গুরু মহারাজের (স্বামী পরমানন্দ) কথা বা ঘটনা বলার জায়গা এই “পুরোনো সেই বনগ্রামের কথা” ৷ আজ আবার বনগ্রামের সেই এক এবং অদ্বিতীয় নগেন মণ্ডলের সাথে গুরু মহারাজের কিছু ঘটনা মনে পড়ে যাচ্ছে ! আজ সেইগুলোই হোক – পরে না হয় আবার গুরু মহারাজের এক একদিন এক এক বিষয়ের প্রসঙ্গে কথা হবে ৷
আমরা আগেই আলোচনা করেছিলাম নগেন গুরু মহারাজের সামনে সিটিং-এই বহুলোকের উপস্থিতিতে নানারকম অঙ্গিভঙ্গি করে বিভিন্ন কমিক্ দেখাতো। নানান হাসির ঘটনা উল্লেখ করে সকলকে হাসাতো – গুরু মহারাজও খুবই আনন্দ করতেন ৷ এক একদিন উনি নিজেই নগেনকে ডেকে বলতেন – ” নগেন ! তুই সেই ‘অমুক’ ঘটনাটা এদের কে বল তো !” ব্যস্ ! নগেন সাথে সাথেই উঠে পড়ত এবং সেই ‘অমুক’ ঘটনাটা অঙ্গিভঙ্গি সহকারে বলতে শুরু করত! এই প্রসঙ্গে একটা কথা বলে রাখি – গুরু মহারাজ নবদ্বীপ হালদারের কমিক্ যেগুলো আগে গ্রামাফোন রেকর্ডে শোনা যেত – ওইগুলি শুনে খুবই আনন্দ পেতেন । অনেক সময় রেকর্ডের দু-একটা ঘটনা উনি নিজেই বলতেন, আবার অন্য কারো কাছে শুনতেও ভালোবাসতেন ।
এবার আসি নগেনের বলা কমিকের কথায় ! একদিন সিটিং-এ গুরু মহারাজ নানারকম কমিক নিয়ে কথা বলছিলেন – ‘লরেল এন্ড হার্ডি’ র কথাও উঠল ! প্রকৃতপক্ষে সেদিন সারাবিশ্বের বিভিন্ন কমিকস্ , কমেডিয়ানদের নিয়ে আলোচনা হয়ে গেল । চার্লি চ্যাপলিনের বিভিন্ন সিনেমায় অভিনয় নিয়েও উনি নানা কথা বললেন । আমাদের দেশের হিন্দিফিল্ম জগতে আসরানি , জগদীপ , কেষ্ট মুখার্জী প্রমূখ সবার প্রসঙ্গ উঠল । বাংলা চিত্রজগতে ভানু , চিন্ময় , রবি , জহর ঘোষের নামও করেছিলেন ৷ কিন্তু চার্লি-র প্রতিভা সবার সেরা। এইসব করতে করতেই নগেনের প্রসঙ্গ উঠল । উনি বললেন – ” নগেন অনেক কমিক করে দেখাতে পারে। নগেন! তোদের গ্রামের সেই বৃদ্ধ দাদু — যার বৃদ্ধা স্ত্রী মারা যাওয়ার কান্নাটা এদের একবার শুনিয়ে দে তো !” নগেন সাথে সাথেই সেই অতিবৃদ্ধ দাদু যার দাঁতগুলো একটাও ছিল না – ফলে তার কথাগুলো ঠিকমতো উচ্চারণ হোত না, সেই দাদুর স্ত্রীর মৃতদেহ ধরে কান্নার দৃশ্য হুবহু কপি করে দেখাতে শুরু করল! সেই অতিবৃদ্ধের দাঁত ফোকলা হওয়ায় এবং গাল ভিতরে ঢুকে যাওয়ায় বিভিন্ন শব্দের উচ্চারণ ঠিকমতো হোত না ৷ যেমন ~ওরে> ‘ওলে’! , অভিলাষী > ‘অবিলাচি’! , মারা গেছে > ‘মালা গেচে’! , শালা > ‘থালা’! এইরকম উচ্চারণ হোত !
নগেনরা তখন খুবই ছোট – বাইরে কোথাও খেলা করছিল ৷ হঠাৎ ওদের এক বন্ধু খবর দেয় – ওদের পাড়ার এক বৃদ্ধ দাদু খুবই কাঁদছে! বুড়ো মানুষ আবার কাঁদে নাকি _ওইটা দেখার জন্য দৌড়ে ওরা সেই বাড়ীর ভেতরে গিয়ে দেখে যে বাড়ীতে অনেক লোকজন , আর বাড়ীর বৃদ্ধা ঠাকুমা মারা গেছে – আর সেই মৃতদেহটা ধরে বৃদ্ধ দাদু কাঁদছিল । তার কান্নার ভাষাটা এইরকম ছিল –> ” ওলে অবিলাচি লে(রে) – হে – হে – হে (কান্না) ! আমাকে ছেলে (ছেড়ে) কোতা (কোথা) চলে গেলি লে(রে) – হে – হে – হে (কান্না) !” ঐ দাদুর এইরকম কান্না দেখে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা (নগেন এবং তার বন্ধুর দল) অবাক হয়ে ঐ বুড়ো দাদুর মুখের দিকে তাকিয়ে হাসছিল । এইটা দেখে কাঁদতে কাঁদতেই ওই বুড়ো হঠাৎ পাশে পড়ে থাকা তার হাঁটার সাথী লাঠিটা তুলে নিয়ে ওই ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের দিকে গালাগালি দিতে দিতে তাড়া লাগাল – সেই বৃদ্ধ বলেছিল – ” থালারা (শালারা) ! মদা (মজা) দেখতে এতেতে (এসেছে) থালারা!! ! আমার বলে বৌ মলে (মরে) গেয়েতে (গিয়েছে) – আর থালারা আমোদ পেয়েতে (পেয়েছে) ! বেলো (বেরো) থালারা ! আমাল (আমার) বালি (বাড়ি) থেকে বেলো !”
নগেনের মুখে এই কাহিনী (অঙ্গিভঙ্গি সহকারে পরিবেশিত) শুনে উপস্থিত সকলের তো হাসির ফোয়ারা ছুটলই __গুরু মহারাজেরও সে কি হাসি ! খুব হাসলে ওনার ঝকঝকে মুক্তোর মতো দাঁতের সারি দেখা যেতো – আর মুখমন্ডল লাল টকটকে হয়ে যেতো ! ওনার হাসি দেখে বাকীদেরও মন খুবই ভালো হয়ে যেতো !
আর একদিন সকালে গুরু মহারাজ সিটিং-এ বসেই নগেনকে (ও আগেই এসে বসেছিল) জিজ্ঞাসা করলেন – ” হ্যাঁ রে নগেন ! তুই নাকি কাল সারা দুপুর একটা শুয়োরের পেছন পেছন মাঠে মাঠে ঘুরেছিস – এর কারণটা কি রে ?” এই কথায় নগেন খুব লজ্জায় পড়ে গেল । আসলে হয়েছে কি – যৌবন বয়স পর্যন্ত নগেনের মাথার চুল খুবই ঘন আর Curley ছিল ৷ কিন্তু হঠাৎ করে গোছা গোছা চুল উঠে যাওয়ার জন্যে মাথাজোড়া বিরাট টাক পড়ে গিয়েছিল । সেই সময় গুচ্ছিত এবং কুঞ্চিত চুলের শোকে তখন নগেন্দ্রর পাগল-পারা অবস্থা! চুল রক্ষার জন্য যে যা বলছিল -ও তাই করছিল।কিন্তু চুল ঝড়েই যাচ্ছিল -মাথা দ্রুত ইন্দ্রলুপ্তির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল ।
সেই সময় ঐ অবস্থার সুযোগ নিয়ে ওর এক বন্ধু মজা করে ওকে বলেছিল -শুয়োরের টাটকা গরম ‘গু'(পায়খানা )’টাকে’ – লাগালে ‘টাকে’ চুল গজাবে! আর এই কারণেই আগের দিন নগেনের সারাদুপুর শুয়োরের পিছন পিছন ঘোরা!
ঘটনার সমস্ত বিবরন শুনে গুরুমহারাজের সে কি হাসি! বললেন -“নগেন! চুলের শোকে তোর common sense ই তো কাজ করছে না রে ! তুই কি সত্যিই বুঝতে পারিস নি-যে কেউ তোর সাথে এটা নিয়ে মজা করেছে!” নগেন সেদিন সত্যিই খুব লজ্জা পেয়েছিল, এটা বুঝতে পারছিলাম, কারণ অতো আমুদে ছেলে -সেদিন কিন্তু সিটিং এ মাথা তুলতেই পারছিল না ।গুরুমহারাজ অবশ্য এই ঘটনাটি উল্লেখ করে বললেন -“দেখেছ! মানুষ কে hypnotise করা কত সহজ ! মহামায়ার জগতে রূপরস ইত্যাদির ফাঁদে, মায়া-মোহের জালে মানুষ এমন ফেঁসে আছে যে -তার এই দূর্বলতা কে কাজে লাগিয়ে তাকে দিয়ে অনেক কিছু করিয়ে নেওয়া যায় ।আর সমাজের কিছু ধান্দাবাজ ব্যক্তি এইভাবেই বহু সাধারণ মানুষকে ঠকিয়ে করেকম্মে খাচ্ছে ।”
আবার নগেনের কথায় আসি ।মাঠে স্যালো-টিউবওয়েলের গর্ত্তে কাজ করার সময়ে ওর মাথায় একবার লোহার টিউবওয়েলের ‘বডি’টা পড়ে গিয়েছিল ।ফলে ও অজ্ঞান হয়ে ঐ গর্ত্তে র মধ্যেই পড়ে ছিল ।তখন সবে বনগ্রাম আশ্রম গড়ে উঠেছে ।মাঠে হৈচৈ শুনে মিশনের ব্রহ্মচারী রা ঘটনাস্থলে ছুটে যান এবং ওকে কাঁধে চাপিয়ে নিয়ে পাহারহাটি health centre এ নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করান। তৃষাণ মহারাজ (স্বামী পরমেশ্বরানন্দ) আমাকে বলেছিলেন যে _”সেদিক থেকে বলতে গেলে -ওটাই ছিল পরমানন্দ মিশনের প্রথম সেবাকার্য।”
নগেনের জুনিয়র বেসিক ট্রেনিং নেওয়া ছিল ।তখন এটা থাকলেই প্রাইমারী স্কুলে চাকরি হতো ।কিন্তু নগেনের হচ্ছিল না! গুরু মহারাজ প্রায়ই সিটিং এ এই নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করতেন ।যদি কাউকে ধরে টাকাপয়সা দিয়েও হয় -তার জন্যেও চেষ্টা করতে বলেছিলেন ।একদিন বললেন -“কি করবি বল্! ‘যেমন কলি -তেমনি চলি’।”
নগেনদের নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার_সেইসময 10000 (দশহাজার)টাকা যোগাড় করে দেওয়া ওদের পক্ষে খুবই কষ্টকর ছিল, কিন্তু ওরা আশ্রমের সঙ্গে যুক্ত একজনকে ঐ পরিমান টাকা দিয়েছিল চাকরির জন্য। কিন্তু চাকরি তো হোল ই না উপরন্তু টাকাটাও জলে গেল!!গুরু মহারাজ এইটা নিয়েও সিটিং এ মাঝে মাঝে দুঃখ প্রকাশ করতেন ।(ক্রমশঃ)