গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের প্রথম সন্ন্যাসী শিষ্য স্বামী শংকরানন্দের সম্বন্ধে কিছু কথা বলা হচ্ছিলো । স্বামী শংকরানন্দের বর্তমানে (sept-2020) ৮৭/৮৮ বছর বয়স, ফলে বার্ধক্যজনিত কারণে উনি এখন অসুস্থ – কিন্তু তবু গুরুমহারাজের সঙ্গে ওনার বিভিন্ন সময়ে ঘটে যাওয়া নানান কথা উনি আমাদের যখন বলছিলেন – তখন কিন্তু ওনার শারীরিক কোনোরূপ কষ্ট রয়েছে বলে মনে হচ্ছিলো না, বেশ সাবলীলভাবে কথাগুলো বলে যাচ্ছিলেন । ফলে আমাদের একবারের জন্যেও মনে হচ্ছিলো না যে, ওনাকে থামানো দরকার, ওনার কষ্ট হচ্ছে ! বরং উনি এতো আবেগাপ্লুত হয়ে গুরুমহারাজের কথাগুলো বলছিলেন যে, গুরুমহারাজের প্রতি ওনার আন্তরিক শ্রদ্ধা ও ভক্তির ঐকান্তিকতা আমরা যারা ওখানে উপস্থিত ছিলাম – তাদেরকেও স্পর্শ করেছিল । ফলতঃ আমি অন্তত: এতটাই আপ্লুত হয়ে যাচ্ছিলাম যে, আমার মনে হচ্ছিলো এই প্রবীণ সন্ন্যাসীর পায়ে বারবার মাথা ছোঁয়াই _ওনাকে একটু স্পর্শ্য করি!
উনি বলছিলেন হরিদ্বার-হৃষীকেশ অঞ্চলে থাকার সময়কালীন ওনার জীবনে ঘটে যাওয়া একটি অলৌকিক বা অতিলৌকিক ঘটনার কথা! সেটি এমন‌ই একটা ঘটনা – যা ওনার স্মৃতিপটে একদম উজ্জ্বল হয়ে গেঁথে রয়েছে ! এই স্মৃতিচারণাটি করতে গিয়ে কতবার যে ওনার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে গেল এবং ওনার চোখ দুটি দিয়ে সেই অঝােরধারে ঝরে পড়া অশ্রুধারা যে কত কথা বলতে চাইলো – তা আর কি করে প্রকাশ করবো ! তাই শুধু কথাগুলিই বলা যাক্ !
যদিও এই ঘটনাটি আমরা গুরুমহারাজের কাছ থেকে যেমনটি শুনেছিলাম (যেটা গুরুমহারাজ বেশ মজা করে আমাদেরকে বলেছিলেন)– সেটি already প্রকাশিত হয়ে গেছে । কিন্তু সেটা একরকম অ্যাঙ্গেল থেকে বলা হয়েছে, আর আজ ওই একই ঘটনা বর্ণনা করা হচ্ছে – সেটা স্বামী শংকরানন্দের নিজের দৃষ্টিকোণ থেকে ! উনি সেইসময় কি অবস্থায় ছিলেন, কি ভাবছিলেন, কি অবস্থায় গুরুমহারাজের সাথে ওনার সেই অলৌকিক সাক্ষাৎকারটি হয়েছিল এবং তারপরে কি হয়েছিল __সেইগুলি এখানে আলোচনা করা যাক্ !
আমরা আগে জেনেছিলাম যে, হরিদ্বার অঞ্চলে থাকাকালীন সময়ে স্বামী শংকরানন্দ মহারাজের বয়স তখন ছিল হয়তো ৪৫/৫০ বছর বয়স। কিন্তু বলা উচিৎ প্রায় ৫০-বছরের তরতাজা যুবক (ওই বয়সে উনি যুবকই ছিলেন)! ঐ সময় উনি এককালীন খুবই বেশি পরিমাণে খাবার খেয়ে নিতে পারতেন এবং অক্লেশে সেই খাবার হজমও করে নিতেন । সেইসময় ঐসব অঞ্চলের সাধুরা__ঐ দীর্ঘদেহী, সুদর্শন, মুণ্ডিত-মস্তক সন্ন্যাসী শংকরানন্দ মহারাজকে অনেকেই তাঁর নিজের ভাবে থাকা, কারো সাথে বিশেষ মেলামেশা না করা, বেশি বেশি পরিমাণে আহার গ্রহণ এবং যেকোনোরকম অন্যায়ের সঙ্গে অনাপোষী মনোভাবের জন্য__ ওনাকে “ভয়ংকরী শংকরানন্দ” নামে পরিচয় দিতো (যেহেতু হরিদ্বার-হৃষীকেশ অঞ্চলে সেইসময় শংকরানন্দ নামে অনেকজন সাধু ছিল, তাই এক একজনকে এক এক নামে পরিচয় দেওয়া হোতো)।
সেইসময় ওখানকার সাধুদের সাথে ওনার__ঐ বেশি পরিমাণে খাদ্য-খাবার দেওয়া নিয়ে কিছু ঝামেলা হয়েছিল । এইটা ওনার মনে খুব আঘাতের কারণ হয়েছিল । এরপরেই উনি সংকল্প করেন যে, ভগবান স্বয়ং যদি ওনার জন্য খাবার নিয়ে আসেন, তাহলেই উনি খাদ্যগ্রহণ করবেন! তাই উনি ঠিক করলেন_ এখন থেকে তিনি লোকালয় থেকে একটু দূরে নির্জনে অনাহারে থেকে সাধন-ভজন করবেন বা যেকোনভাবে ঈশ্বর চিন্তায় নিজেকে মগ্ন রাখবেন ৷
সেইমতো উনি কাঁধে ঝোলা সম্বল করে হরিদ্বারের গঙ্গার উজান ধরে হাঁটতে হাঁটতে একটা ফাঁকা গুহা পেয়ে গেলেন এবং সেখানেই থাকতে শুরু করে দিলেন । ওনার ঝোলায় একটা কম্বল ছাড়াও দু-একটা বই সবসময় থাকতো । তারমধ্যে স্বামীজীর বই তো থাকতোই – তাছাড়া সেই সময় ওনার কাছে ছিল একটি বাইবেলের ইংরেজি ভার্সন ! ওই গুহায় তখন অনাহারে দু-তিনদিন কেটে গেছে, ফলে ঐরকম একজন অধিক আহারগ্রহণকারীর পক্ষে অনাহারে থাকাটা যে কি কষ্টের তা সহজেই অনুমেয় ! কিন্তু উনি ব্রতরক্ষার তাগিদে এবং ঈশ্বরের মহিমার প্রতি বিশ্বাস রেখে ধ্যান-জপ, সদগ্রন্থ পাঠ ইত্যাদিভাবে এবং সাধন-ভজন করে সময় কাটাচ্ছিলেন ।
সেদিন ছিল ভয়ঙ্কর দুর্যোগের দিন, একে তো হরিদ্বার অঞ্চল গ্রীষ্মকাল ছাড়া বাকি সময়টা শীতপ্রধান, তাছাড়া যদি ওখানে টানা বৃষ্টি হয় – তাহলে বেশ ঠান্ডা পড়ে যায় ! কিন্তু শংকরানন্দ মহারাজের অতোটা অসুবিধা হয়নি – কারণ উনি গুহার অভ্যন্তরেই ছিলেন ৷
যাইহোক, সেইসময় উনি মনোযোগ সহকারে বাইবেল গ্রন্থটির একটি বিশেষ অংশ পাঠ করছিলেন, যেখানে ছিল ভগবান যীশু তাঁর শিষ্যদেরকে বলছেন – “তোমরা যারা আমার শিষ্য, তারাই আমার সবচাইতে প্রিয়, তোমাদের সঙ্গলাভেই আমার শান্তি ও আনন্দ লাভ হয়, আমার খাদ্য-পানীয়ের অভাব মেটে, আমার শরীরের পুষ্টি লাভ হয় …” ইত্যাদি ! এই অংশটি পাঠ করতে করতে শংকরানন্দ এতটাই মগ্ন হয়ে গিয়েছিলেন যে, ওনার তখন দু-চোখ দিয়ে জল পড়ছিল ! বাইরের প্রকৃতির বৃষ্টিধারার জল, সামনেই প্রবাহিত গঙ্গার জল আর গুহার অভ্যন্তরে সন্ন্যাসী স্বামী শংকরানন্দের চোখের জল __যেন সেইসময় একসুরে বাঁধা পড়ে গিয়েছিল !
শংকরানন্দ মহারাজ সেইসময় ভাবছিলেন – “আমার গুরুও তো ভগবান ! আর আমিও তো তাঁর একজন সন্ন্যাসী শিষ্য, আমিও তো তাঁর অত্যন্ত প্রিয় ! কারণ উনি নিজেই বলেছেন, “আমার যখন শরীর হয়নি, তার আগে থাকতেই আপনি আমার দৃষ্টির ভিতরে ছিলেন।”– তাহলে উনি কেন আমায় সঙ্গ দিচ্ছেন না – কেন আমি চরম সংকটে রয়েছি জেনেও উনি আমার খবর নিতে আসছেন না – আমি অনাহারক্লিষ্ট জেনেও উনি আমার মুখে খাবার তুলে দিচ্ছেন না !”
এইসব কথা উনি ভাবছিলেন এবং অঝোরে কাঁদছিলেন। চোখের জলে দৃষ্টি ঝাপসা ছিল তাঁর – হঠাৎ উনি দেখলেন ওনার গুহার মুখে একজন সন্ন্যাসী বাইরের বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজছে ! স্বামী শংকরানন্দ নিজের চোখ মুছে ভালো করে তাকিয়ে দেখলেন – বাইরে দাঁড়িয়ে যিনি ভিজছেন তিনি তাঁর-ই গুরু, তাঁর ইহকাল-পরকাল, তাঁর আরাধ্য-ইষ্ট স্বামী পরমানন্দ !!!!
শংকরানন্দজী তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে গুরুমহারাজকে ভিতরে নিয়ে এলেন এবং ভিজে জামাকাপড় ছেড়ে শুকনো জামাকাপড় পরতে দিলেন ৷
এতোক্ষণ শংকরানন্দ মহারাজের চোখে জল ঝরছিল বিরহে, অভিমানে, ভালবাসার আঘাতে! কিন্তু সত্যি সত্যি গুরু মহারাজকে দেখে এবং বাইবেলের লেখার বাস্তব রূপায়ণ ঘটতে দেখে এবার ওনার চোখের জল ঝরছিল আনন্দে,শ্রদ্ধায়, ভক্তিতে!
তবু মহারাজ ওনার মনের সাময়িক সংশয়ের কথা বা মনের ক্ষণিক বিচ্যুতির কথা, গুরু মহারাজের কাছে অকপটে স্বীকার করেছিলেন । গুরু মহারাজ সব শুনে শুধু হেসেছিলেন এবং সেই হাসি দিয়েই উনি মহারাজের অন্তরের সমস্ত ব্যাথা-বেদনা-যন্ত্রণা দূর করে দিয়েছিলেন।
পরিস্থিতি সহজ হবার পর উনি গুরু মহারাজকে জিজ্ঞাসা করছিলেন – “গুরুজী(মহারাজ অবশ্য গুরু মহারাজকে ‘স্বামী’-বলে সম্বোধন করতেন)! প্রথমেই গুহার ভিতরে না ঢুকে বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কষ্ট করে ভিজছিলেন কেন ? গুরুমহারাজ উত্তর দিয়েছিলেন যে, তিনি অপেক্ষা করছিলেন শংকরানন্দ কখন তাঁকে নিকটে আসতে বলেন _তার জন্য৷ গুরুমহারাজের ব্যাগে কিছু খাবার ছিল । কথা বার্তার মাঝেই গুরুমহারাজ সেগুলি নিজের হাতে শঙ্করানন্দ স্বামীকে সেদিন খাইয়ে দিয়েছিলেন । (ক্রমশঃ)