গুরু মহারাজ স্বামী পরমানন্দ ভারতবর্ষের প্রাচীন শাস্ত্রাদি (বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, মহাকাব্য)-তে উল্লিখিত বিভিন্ন ঘটনা, কাহিনী বা বিভিন্ন চরিত্রগুলি নিয়ে নানারকম আলোচনা করতেন এবং সেগুলির আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্যাখ্যা করতেন । সেইগুলিই এখানে বলার চেষ্টা করা হচ্ছিলো !
ভারতবর্ষের সুপ্রাচীন সভ্যতা ও সংস্কৃতির কথা প্রাচীন ভারতের মুনি-ঋষি-মহাত্মা-মহাপুরুষদের কথা বলতে গিয়ে গুরুমহারাজের মুখমণ্ডল উজ্জ্বল হয়ে উঠতো ! ওনার বলা কথাগুলির পরতে পরতে যেন অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা, সম্মান ভালোবাসা ঝরে ঝরে পড়তো ! তাই বলে কি উনি ভারতবর্ষের বাইরের দেশের কোন কিছু ভালোর কথা বলতেন না – নিশ্চয় বলতেন ! যেখানকার যত কিছু ভালো – সেই গুলিকেই উনি বর্তমানের যুবক-যুবতীদের কাছে উপস্থাপনা করে তাদেরকে উৎসাহিত করতেন ! কিন্তু সমস্ত কিছু বলার পর উনি উদাহরণ সহযোগে প্রমাণ করে দিতেন যে, পৃথিবীর যেখানেই যত কিছু ভালো__ তা সে ধর্মীয়, রাজনৈতিক, সামাজিক, দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত ইত্যাদি যা-ই হোক না কেন – তার উৎস (Source) ছিল ভারতবর্ষ ! প্রাচীন ভারতের আর্য-ঋষিদের নিবিড় সাধনার ফসলই ভারত সহ সমগ্র পৃথিবীতে সভ্যতার আলো দেখিয়েছে, তাদের চেতনাকে উন্নত করেছে, তাদেরকে নতুন নতুন চিন্তার দিশা দেখিয়েছে ।
পৃথিবীতে যত রকম প্রাচীন ভাষা রয়েছে, সেগুলি সমস্তই জানতেন গুরুমহারাজ ! ফলে প্রাচীন ভারতবর্ষের ভাষা সংস্কৃতের সঙ্গে সেই ভাষায় ব্যবহৃত উল্লেখযোগ্য শব্দগুলির কোথায় কোথায় মিল রয়েছে, তা উনি সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিতেন এবং শেষে সেইসব শব্দগুলিই যে মূল সংস্কৃত থেকে গেছে__ আর কিভাবে তার উচ্চারণের পরিবর্তন হয়েছে – সেগুলিও উনি ভেঙ্গে ভেঙ্গে বুঝিয়ে দিতেন I কতদিন বনগ্রাম পরমানন্দ মিশন মিশনে এমন হয়েছে যে, দু-তিনশো মানুষ সিটিং-এ হাঁ করে ওনার সামনে বসে রয়েছে আর উনি ঘন্টার পর ঘন্টা প্রাচীন ল্যাটিন ভাষা এবং এখনকার ইতালিয়ান, ফ্রেঞ্চ, ইংরেজি ইত্যাদি ভাষার শব্দের সাথে সংস্কৃত শব্দের মিল নিয়েই আলোচনা করে যাচ্ছেন । হয়তো ২/৪ জনের উদ্দেশ্যে কথাগুলি উনি বলে যাচ্ছেন – কিন্তু বাকিরাও সেইসব কথাই শুনছেন বা বলা ভালো_ শুনতে বাধ্য হচ্ছে ! হয়তো তারা সবাই ব্যাপারটা বুঝতে পারছে না, হয়তো তাদের সকলে ইন্টারেস্টও পাচ্ছে না – তবু চুপচাপ বসে বসে গুরুমহারাজের শ্রীমুখ নিঃসৃত অমৃতবাণী শ্রবণ করে চলেছে ! এ এক আশ্চর্য ব্যাপার !!
আসলে ওনার উপস্থিতি, ওনার অপরূপ সৌন্দর্য, ওনার ম্যাজিক্যাল কণ্ঠস্বর এবং আশ্চর্য বলার ভঙ্গিমা, অনর্গল স্বতোৎসারিত কথামালার সামনে উপস্থিত মানুষজনেরা মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় বসে থাকতে বাধ্য হোতো ! এমন দু’চারটে সিটিং-এর সবটা যদি আপনাদের সামনে উপস্থাপনা করা যেতো – তাহলে হয়তো আপনারা সকলেই তার কিছুটা test পেতে পারতেন । কিন্তু তা তো আর হবার নয় ! তাই আমরা অন্য প্রসঙ্গে চলে যাই !
প্রাচীন ভারতীয় আর্য-ঋষিদের কথা বলা হচ্ছিল । উনি একবার বলেছিলেন – ” আমি যখন নিজেকে ‘আর্য’ ভাবি, তখন আমার মাথা উঁচু হয়ে যায়, মেরুদন্ড খাড়া হয়ে যায়, মনে হয় আমি সেই সুপ্রাচীন-সুসভ্য জাতির একজন বংশধর – যারা সমগ্র বিশ্বকে সভ্যতার আলো দেখিয়েছে ৷” আর্য-ঋষিদের ত্যাগময়, সাধনক্লিষ্ট জীবনের খুবই উদাহরণ দিতেন গুরুমহারাজ ! প্রাচীন ভারতেও রাজতন্ত্র ছিল – কিন্তু প্রতিটি আর্য-রাজাই রাজগুরুদের নিয়ন্ত্রণে চলতেন ! আসলে গুরুজনদের প্রতি শ্রদ্ধা-ভক্তি-সম্মান প্রদর্শন আর্যদের একটা অন্যতম culture ! সমাজের সর্বস্তরেই এই রীতি বজায় ছিল, এগুলি ছিল ধর্মাচরণের অঙ্গ ৷ যে বা যারা এইসব আর্যরীতিকে break করতো অর্থাৎ সেই অর্থে, অধার্মিক হয়ে পড়তো – তাদেরকেই দমন করে আবার ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠা করা হোত ৷
এইভাবেই রাবণ, কংস, জরাসন্ধ, দূর্যোধন-দুঃশাসনদের নিধন করতে হয়েছিল এবং এইসব অত্যাচারীদের স্থলে কোনো সাত্ত্বিক, ধার্মিক ব্যক্তিকে রাজার আসনে বসানো হয়েছিল ৷ আর এই কাজে সম্পূর্ণভাবে সহায়তা করতেন তৎকালীন সমাজের মাথারা বা সমাজ-শিক্ষকেরা অর্থাৎ ঋষিকুল ।
তবে অবশ্যই মানবজাতির প্রতি অত্যাচার বা অনাচার যখনই চরমসীমায় পৌঁছায় – তখনই জীবের প্রতি করুণাবশতঃ ঈশ্বরের শক্তির অবতরণ হয় মানুষের রূপে ৷ কিছুদিনের মধ্যেই ভক্ত মানুষেরা, আর্ত মানুষেরা জানতে পারে তাঁর উপস্থিতি ! তারপর আরো কিছুদিনের মধ্যেই যখন তাঁর মহিমা প্রকাশ হতে থাকে, তখনই অলিকুলের ন্যায় দলে দলে, ঝাঁকে-ঝাঁকে ভক্তরা ছুটে ছুটে এসে জড়ো হয় সেই মহামানবের পদপ্রান্তে ৷ শুরু হয়ে যায় ভগবানের নতুন লীলা ! দুষ্টের দমন এবং শিষ্টের পালন ছাড়াও মানুষের বিবেকের জাগরণ ও চেতনার উত্তরণের কাজটি তিনি স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে করে যান । এইভাবেই যুগপ্রয়োজনে যুগাবতারদের আগমন হয় বারে বারে !!