গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দ মহাকাব্যে বা পৌরাণিক বিভিন্ন গ্রন্থে বর্ণিত কাহিনীগুলির আধ্যাত্মিক, সামাজিক এবং বৈজ্ঞানিক যে সমস্ত ব্যাখ্যা করতেন, সেইগুলি এখানে আলোচনা করা হচ্ছিলো ৷ গুরুমহারাজ একবার মজা করে বলেছিলেন – “যোগশাস্ত্রে প্রথমেই বলা হয়েছে, “শরীরম্ আদ্যম্ – খলু ধর্ম সাধনম্”– সাধারণ মানুষ এর মানেটা কি বুঝেছে বল্ তো – “শরীরটাই আসল, খলেরা ধর্ম-সাধন করে।” কিন্তু প্রকৃত সাধকেরা বা যোগীরা প্রকৃত অর্থ জানেন এবং তা জেনে তাঁরা সাধনার গভীরে ডুব দেন ৷ আসলে সাধনা করতে গেলে বা যোগ করতে চাইলে শরীরকে মজবুত করে গড়ে তুলতে হয় – না হলে কুঁড়েঘরে হাতি ঢোকার মতো অবস্থা হয়, অর্থাৎ শরীর অপটু থাকলে সাধনালব্ধ শক্তি জাগ্রত হোলে, শরীর বেঁকে-চুরে যায় ।”
উনি আরও বলেছিলেন – “যত মত–তত পথ”- কথাটির ভুল ব্যাখ্যা করলে চলবে না । পৃথিবীতে বিভিন্ন মহাপুরুষ বিভিন্ন মতবাদ সৃষ্টি করে গেছেন সমকালীন এবং সেই স্থানের মানুষের কল্যাণের জন্য ! এইজন্যেই মতবাদের মধ্যে আচারগত-আচরণগত-ভাষাগত ইত্যাদি নানা পার্থক্য দেখা দেয় এবং তাতেই ধর্ম নিয়ে গোটা বিশ্ব জুড়ে বিবাদ-বিসম্বাদ ! কিন্তু একটা জায়গায় সব ধর্মমত এসে মিলিত হয়, সেটা হোলো “মত ভিন্ন ভিন্ন কিন্তু পথ একটাই”, আর সেই পথ “সুষুম্নামার্গ”! পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তের- যে কোনো ধর্মমতের -যে কোনো সাধককে আধ্যাত্মিকভাবে উন্নত হোতে হোলে ধ্যানের গভীরতায় যেতেই হবে ! অর্থাৎ এই পথটি হোল __প্রাণ স্থির করে এবং মনকে একাগ্র করে, কুলকুণ্ডলিনীর জাগরণ ঘটিয়ে, সুষুম্নামার্গ অবলম্বন করে ধীরে ধীরে একটি একটি চক্র (মূলাধার, স্বাধিষ্ঠান, মনিপুর, অনাহত, বিশুদ্ধ এবং একেবারে অন্তিমে সহস্রার) উন্মীলিত করতে করতে এগিয়ে যাওয়া !
ধ্যান বা মনের concentration-ই বা প্রয়োজন কেন ? এই প্রসঙ্গে গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দ বলেছিলেন – মানুষের brain-cell গুলোর বেশিরভাগই dormant থাকে, হয়তো এক-দশমাংশ ক্রিয়াশীল । তাতেই জগতে বুদ্ধিমান, বড় বড় পন্ডিত, লেখক, গবেষক, শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার – ইত্যাদি তৈরি হয়েছে ৷ কিন্তু আরো বেশি বেশি brain-cell গুলো যদি ক্রিয়াশীল করা যায় – তাহলে মানুষ আরো কত বেশি creative হোতে পারে, আরো কত উন্নত মেধাবিশিষ্ট হতে পারে – তা সহজেই বোঝা যায় ৷ গুরুমহারাজ বলেছিলেন – “স্বামী বিবেকানন্দের মস্তিষ্ককোষ বা brain-cell একশোভাগ (100%) ক্রিয়াশীল ছিল – তাই এত অল্প সময়ে অত বেশি চিন্তা করতে পেরেছিলেন এবং মাত্র কয়েকটি বক্তৃতার মাধ্যমে তৎকালীন বিশ্বের শিক্ষিত মানুষদের মনোজগৎকে নাড়িয়ে দিতে সমর্থ হয়েছিলেন ! আর শুধু তাই নয় – এইসব মহাপুরুষদের চিন্তাগুলি যত দিন যাবে, ততোই সমকালীন মানুষদের কাছে আরো বেশি বেশি করে নতুনভাবে অর্থবহ হবে এবং সবসময়েই তাঁর চিন্তারাশি গ্রহণযোগ্য হবে । যেখানে, যেকোনো লেখক, কবি বা অন্যান্য শিল্পীদের সৃষ্টির স্থায়িত্ব হয়তো ৫০/৬০ বা ১০০ বছর, কোন so called দার্শনিকের চিন্তার স্থায়িত্ব হয়তো ১০০ বছর বা ২০০ বছর – সেখানে স্বামী বিবেকানন্দের ন্যায় মহাপুরুষদের চিন্তা কয়েক হাজার বৎসর পর্যন্ত স্থায়িত্ব পায় ! মহাসাগরের বুকে এঁরা যেন বিশাল বিশাল তরঙ্গ, যেখানে কোন কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক, শিল্পীরা যেন ছোট ছোট তরঙ্গ, আর সাধারণ মানুষ যেন সমুদ্রে সৃষ্ট লক্ষ লক্ষ, কোটি কোটি বুদবুদ – সৃষ্টি হচ্ছে, আবার ফেটে গিয়ে সমুদ্রে-ই মিশে যাচ্ছে – আলাদা করে কোনো অস্তিত্বের স্থায়িত্ব সৃষ্টি করতে পারছে না !
পৌরাণিক ঘটনার বৈজ্ঞানিক, সামাজিক, আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা করতে গিয়ে – এই কথাগুলি কেন? আসলে এই ধরনের কথাবার্তাও বিভিন্ন আধুনিক ধর্মগ্রন্থে ব্যবহৃত হয়েছে বলেই একটু আলোচনা করে নেওয়া হোলো ।
এবার আসছি গুরুমহারাজের বলা বিভিন্ন মহাকাব্যিক বা পৌরাণিক কাহিনীর ব্যাখ্যায় ! রামায়ণে রয়েছে তাড়কা রাক্ষসীর কথা – যার শরীর সাধারণ মানুষের তুলনায় অনেক বড় এবং ভয়ঙ্কর ! যার বড় বড় চুল, দাঁত, নখ ইত্যাদি রয়েছে এবং ছোট ছোট অস্ত্রাঘাতেও যার কোনো ক্ষতি হয় না ! এছাড়াও রয়েছে খর-দূষণের কথা, যারা প্রাকৃতিক calamities সৃষ্টি করতে পারতো এবং প্রাকৃতিক শক্তিকে কাজে লাগিয়ে শত্রুপক্ষকে বিনাশ করতো ! মহাভারতেও এমনই চরিত্র রয়েছে একজন – সে হলো ভীম পুত্র ঘটোৎকচ, যার শরীর সাধারণ মানুষ অপেক্ষা বহুগুণ বড় বা বিশাল (বর্ণনা রয়েছে যেন ছোট ছোট পাহাড়ের মতো) ! যার পায়ের চাপেই শত শত সৈন্য, হাতি-ঘোড়া, রথ-রথী পিষে যেতো । তার শরীর যে কোনো দিকে কাত হয়ে পড়ে গেলে, তার শরীরের চাপে শত-সহস্র মানুষের শরীর বা ঘরবাড়ি বিনষ্ট হতে পারতো ! এইসব ব্যপারগুলি সম্বন্ধে গুরুমহারাজ বলেছিলেন – ” এরা ছিল যন্ত্রমানব বা ল্যাবরেটরীতে তৈরি করা বিশেষ প্রকারের মানবজাতীয় প্রাণী । তৎকালীন যুগের science এবং technology এখনকার অপেক্ষা অনেকটাই উন্নত ছিল ৷ ফলে যুদ্ধক্ষেত্রে বা বিশেষ বিশেষ কাজে ব্যবহার করার জন্য এই ধরনের ‘মানব’ তৈরি করা হোতো ।
যন্ত্রমানব বা রোবট-ই শুধু নয়, ঘটোৎকচের শরীরের যে বর্ণনা পাওয়া যায় তাতে তাকে একটা বড়সড় ‘Ape-man’-ও ভাবা যায় । গুরুমহারাজ বলেছিলেন – রামায়ণ, মহাভারতের যুগে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি অনেক উন্নত ছিল, genetic বিজ্ঞানও উন্নত ছিল । জিন culture করে এর বিবর্তনকে পিছিয়ে নিয়ে যেতে পারলেই মানুষকে ‘Ape-man’-এ পরিণত করা সম্ভব ! পাশ্চাত্যের উন্নত দেশগুলিতে এই নিয়ে খুবই গবেষণা চলছে, হলিউডে এই ধরনের কল্পকাহিনী নিয়ে সিনেমাও হয়েছে । আর সেইসব সিনেমা খুবই জনপ্রিয়তাও পেয়েছে ।
দ্যাখো, তোমরা মানো আর নাই মানো – এটা সত্যি যে, গোটা পৃথিবীর সাহিত্য সৃষ্টির মূল উপাদান ভারতীয় মহাকাব্য এবং পুরাণাদি শাস্ত্রগুলি থেকেই নেওয়া । মৌলিক যা কিছু সব ভারতের – অন্যেরা(বিশ্বের অন্য প্রান্তের মানুষেরা) পাবেই বা কোথা থেকে ! – সভ্যতা, সংস্কৃতি ইত্যাদি যা কিছু তা তো সব প্রাচীন ভারতবর্ষ থেকেই পৃথিবীর অন্যান্য প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল ৷ তাই একটু মনোযোগ সহকারে বিচার করলে – তোমরাই এইসব রহস্য বুঝতে পারবে – আমাকে আলাদা করে বলে দিতে হবে না ।” (ক্রমশঃ)