গুরু মহারাজ (স্বামী পরমানন্দ) সেদিন সিটিং-এ কথা বলছিলেন ‘মাছ ‘ নিয়ে । পৃথিবীর সবচাইতে ছোট মাছ থেকে সবচাইতে বড় মাছ কোনগুলি এবং কিভাবে তাদের ধরা হয় , কিভাবে তাদের মানুষ খাদ্য হিসাবে বা অন্যান্য কাজে ব্যবহার করে – সে সবই বলে গেলেন । আমাদের ক্ষুদ্র মস্তিষ্কের আধার তাই সবকিছু তো ধরে রাখা সম্ভব হয়নি ৷ তবু যেটুকু যেটুকু মনে আছে , আজ সেগুলি সবার সাথে ভাগ করে নিই !
গঙ্গার তীরবর্তী অঞ্চল কৃষ্ণদেবপুর – তাই ছোটবেলা থেকেই উনি নদীতে যে সমস্ত মাছ পাওয়া যায় সেগুলির সাথে ওনার পরিচয় থাকাটাও স্বাভাবিক ! এইজন্য পুকুরে যে সমস্ত ছোট মাছ পাওয়া যায় (পুঁটি , মৌরলা , ডাঁরকে) সেগুলি ছাড়াও কত যে চুনোমাছের (ছোট মাছ) নাম উনি গড়গড় করে বলে গেলেন – সত্যিই সেগুলোর নাম আমরা জানি না । আর সবচাইতে বড় মাছ বলতে উনি সামুদ্রিক মাছের কথাই বললেন ৷ সমুদ্র যেমন সবচাইতে বড় জলাশয় – তেমনি তার উপযুক্ত জলজ প্রাণীও প্রকৃতি সৃষ্টি করে রেখেছে ৷ তবে সবচাইতে বড় জলজ প্রাণী তিমি কিন্তু কোন মাছ নয় ! এটি স্তন্যপ্রায়ী প্রাণী ৷ অনেক পূর্বে সমুদ্রে যে সমস্ত বড় বড় মাছ ছিল সেগুলির অনেক প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে ৷ উনি উল্লেখ করেছিলেন আমেরিকার বিখ্যাত লেখক Ernest Hemingway -এর “The Old Man and the Sea” গল্পের ! যেখানে এক বৃদ্ধ গরীব জেলে তার সারাজীবনের পরিশ্রম , সংগ্রাম দিয়েও অভাব দূর করতে পারেনি , বৃদ্ধ বয়সে মাঝ সমুদ্রে সবার থেকে (তরুণদের থেকেও) বেশী দূরে গিয়েছিল বড় মাছ ধরার আশায় । দলছুট হয়ে সে ভেসে ভেসে বেড়ায় – আর একদিন সত্যিই সে একটা বড় মাছটির পায় । কিন্তু সেই মাছ ভাসিয়ে ডাঙায় নিয়ে অাসতে আসতেই দেখে যে সমুদ্রের হাঙর বা অন্যান্য মাছেরা ওই মৃত মাছটির শরীরের সব মাংস খুবলে খেয়ে নিয়েছে ! হতাশ , অসহায় বৃদ্ধের অভাব দূর হয় না ! খেটে খাওয়া মানুষের চিরন্তন দুঃখের কাহিনী !
উনি বলছিলেন — ওনার পূর্ব পূর্ব কোন জীবনের কাহিনী ! যখন উনি এমন কোন স্থানে বা সম্প্রদায়ে জন্ম নিয়েছিলেন , যাদের সমুদ্রে মাছ ধরাটাই জীবন ধারণের মূল উপায়। ওনার সম্প্রদায়ের লোকেরা বাল্টিক সাগরে মাছ ধরতে যেতেন ! বড় বড় মাছের কাঠামো দিয়ে নৌকার Structure বানানো হোত ! মাছের-ই শরীরের Chord এবং বনলতা দিয়ে বাঁধা হোত শক্ত করে সেই কাঠামো ! তারপর পশুর চামড়া দিয়ে আবরণ করা হোত ৷ নৌকায় কাঠের ব্যবহার তখনও করাই হোত না ! ওদের সমাজে ধাতুর ব্যবহার হোত শুধুমাত্র অস্ত্রশস্ত্র হিসাবে ৷ উনি বলেছিলেন – “আমাদের লোকেরা দল বেঁধে সমুদ্রে ঐ নৌকাগুলি ভাসিয়ে চলে যেতো – সঙ্গে থাকতো বিভিন্ন মাছ ধরা সরঞ্জাম (জালের ব্যবহার ছিল না) ও অস্ত্রশস্ত্র ! বঁড়শির ‘কানকি’র মতো করে বল্লম বা বর্শা তৈরী করা হোত – যা একবার শরীরে ঢুকলে আর বেরোবে না — আটকে যাবে ৷ ওগুলোর সাথে লম্বা শক্ত সুতো বা দড়ি (মাছের Chord বা বনলতা থেকে তৈরী) বাঁধা থাকতো ! গভীর সমুদ্রে মাংসের টোপ ব্যবহার করে বড় মাছকে নৌকার কাছাকাছি আনা হোত – তারপর এক বা একাধিক ‘কানকি’ যুক্ত বল্লম ছুঁড়ে – মাছটিকে গেঁথে ফেলা হোত – এবার বল্লমের সাথে বাঁধা দড়ি ধরে টান মারলেই মাছ তোলা সহজ হোত । কিন্তু যদি মাছ যথেষ্ট বড় হোত – তখন সেই মাছই নৌকাকে টেনে টেনে বেড়াতো ! হয়তো টানতে টানতে সেই মাছ বহুদূরে নৌকাকে নিয়ে চলে যেতো । নৗেকারোহীদের অসহায়ের মতো তাকে follow করা ছাড়া আর কোন উপায় থাকতো না ! জেলেরা সুযোগ পেলে শুধুমাত্র আরও দু-চারটে বল্লম মেরে মেরে মাছটিকে বেশী বেশী আহত করার চেষ্টা কোরতো ! রক্তপাত হতে হতে এবং টানাটানিতে ক্লান্ত হয়ে মাছটি যখন মৃতপ্রায় হয়ে ভেসে উঠতো – তখন ওরা তাড়াতাড়ি ঐ বড় মাছটির কাছে গিয়ে খুব দ্রুত ‘চপার’ চালিয়ে নৌকার খোলে যতটা জায়গা পেতো মাছের দেহের অংশ কেটে কেটে ভর্ত্তি করে নিতো । তারপর কঙ্কালসহ বাকী মাছটা ওইখানেই ফেলে রেখে — ওরা পাড়ি জমাতো পাড়ের দিকে !” – এইরকম একটা জীবনের কথা বলেছিলেন গুরু মহারাজ ।
উনি বলেছিলেন যীশুখ্রীষ্টের প্রথমদিকের বেশীরভাগ শিষ্যই ছিল জেলে সম্প্রদায়ের – যাদের বৃত্তি ছিল সমুদ্রে মাছ ধরা ! উনি আরও বলেছিলেন – মহাপ্রভু যখন পুরীতে অবস্থান করছিলেন , তখন ওখানকার বহু জেলে পরিবারকে উনি কৃপা করেছিলেন । ওরা দলে দলে মহাপ্রভূর শিষ্যত্ব গ্রহন করেছিল।
জেলেদের জীবনযাত্রা নিয়েও উনি আলোচনা করেছিলেন, বলেছিলেন _”দ্যাখো, এদের জলেই জীবন! জীবনের বেশিরভাগ সময়ই এরা জলের ভিতরে বা জলের উপরে কাটায়! যেখানে মনুষ্যসমাজের বেশিরভাগ মানুষ _তাদের জীবনের অধিকাংশ সময় কাটায় ডাঙায়। তবে জানতো _এই যে ওদের জলে কোমড় ডোবানো অবস্থায় অনেকটা সময় কাটাতে হয় _এতে ওদের gonad gland এর সাম্য বজায় থাকে, এটা একটা ভালো দিক।
মাছ নিয়েও অনেক কথা হয়েছিল। উনিই আমাদের বুঝিয়েছিলেন __কেন জলের উপরের তলের(পুকুরের) মাছের শরীরের গঠন _নিচের তলের মাছেদের শরীরের গঠন অপেক্ষা আলাদা। জলের গভীরতা বাড়লে চাপ বাড়ে, তাই গভীর জলের মাছেদের(মৃগেল জাতীয়) শরীর চ্যাপ্টা বা চ্যাটালো হয়। আর জলের উপরের তলের মাছেদের (কাতলা জাতীয়) মাথা বা শরীর মোটা হয়। কিছু মাছ মাঝামাঝি অবস্থায় থাকে (রুই জাতীয়) এদের আকারও মাঝারি ধরনের হয়।
সমুদ্রের জল ভারী আর এর গভীরতাও অনেক বেশি বলে _সমুদ্রের বেশিরভাগ মাছই চ্যাপ্টা হয়, মাথা সরু হয় _যাতে সাঁতার কাটতে সুবিধা হয়। সমুদ্রের জলে সবচাইতে দ্রুতগামী প্রানী ডলফিন।ডলফিনের বিশেষ আকারই এর জন্য দায়ী। ডলফিনের যে আকার _ঐটাকেই আধুনিক বিজ্ঞানীরা proportionately চারিদিকে বাড়িয়ে অত্যাধুনিক সাবমেরিন তৈরি করেছে এবং দেখা গেছে _তাদের speed অনেক গুনে বেড়ে গেছে।
ডলফিন সম্বন্ধে গুরুমহারাজ আরও বললেন যে সমুদ্রে যত জাহাজডুবি, নৌকাডুবিতে মানুষ ডুবে যায় তাদের বেশির ভাগ কে রক্ষা করেছে ডলফিন। এমনও দেখা গেছে যে মানুষটা হয়তো মারা গেছে তবুও ডলফিনের যখন নজর পড়েছে সে ঠিক ঐ dead body _টাকেই পাড়ে তুলে দিয়ে গেছে! ডলফিনের সাথে মানুষের এত গভীর সম্পর্ক কি করে যে হোল _তা একমাত্র মহাপ্রকৃতিই জানেন। এমন ঘটনাও জানা যায় যেখানে দেখা গেছে যে হয়তো কোন মানুষকে হাঙরেরা চারিদিক থেকে ঘিরে ধরেছে _সেই অবস্থায় হয়তো ঐ বিপন্ন মানুষটির প্রতি কোন ডলফিনের নজর পড়ে গেছে। ব্যস! সে অতি দ্রুত সাঁতরে হাঙরগুলোকে টপকে ঐ মানুষটিকে ওর মাথা আর কাঁধের খাঁজে আটকে নিয়ে সাঁতরে একেবারে পাড়ে এনে পৌঁছে দিয়ে যায়।(ক্রমশঃ)