গুরু মহারাজ (স্বামী পরমানন্দ) ১৯৭৮ সালে বনগ্রাম পরমানন্দ মিশনের (প্রথমে নাম দিয়েছিলেন ‘ঠাকুরদাস আশ্রম’ । ওনার সন্ন্যাস নেবার পর ওনার গুরুদেব রামানন্দ অবধূত গুরুজীকে বলেন আশ্রমের নাম যেন ‘পরমানন্দ মিশন’ রাখা হয় ৷) প্রতিষ্ঠার পর ধীরে ধীরে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে এই মিশনের শাখা তৈরী হতে শুরু করে । তার মধ্যে প্রথম দিকে যেগুলি তৈরী হতে শুরু করেছিল সেগুলি হ’ল রায়না ‘তপোবন আশ্রম , সিঙ্গুর ‘তত্ত্বমসি যোগাশ্রম’ , আজিমগঞ্জ ‘কনশাস স্পিরিচ্যুয়াল সেন্টার’ , রসবেরুলিয়া ‘পরমানন্দ মিশন’ ইত্যাদি । এগুলির অনেক পরে আমাদের এখানে অর্থাৎ কাটোয়ার কাছে বারেন্দা আশ্রমের কাজ শুরু হয় । গুরু মহারাজ আশ্রমের এইসব আশ্রমের শাখা শুরু হবার আগে থেকেই ঐ অঞ্চলে বা ঐ স্থানগুলিতে যাতায়াত করতেন । তাঁর আসা যেন অব্যাহত থাকে ও নিয়মিত হয় এবং সেখানে সবাই যাতে একসাথে থাকতে পারে সেইজন্যেই স্থানীয় শিষ্য-ভক্তরা মিলে ছোটখাটো একটা আশ্রম তৈরীর কথা ভাবতো!
গুরু মহারাজ জানতেন যে divine – planঅনুযায়ীই এইসব হচ্ছে – কিন্তু আমরা সাধারণ ভক্তরা তো অতশত জানতাম না ! একটা প্রবল উৎসাহ – উদ্দীপনা – অনুপ্রেরণা কোথা থেকে এসে হাজির হোত – আর সেই স্রোতে, অনেকে মিলে ভেসে গিয়ে দুদ্দার করে কাজের অগ্রগতি হোত ! কিছুদিনের মধ্যে সেইসব স্থানে (divine plan অনুযায়ী যে সব স্থানে আশ্রমের শাখা হবার কথা) একটা বা দুটো ঘর বিশিষ্ট আশ্রমের একটা শাখা তৈরী হয়ে যেতো । হয়তো ঘরের সাথে একটা টিউবওয়েল বসানো হোত আর গুরু মহারাজ আসবেন ও থাকবেন তাই একটা পায়খানা বাথরুম তৈরী করা হোত ৷ ব্যস ! Start হয়ে গেল পরমানন্দ মিশনের শাখার কাজ ! এবার ঐ নতুন তৈরী আশ্রমে গুরু মহারাজের ঘরের (নতুন তৈরী) ভিজে ভাব থাকতে থাকতেই গুরু মহারাজ এসে হাজির হতেন ! গুরু মহারাজ একবার এই প্রসঙ্গে বলেই ফেললেন – ” মা জগদম্বা এটাই যেন আমার জন্য নির্দিষ্ট করে রেখেছেন – আমি যখন যেখানেই প্রথম যাই – সেখানেই বেশীরভাগ ক্ষেত্রে আমাকে সদ্য তৈরী হওয়া ঘরে(অর্থাৎ ভিজে-স্যাঁতসেতে ঘরে) থাকতে হয় !” Divine plan কথাটা বারবার বলা হচ্ছে এইজন্য যে _সেই সময় আমরা শুনেছিলাম, বিভিন্ন স্থানে খুব ধনীলোকেরা বড় বড় plot গুরুমহারাজের আশ্রম করার জন্য দিতে চেয়েছিল _কিন্তু গুরুমহারাজ গ্রহণ করেন নি।
সে সব কথা থাক, আমরা বারেন্দা আশ্রমের কথায় আসি। আমরা কাটোয়ার কাছে বারেন্দা গ্রামে (অজয় নদের তীরে) যখন প্রথম পরমানন্দ মিশনের শাখা তৈরীর কাজ শুরু করি (গুরু মহারাজের অনুমতিক্রমে) তখন সামনের দিকে একটা ঘর আর একটা টিউবওয়েল দিয়েই শুরু হয়েছিল ৷ পরে (১৯৯৫/৯৬ সালে) যখন ঐ আশ্রমে গুরু মহারাজ আসতে পারবেন এটা প্রায় স্থির হয়ে গেল – তখন আশ্রমের ঈশান কোণে গুরু মহারাজের ঘর cum ঠাকুরঘর তৈরীর কাজ শুরু হোল । বান-বন্যার প্রকোপ এখানে খুবই – তাই ইঁট-মাটির (গালার গাঁথনি) গাঁথনি – উপরের প্লাষ্টার শুধুই মাটি দিয়ে __এইরকম একটা ঘর হোল ৷ আর যেহেতু বনগ্রামে আমরা তখন দেখেছিলাম গুরু মহারাজ ওনার ঘরে মাটির তৈরী বেদীতে শুতেন – তাই এখানেও ৫” (পাঁচ ইঞ্চি) ইঁটের গাঁথনি করে একটা খোল তৈরী করে ভিতরে মাটি ভরাট করে উপরটা মাটির কাদা করে সমান করে দেওয়া হোল ।
তখন এই কাজে প্রধান রূপকার ছিল চরখী গ্রামের (অাশ্রমের পাশের গ্রাম) সুব্রত চট্টোপাধ্যায় ৷ আর বারেন্দা আশ্রম তৈরির কাজে চরম সহযোগীতায় যারা ছিল তারা হ’ল যতীনপুরের’ দুর্গা’ ও স্টার -ইঁটভাটার মালিকেরা, বিশেষত ম্যাকমিলন এবং প্রভাত_বারেন্দা গ্রামের মাষ্টারমশাই লক্ষী(ফুচিং)গোপাল ঘোষ , সমর ঘোষ , ব্রজগোপাল ঘোষ , তপন ঘোষ , ধর্মদাস ঘোষ,পাঁচু মাহান্ত, দিনবন্ধু, সুজিত প্রমুখরা ! গ্রাম থেকে বাঁশ-খড় জোগাড় করে ওরা সদ‍্য তৈরী হওয়া ঘরের ছাঁটামো (উপরের চালের structure) করে, অতি দ্রুত খড় জোগাড় করে ছাইয়েও ফেলল ৷ তারপর ঘরের ভিতরটা এবং বাইরেরটা লেপে-পুঁছে ঝরঝরে পরিস্কার করে দেওয়াও হোল । সেই সময় সুব্রত (ও ছিল পঞ্চায়েতের কর্মী , মাঝে মাঝেই ব্লক অফিসেও যেতে হোত । ফলে অনেক লোকের সাথে ওর যোগাযোগ ছিল) একজন রোড কনট্রাক্টরের (কিরীটি চক্রবর্ত্তী , কাঁদরা) সাথে যোগাযোগ করে একজন চিত্রশিল্পীকে এনে গুরু মহারাজের সদ্যনির্মিত ঘরের দরজার দুপাশে দুটো বাউলের ছবি (যেটি তখনকার চরৈবেতি পত্রিকার প্রচ্ছদে থাকতো ! শিবনেত্র উদাস বাউলের ছবি ৷) আঁকিয়ে ফেলল।
গুরু মহারাজের ঘরের তিনদিকে বারান্দা করা হয়েছিল ৷ গুরু মহারাজের ঘরটি ছিল দক্ষিন-দুয়ারী (আজও আছে) , পশ্চিম দিকের বারান্দার সংলগ্ন স্থানে মোটামুটি বায়ুকোণের দিকে ওনার জন্য একটা পায়খানা-বাথরুম বানানো হয়েছিল (অবশ্য তখনও আশ্রমে অন্য কোন পায়খানা-বাথরুম ছিল না)। কিন্তু এত কান্ড করলে কি হয় – ঘরটি সদ্য তৈরী হবার পর পরই এর ছাউনির ব্যবস্থা করতে গিয়ে ঘরের দেওয়াল, মেঝে বিশেষ করে গুরু মহারাজের শোয়া – বসার জন্য নবনির্মিত মাটির বেদী_এগুলি তো শুকায় নি! স্যাঁতসেতে ভিজে ছিল। সেই নিয়েই এখনকার গল্প, কিন্তু তার আগে এখানে একটু পূর্বকথা বলে নেওয়া যাক!
আমরা জানতাম যে আজিমগঞ্জ আশ্রমে যাবার পথে( ২৫-ডিসেম্বর, জন্মদিন উপলক্ষে) অথবা আসার পথে গুরুমহারাজ বারেন্দা আশ্রম এবং আমাদের বাড়িতে (রশুই গ্রামের বাড়িতে) আসবেন। কিন্তু ঠিক কবে আসবেন _সেই exact date – টা জানতাম না। এর কয়েক বছর আগে (1990-91সালে) গুরুমহারাজ আমাদের গ্রামের বাড়ি এসেছিলেন। তখন এই অঞ্চলে গুরুমহারাজের ভক্তসংখ্যা খুবই কম ছিল। পরে বুঝেছিলাম _ওনার ঐ আসা কে কেন্দ্র করেই পরবর্তীতে এখানে আশ্রম গড়ে উঠবে, ভক্তকুল ছুটে আসবে __ওটা যেন তারই পূর্বসূচনা ছিল।
তখন আমাদের এখানে আশ্রমের ভক্ত বলতে ধীরুভাই(রশুই) এবং জহরদা(জহর ঘোষ। ধানডুগী)! ব্যস! আর কেউ ছিল না।
গুরুমহারাজের প্রথমবার আমাদের বাড়িতে আগমন উপলক্ষে সেই সময় আমাদের বন্ধুবান্ধব, কিছু আত্মীয় – স্বজন এবং তখন যারা চরৈবেতি পত্রিকার গ্রাহক ছিল _তাদেরকে আমন্ত্রণ করা হয়েছিল। সকলের খাওয়া-দাওয়ার ও ব্যবস্থা ছিল। সেই উপলক্ষে চরখীর (বারেন্দা আশ্রমের পাশের গ্রাম) সুব্রত চট্টোপাধ্যায় এবং ওর সুহৃদ দোল দা(দোলগোবিন্দ মন্ডল) গুরুমহারাজকে দর্শন করতে এসেছিল! স্বভাবতই প্রথম দর্শনেই ওদের ভালো লেগে গেল _আর পরবর্তীতে ওদের হাত ধরেই ‘বারেন্দা আশ্রম’ প্রতিষ্ঠার এবং এই অঞ্চলে ভক্তসংখ্যা বাড়ার পটভূমিটাও তৈরি হয়ে গেল।
প্রথমবার আমাদের বাড়িতে (রশুই গ্রামে) গুরুমহারাজের আগমনের বিস্তৃত বিবরণ পরে দেওয়া যাবে। বারেন্দা আশ্রম তৈরির ইতিহাসও পরে বলা হবে। এখন বারেন্দা আশ্রমে গুরুমহারাজ আসার ঠিক আগের অবস্থা(সেই সময় গুরুমহারাজের মতো মহাপুরুষকে সেবাযত্ন করা বা সিটিংয়ের arrangements এর ব্যাপারে আমরা একেবারেই অনভিজ্ঞ ও অপটু ছিলাম) বলার চেষ্টা করি।
আগেই বলেছিলাম _তখন গুরুমহারাজ কোথায় কখন যাবেন __তার list তৈরি করতেন তৃষাণ মহারাজ(স্বামী পরমেশ্বরানন্দ)। সেই সময় আমি বনগ্রামে গেছিলাম _ প্রথমবার গুরুমহারাজ আসবেন বারেন্দা আশ্রমে এবং তারপর আমাদের বাড়িতে, তার date আনার জন্য। আশ্রমে পোঁছানোর পর আমি তৃষাণ মহারাজকেই date জানতে চাইলাম। উনি বললেন _”গুরুমহারাজকে একবার বল_তারপর আমি যা করার করব।তবে জানবে গুরুমহারাজ আগে বারেন্দা আশ্রমে যাবেন _তারপর তোমাদের বাড়ি!”
দুপুরে খাওয়ার পর আমি গুরুমহারাজের ঘরের কাছে গিয়ে দেখলাম ঘর বন্ধ। ভয়ে ভয়ে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ওনাকে আস্তে করে ডাকতেই উনি ভিতরে যাবার অনুমতি দিলেন(গুরুজীর ঘরে ঢোকার সময় কেন জানিনা ভীষণ ভয় ভয় করতো, তারপর দু-একটা কথা বলতে শুরু করলেই একদম free হয়ে যেতাম।” বললাম _”গুরুজী! আপনি বলেছিলেন আমাদের ওখানে বা বারেন্দা আশ্রমে আপনি যাবেন _তাহলে এবার কি আজিমগন্জ যাওয়া আসার পথে যাওয়া যাবে?”
উনি বললেন _” তৃষাণের সাথে কথা বলে ঠিক করে নে!” সে কথা শুনে আমার আনন্দ দেখে কে! গুরুমহারাজকে প্রনাম করে ঘরের বাইরে বেড়িয়ে আসছি _দেখি বাইরে তৃষাণ মহারাজ দাঁড়িয়ে! উনি বললেন _” গুরুজী কি বলল?”
আমি বললাম _” উনি যাবেন, কিন্তু দিনটা আপনাকেই ঠিক করতে হবে!” সেদিনই তৃষাণ মহারাজ আমাকে date টা বলে দিলেন _10/11ই ডিসেম্বর। (ক্রমশঃ)