্ন শাখায় উনি সহকারী হিসেবে বা প্রধান হিসেবে কাজ করেছেন ৷ বনগ্রামে আসার আগে উনি আশ্রমের কাজ ছেড়ে দিয়ে হিমালয়ের কোলে (উত্তরকাশী / ঋষিকেশ) গিয়ে মৌনব্রত অবলম্বন করে সাধন-ভজন করছিলেন ৷ সেই অবস্থায় ২৪/২৫ বছর বয়সী তরুণ সন্ন্যাসী স্বামী পরমানন্দের (গুরু মহারাজ) সাথে ওনার দেখা হয় ৷ উনি আমাদের বলেছিলেন সেই অপার্থিব অনুভূতি ও অভিজ্ঞতার কথা ! গুরুদেব (স্বামী পরমানন্দ)-কে দেখে এটাই মনে হয়েছিল যে উনি যেন সাক্ষাৎ শিবকে দেখলেন ! তারপর ওনার সাথে আলাপ পরিচয় করতে আর দেরী করেন নি এবং গুরু মহারাজের permission নিয়ে ২/১ বছরের মধ্যেই উনি বনগ্রামে এসে মিশনের কাজে যোগদান করেন ৷
এখানে ওনার কাজ ছিল (যেটা আমরা দেখেছি) শাস্ত্রপাঠ এবং আশ্রমিকদের বৈদিকমন্ত্র , গীতাপাঠ ইত্যাদিগুলি যথাযথ সুর ও ছন্দে শেখানো ৷ আর তাছাড়া আশ্রমের শ্রীবৃদ্ধি-র জন্য বিভিন্ন ফুলগাছ বা অন্যান্য গাছ লাগিয়ে একে তপোবনের রূপ দেওয়া । কি অক্লান্ত পারিশ্রম যে মহারাজ সেই সময় করেছেন — তা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না ! ঐ বয়সে পুকুরের পাড়ের Hard মাটিকে বশ মানানো যার তার কম্মো নয় ! উনি সেই অসাধ্য সাধন করেছিলেন ৷ গুরু মহারাজের ঘরকে কেন্দ্র করে গাছ-গাছালির যে সৌন্দর্য্য — সেগুলি সবই তপেশ্বরানন্দের অবদান । তপেশ্বরানন্দ মহারাজ শুরু করেছিলেন , অনেক পরে ওনাকে সাহায্য করতে এসেছিল বনগ্রাম আশ্রমের আরেক ব্রহ্মচারী মনোজিৎ (বাসুদেবানন্দ) ৷ বাসুদেবানন্দ – তপেশ্বরানন্দ মহারাজকে বাগানের কাজে সাহায্য করা ছাড়াও সকাল সন্ধ্যায় প্রার্থনাসঙ্গীত হারমোনিয়াম বাজিয়ে গাইত ৷ বাসুদেবানন্দের পরে ঐ কাজটি করতে শুরু করেছিল রান্নাঘরের মৃত্যুঞ্জয় মহারাজ ৷
কথা হচ্ছিল তপেশ্বরানন্দ মহারাজকে নিয়ে ৷ সেই সময় দেখতাম সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মহারাজ নিরানি , কোদাল ইত্যাদি নিয়ে গুরু মহারাজের ঘরের চারিদিক পরিষ্কার করছেন , নতুন নতুন গাছ লাগাচ্ছেন , যে গাছগুলি রয়েছে তার পরিচর্য্যা করছেন ৷ তখন যেহেতু গুরু মহারাজ ওনার ঘরের সামনের দিকে (দক্ষিণ দিকে) সিটিং করতেন তাই ওনার ঘরের বাঁদিকে (আমাদের ক্ষেত্রে ডানদিকে) শীতকালে গুরু মহারাজ যাতে রোদে
বসে সিটিং করতে পারেন তার জন্য একটা গোলমতো দূর্বাক্ষেত্র তৈরী করেছিলেন, যার চারপাশে ফুলগাছ। দূর্বাক্ষেত্রটিতে শুধু মাত্র দূর্বাঘাসই ছিল, অন্যান্য ঘাসগুলিকে উনি নিরানি দিয়ে একটা একটা করে উপড়ে তুলে দিয়েছিলেন। গুরুজীকে প্রসন্ন করার জন্য__ওনার কর্মনিষ্ঠা অতুলনীয়। ভারত সেবাশ্রমে থাকার দরুন উনি লাঠিখেলা, তরবারি খেলা, মার্শাল আর্ট এসব জানতেন প্রায়ই গভীর রাতে গুরুমহারাজ ওনার সাথে লাঠিখেলা practice করতেন। তপেশ্বরানন্দ মহারাজ বাসুদেবানন্দ সহ
অন্য কয়েকজনকে এবং তখন যারা আশ্রম বালক ছিল তাদেরকে লাঠিখেলা, যোগব্যায়াম এবং বিভিন্ন শারীরিক কসরৎ শেখাতেন। মিশনের বাৎসরিক অনুষ্ঠানে মহারাজের নেতৃত্বে বেশ কয়েকবার আশ্রমের ছেলেরা বিভিন্ন শারীরিক কসরৎ দেখিয়ে গুরুমহারাজকে এবং উপস্থিত দর্শকদের আনন্দবর্ধন করেছিল।
এইবার একটা ঘটনার কথা বলি। একদিন মহারাজ বাগানের কাজ করছেন__সন্ধ্যা হয়ে এসেছে__গুরুমহারাজ সিটিং শেষে ঘরে ঢুকেছেন। (প্রার্থনা চলাকালীন উনি বাইরে এসে পায়চারি করতেন।) মহারাজ খেয়াল করলেন যে একটা কমবয়সী মেয়ে গুরুমহারাজের বন্ধ ঘরের চারপাশে ঘুরঘুর করছে। মহারাজ কয়েকবারই মেয়েটির দৃষ্টি আকর্ষন করার চেষ্টা করেছিলেন এবং ওখানে ঘুরে ফিরে আসার কারন কি__তা জিজ্ঞাসাও করেছিলেন, কিন্তু মেয়েটি মহারাজকে কোন পাত্তা দেয় নি। মহারাজ সাধারণত সন্ধ্যার প্রার্থনায় যোগ দিতেন কিন্তু এই সন্দেহভাজন মেয়েটি গুরুজীর কোন ক্ষতি করতে পারে, এই ভেবে মহারাজও কাজের অছিলায় বাগানেই অপেক্ষা করতে লাগলেন।
সন্ধ্যা হয়ে গেল, আর তখনকার বনগ্রামে আকাশে চাঁদ না থাকলে সন্ধ্যার পর ঘুটঘুটে অন্ধকার। (যেহেতু বিদ্যুৎ ছিল না)। মেয়েটি ফুলগাছের ঝোপের আড়ালে ঠায় দাঁড়িয়ে__মহারাজও অপেক্ষমান…..!!! টান টান উত্তেজনা!!!
এমন সময় ঘরের দরজা খুলে গুরুমহারাজ বাইরে বেরিয়ে এলেন_সাথে সাথে মেয়েটির মধ্যে একটা movement শুরু হয়ে গেল। আর এটা দেখেই মহারাজ লাফিয়ে গুরুমহারাজের কাছে গিয়েই বলে উঠলেন, “মহারাস্(জ)! আগে সাইবেন(যাইবেন ) না, আপনারে স্জরাইয়া (জরাইয়া) ধরিতে পারে!!” হটাৎ করে তপেশ্বরানন্দ মহারাজের ঐরকম ব্যাঘ্রঝম্ফ এবং ঐ ধরনের কথায় গুরুমহারাজ প্রথমটায় একটু থমকে দাঁড়িয়ে গেলেন। আর সেই সুযোগে সত্যি সত্যিই মেয়েটি গুরুমহারাজকে_”জরাইয়া ধরিল “।
গুরুমহারাজ যত বলেন_” কে তুই? ছাড়্ আমাকে ছাড়্!!! “
মেয়েটি ততই আরো জোরের সাথে জড়াইয়া ধরে। ঐ অবস্থায় মেয়েটি একটি কথা বলছিল_” তোমার সাথে আমার মধুর ভাব। “
তপেশ্বরানন্দ মহারাজ ও হতবম্ব!! বুঝতে পারছেন না যে কি করা উচিত??
তবে বোঝার দরকারই বা কি?? যা করার স্বয়ং তো তিনিই করবেন!!!
মার্শাল আর্ট “তাই চি’_র প্যাঁচ দিতে ই ওর হাতের বাঁধন আলগা হয়ে গেল। এবার গুরুমহারাজ মেয়েটির দুটো পা এক হাতে আর দুটো হাত অন্য হাতে নিয়ে এক ছুঁড়ে ওখান থেকে অন্তত 20/25 হাত দুরে পুকুরের জলে ফেলে দিলেন।
তারপরেই গুরুমহারাজ মুরারী মহারাজকে বললেন ওকে তুলে আনতে। আর বললেন_” মেয়েটির মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটে গেছে, ওর চিকিৎসার প্রয়োজন” ।
পরে গুরুমহারাজের কাছে ‘শাস্তির ব্যাপারটা একটু বেশী হয়ে গেল কি না’_তা জিজ্ঞাসা করায় উনি বলেছিলেন_” নারীর গায়ে হাত দেওয়া উচিত নয়, কিন্তু দুষ্টা রমনীকে শাস্তি দেওয়া, এমন কি মেরে ফেললেও কোন পাপ হয় না। এর প্রমাণ– ভগবান শ্রীকৃষ্ণ পূতনা বধ করলেন এবং ভগবান শ্রীরামচন্দ্র তারকাকে বধ করলেন, শূর্পনখার নাক কান কেটে দিলেন।