গুরু মহারাজ (স্বামী পরমানন্দ) সিটিং-এ এক একদিন এক এক বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন । সেদিনের বিষয় ছিল মাছ । উনি বলছিলেন ভারতীয় শাস্ত্রে মহাপ্রলয়ের কাহিনীর কথা ! সেখানে রয়েছে পৃথিবীতে যখন যখনই মন্বন্তর ঘটে, তখনই মহাপ্রলয় উপস্থিত হয় ৷ আর তখন গোটা পৃথিবীর স্থলভাগ জলাকীর্ণ হয়ে যায় — সমস্ত প্রাণী ও উদ্ভিদের বিলুপ্তি ঘটে ! আর একটি নৌকার মধ্যে সমস্ত প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণীর প্রাণবীজ নিয়ে একটা সিংওয়ালা বিরাট মাছ সেটিকে ভাসিয়ে রাখে এবং টেনে টেনে বেড়ায় ! তারপর প্রলয়কার্য সম্পন্ন হলে – সেখান থেকেই প্রাণবীজ নিয়ে আবার সৃষ্টির কার্য্য শুরু হয় ৷ সেমিটিকদের শাস্ত্রেও এইরকম একটা গল্পের কথা আছে – ‘নোয়ার কাহিনী’ ।
গুরু মহারাজ আরও বলেছিলেন – ভারতীয় পুরাণাদি শাস্ত্রে উল্লেখ রয়েছে দশাবতারের ৷ সেখানে বিষ্ণুর প্রথম অবতার ধরা হয়েছে ‘মৎস্য’-কে ! মৎস্য , কুর্ম , বরাহ , নরসিংহ , পরশুরাম , রাম , বলরাম , বামন , বুদ্ধ ও কল্কি ! গুরু মহারাজ পৌরাণিক যে কোন কাহিনীর বৈজ্ঞানিক বা সামাজিক ব্যাখ্যা দিতেন ৷ উনি বলেছিলেন পুরাণকার-রা ছিলেন — মহাজন ! যে কোন তত্ত্বকে সুন্দরভাবে গল্পাকারে পরিবেশন করতে পারতেন । ফলে পুরাণে যত গল্প আছে সেগুলির বেশীরভাগেরই বৈজ্ঞানিক বা সামাজিক ব্যাখ্যা রয়েছে ৷
এই যে দশাবতারের কাহিনী – এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা গুরু মহারাজ করেছিলেন ৷ উনি বলেছিলেন বিবর্তনের (Evolution) ধারায় প্রাণের প্রথম স্ফুরণ ঘটে জলে ৷ তাই জলজ জীবসমূহের সবচাইতে প্রাচীন এবং সবচাইতে অধিক অভিযোজন ক্ষমতাসম্পন্ন জলজ প্রাণী ‘মাছ’-কে প্রতীক ধরা হয়েছে । বিষ্ণুর অবতার বলতে উনি বললেন ‘বিষ্ণু’ মানে বিস্তার ৷ এই যে জীবজগতের বিবর্তনের ধারার বিস্তৃতি, এটিকেই ‘দশাবতার’ হিসাবে বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে । যার শুরু হ’ল মৎস্য দিয়ে ! এরপর কুর্ম অবতার ! কুর্ম বা কচ্ছপ জল এবং ডাঙা উভয় স্থানেই থাকতে পারে ৷ জলে বাস করে আর ডাঙায় ডিম পারে বা বাচ্চাদের জন্ম হয়। জীববিবর্তনে জলজ জীব থেকে স্থলজ জীবের ক্রমবিকাশের ঘটনাকেই রূপকাকারে ‘কুর্মাবতার’ হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে ৷ এরপর ‘বরাহ’ অবতার ! বরাহ কিন্তু পুরোপুরি স্থলজ প্রাণী কিন্তু ‘জল-কাদা’ পূর্ণ স্থানে থাকতে ভালোবাসে , ওইরকম স্থান থেকে নাক ডুবিয়ে খাদ্যগ্রহণ করতেও ভালোবাসে! সৃষ্টির আদিতে যখন প্রথম ভূভাগ আত্মপ্রকাশ করছিল, পৃথিবীর স্থলভাগ তখন কর্দমাক্ত ছিল। সেই কর্দমাক্ত পৃথিবীতে অসংখ্য কীট কিলবিল করত আর তারপর একটু একটু ডাঙা তৈরী হতেই বৃক্ষাদি বা কিছু পশুপাখীর অভিবিকাশ শুরু হয় ৷ সেগুলির রূপক হিসাবে বা বিবর্তনের বিস্তারের রূপক হিসাবে ‘বিষ্ণু’-র প্রতীক ‘বরাহ’ । এরপর বিষ্ণুর অবতার ‘পরশুরাম’ , যার হাতে সর্বদা থাকত ‘পরশু’ বা ‘কুঠার’ এবং যার শরীরের বর্ণনায় পাওয়া যায় দাড়ি-গোঁফ এবং বড় বড় চুলবিশিষ্ট, কুঠার হাতে এক শক্ত সমর্থ মানুষ ৷ গুরু মহারাজ বলেছিলেন – বিষ্ণুর এই অবতার বোঝাতে বোঝানো হয়েছে আদিম মানুষকে ৷ সবে যখন পশু থেকে মানবরূপ প্রাপ্ত হচ্ছে এবং মানুষ সবে সবে পাথরের অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করতে শিখছে – তাদেরকে বোঝাতেই প্রতীকী রূপ পরশুরাম ৷
এরপর__ পর পর রাম , বামন , বুদ্ধ , ও কল্কির বর্ণনাও দিয়েছিলেন গুরু মহারাজ । রামকে বলেছিলেন কৃষিজীবী মানুষ বা প্রথম যারা কৃষিকে ভিত্তি করে সভ্য হ’ল , সমাজবদ্ধ হ’ল – তাদের প্রতীকী রূপ । বিষ্ণু অবতারের বামন বা ত্রিবিক্রম হ’ল ধর্ম , কর্ম ও জ্ঞান এইগুলি যখন বিবর্তনে মানুষের জীবনে ক্রিয়াশীল হ`ল — তখনই বিষ্ণুর অবতার বা বিবর্তনের ধারায় উন্নত মানবের প্রতীক বামন , যিনি বলিরূপ রাক্ষস-শক্তিকে পদদলিত করে রিপু জয়ের পরাক্রম দেখাতে পেরেছেন! ‘বুদ্ধ’ অর্থে জ্ঞান।আর ভগবানের অবতার রূপ বুদ্ধ_অর্থে প্রকৃত জ্ঞানী। যিনি প্রকৃতিকে সম্পূর্ণরূপে জয় করেছেন, প্রকৃত অর্থে যিনি সম্পূর্ণ মানব ৷ তাই ‘বুদ্ধ’ সর্বোন্নত মানবের প্রতীক – যাঁর মধ্যে মানব শরীরের পরিপূর্ণ অভিবিকাশের সাথে সাথে মস্তিষ্ককোষেরও সম্পূর্ণ বিকাশ ঘটেছিল!
‘কল্কি’ অবতারের যে বর্ণনা পাওয়া যায় – তাতে দেখা যাচ্ছে উদ্যত অসি হাতে সাদা ঘোড়ায় চেপে রাজবেশে এক রাজপুরুষ ! যিনি কলিযুগের কল্মষ বিনাশে উদ্যত ! কিন্তু এই অবতার এখনও শরীর গ্রহণ করেন নি – হয়তো পরে গ্রহণ করবেন ৷
গুরুমহারাজ অবশ্য কল্কি অবতারের রুপের ব্যাখ্যাও করেছেন। উদ্যত অসি বা খাপখোলা তলোয়ার হচ্ছে এখানে জ্ঞানের প্রতীক! পরাজ্ঞান এবং অপরাজ্ঞান _এই সমস্ত জ্ঞানের অধিকারী হবেন আগামী পৃথিবীর সম্পুর্ন মানব(অবতার)। যে কোন অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার, ধর্মান্ধতা, বিভেদকামীতা, অহংসর্বস্বতা ইত্যাদি অজ্ঞানতার অন্ধকারে পড়ে রয়েছে মানুষ! এখান থেকে মানুষকে উদ্ধার করার জন্য কল্কি অবতারের আগমন যেন আলোর দ্যুতির ন্যায়!তাঁর রূপটা এমনই যে তিনি যেন উদ্যত তলোয়ার দিয়ে সমস্ত অজ্ঞানতাকে খচখচ্ করে কাটতে কাটতে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছেন! তাঁর সাদা রঙের ঘোড়া _এখানে পবিত্রতার প্রতীক! এই অবতার হবেন পবিত্রতাস্বরূপ! তাঁর জীবনচর্যায় কখনোই কোন কলুষ স্পর্শ করতে পারবে না। তিনি হবেন কর্মযোগী__যোগের তীব্র সাধনারূপ অগ্নিতে পৃথিবীর ভোগ-লালসারূপ সমস্ত কলুষ পুড়ে ছাই হয়ে যাবে! এইরূপ জীবনকে বলা হয় অপাপবিদ্ধ জীবন। এই অবতারের রাজবেশ তাঁর রাজসিক বহিঃপ্রকাশ! অন্তর্জগত শুদ্ধসত্ব কিন্তু বাইরের রূপ পূর্ণ রাজসিক! আর তাঁর ছুটন্ত ঘোড়া হোল অবতার পুরুষের জীবনের গতির পরিচায়ক। পূর্ণ মানবের(অবতার) সবকিছুই অত্যন্ত গতিশীল! তাঁর হাঁটা-চলা, কাজ-কর্ম __এককথায় তাঁর জীবনের সবকিছুই হয় দ্রুত! বাইরে থেকে তাঁকে দেখে শান্ত মনে হলেও তাঁকে কেন্দ্র করে ঘটে চলে এক বিশাল কর্মপ্রবাহ।
তবে গুরুমহারাজ এটাও উল্লেখ করেছিলেন যে ভারতীয় পুরানাদি শাশ্ত্রে শুধু দশ(10) অবতারই নয় ,চব্বিশ (24) অবতারের উল্লেখ রয়েছে। তারপরে আবার আরও উল্লেখযোগ্য কথা বললেন _”দ্যাখো, ঈশ্বরের ইচ্ছায় জগৎ চলে _তোমার আমার ইচ্ছায় তো আর নয়! তাই এখানে অনেক নিয়ম থাকলেও _কোনটাই শাশ্বত, সনাতন বা চিরন্তন নয়। কোন সময়ে সমকালীন কোন যোগী হয়তো মহাকালের বুকে আঁকা কোন ‘আখর’ পড়ে ফেলে উপস্থিত জনেদের সেই কথা বলে দিলেন। আগামী ভবিষ্যতে কতকগুলি কথা ফলেও গেল_কিন্তু হয়তো কিছু ফলল না।
এমন কেন হল বলতো! কারন হচ্ছে স্থান – কাল-পাত্র পাল্টানোর সাথে সাথে মহাকালের বুকে ততদিনে আবার নিশ্চয়ই নতুন ‘আখর’ _ফুটে উঠেছে। যার ভাব আলাদা _যার ভাষা আলাদা!
এইজন্যই বলা যায় একমাত্র পরমজ্ঞানী বা পূর্ণজ্ঞানীরাই জানেন পরম সত্য কি! তাই ওরা বলেন যুগোপযোগী কথা! তাঁরা সকলকে সেই শিক্ষাই দেন _যা পালন করলে সমকালীন মানুষদের আধ্যাত্মিক উন্নতি হয় _ সকলের পূর্ণত্বের পথে অগ্রগতি বজায় থাকে! প্রকৃতপক্ষে জীবসমূহের সন্মুখগতি বজায় রাখতেই তো ঈশ্বরের অবতরণ!! পৃথিবীগ্রহের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন মহাপুরুষগন শরীর ধারণ করেন শুধুমাত্র একটা কারনেই _যাতে এইগ্রহের জীবসমূহের বিবর্তন এবং সংবর্তনের ধারা অব্যাহত থাকে!” (ক্রমশঃ)
[এই ব্যাখ্যা কে বর্তমান জীবন বিজ্ঞানের ডারউইনবাদ দিয়ে বোঝার চেষ্টা করলে বোকামি হবে। কারন ভারতীয় পুরানাদি শাশ্ত্র বেশ কয়েক হাজার বছর আগের লেখা। বিভিন্ন ‘তত্ত্ব’ সাধারণ মানুষের কাছে সহজে পরিবেশনের জন্য পুরান রচিত হয়েছিল]