গুরুমহারাজ যখন প্রথমবার বারেন্দা আশ্রমে এসেছিলেন -সেইসময়কার কথা হচ্ছিল। উনি সেবার নবদ্বীপ থেকে এসেছিলেন। নবদ্বীপের ভক্তেরা(রবীন মালাকার, গৌর,প্রলয়, শিবু প্রমুখরা )একটা বড় গাড়ি ভাড়া করে গুরুমহারাজকে নিয়ে আমাদের বারেন্দা আশ্রম অবধি পৌঁছে দিয়েছিল।রবীন মালাকার ঐ গাড়িতে গুরুমহারাজের সঙ্গে এসেছিল। গুরুমহারাজ আশ্রমে ঢুকে পড়ার পর -আর তো অন্য কারো দিকে নজর যেতো না! তাই ওরা কজন ছিল, কতক্ষণ ছিল এসব কথা বেশি মনে নেই। তবে এটুকু মনে আছে যে ওরা বেশিক্ষণ ছিল না,ঐ গাড়িতেই ফিরে গিয়েছিল -তবু এর মধ্যেই ওদেরকে একটু মিষ্টিজল খাইয়ে দেওয়া হয়েছিল!
গুরুমহারাজ গাড়ি থেকে নেমে গটগট করে হাঁটতে হাঁটতে একেবারে সোজা ওনার জন্য নতুন তৈরি ঘরের বারেন্দায় গিয়ে উঠেছিলেন দেখে আমরা একটু অবাকই হয়েছিলাম! পরে অবশ্য আমরা বুঝতে শিখেছিলাম –ওনার আবার অজানা কি! আমাদেরই ভাবনার ভূল!
আমার মনে পড়ে যাচ্ছিল –প্রথমবার যখন গুরুমহারাজ আমাদের বাড়িতে (রশুইগ্রামে ) এসেছিলেন -সেইদিন টির কথা! গুরুমহারাজ করুইগ্রাম (মামা মহারাজ বা স্বামী কেশবানন্দের গ্রাম অর্থাৎ তপিমাদের মামার বাড়ি )থেকে এখানে এসেছিলেন! বর্ধমানের তপনদার (তপন রায়, খালবিলমাঠ,বর্ধমান )মটর সাইকেলে চেপে এসেছিলেন!
তপনদা আমাকে পরে বলেছিল -“আমি তো শুধু গাড়ি চালাচ্ছিলাম -পথের সমস্ত direction গুরুমহারাজ পিছনে বসে বসে দিয়ে যাচ্ছিলেন! ”
কাটোয়া থেকে আমাদের গ্রামে আসার তখন সোজাসুজি কোন রাস্তা ছিল না। অজয় নদীর পাড় পর্যন্ত তখন পাকা রাস্তা ছিল।ঐখানে মটর সাইকেল থেকে গুরুমহারাজ নেমেছিলেন । ওখান থেকে নদীর চড়াটা অর্থাৎ নদীর বালি এবং বাঁশের তৈরি ছোট্ট ব্রীজ পায়ে হেঁটে পার হতে হোত । বালির চড়ার উপর মাটি ফেলে ফেলে সাইকেল বা মটর সাইকেল যাবার একটা রাস্তা তৈরী করত ঘাটের মাঝি এবং সাইকেল পিছু ১ টাকা এবং মোটর সাইকেল পিছু ২ টাকা করে নিত ! তপনদা মোটর সাইকেলে চেপে এসেছিল আর গুরু মহারাজ পুরো নদীর খাতটি (দুই পাড়ের মধ্যবর্ত্তী অঞ্চল) হেঁটে হেঁটে এসেছিলেন ৷ পরে শুনেছিলাম উনি ঘাটের মাঝিকে পয়সাও দিয়েছিলেন । এপাড়ে পৌঁছানোর পর আবার পাকা রাস্তা – যেটা বোলপুর পর্যন্ত গেছে বা নতুনহাট ব্রীজ পেড়িয়ে বর্ধমানও যাওয়া যায় ৷ যাই হোক , নদীর চড়ার উপর দিয়ে কষ্ট করে মোটরসাইকেল চালিয়ে তারপর বাঁশের ব্রীজ পেড়িয়ে পাড়ে উঠে পাকা রাস্তা পাবার পর তপনদা স্ফূর্তি করে বেশ স্পীডে মোটরসাইকেল চালিয়ে চলে যাচ্ছিল ! হঠাৎ গুরু মহারাজ ওর পিঠে একটা চাপড় মেরে বলেন – ” এই ! বাঁ দিকে মাটির রাস্তাটি ধর ! এই গ্রামটাই তো শ্রীধরদের গ্রাম !” (তখন আমাদের গ্রামে ঢোকার রাস্তাটা কাঁচা রাস্তা বা মাটির রাস্তা ছিল ! মোটর সাইকেলে পিছনে বসে অাসতে গেলে – গোটা গায়ে ধূলোয় ধূসরিত হতে হোত ! ঐ ভাবেই করুণাময় ভগবান এই গ্রামে – এই বাড়ীতে এসেছিলেন ।
ওসব কথা এখন থাক্ – পরে হবে । বারেন্দা আশ্রমে পৌঁছেই ওনার নিজের ঘরের দিকে হাঁটার ব্যাপারটা বলতে গিয়েই – এত কথা প্রাসঙ্গিকভাবে চলে এল ! তাই আর একটু বলে নিই – এখানেও (রসুই গ্রামে) তো উনি আগে আসেন নি ! কিন্তু তপনদাকে কত সুন্দরভাবে direction দিয়ে ‘ডানদিক’ , ‘বাঁদিক’ করতে করতে আমাদের বাড়ি পৌঁছে গেলেন! তারপর আমাদের বাড়ীতে ঢুকেই বলেছিলেন – ” আমি তো কোন সকালে তোদের বাড়ী পৌঁছে গেছি ! দেখতে পাচ্ছিলাম তোরা অপেক্ষা করছিস – ওদিকে রান্নাবান্না হচ্ছে ! বাড়ীতে অনেক লোক ! শুধু শুধু ওরা জোর করে আটকাচ্ছিল, তাই বেরোতে দেরি হয়ে গেল!”
সুতরাং এটা জানতাম যে, ওনার আবার নিজের ঘর চিনে নেওয়ার কি অসুবিধা ! তাইতো গাড়ি থেকে নেমে সোজা হেঁটে গিয়ে বারেন্দা আশ্রমে ওনার ঘরের বারান্দায় গিয়ে বসেছিলেন!
ওনার সাথে নবদ্বীপ থেকে তৃষাণ মহারাজও এসেছিলেন ৷ তখন তো আশ্রমে দুটো মাত্র ঘর – একটা প্রথমেই করা হয়েছিল — সেই ঘরে একটা চৌকিও ছিল – সেই চৌকিতে তৃষাণ মহারাজকে থাকতে দিয়ে আমরা রাতে মেঝেতে বা এখানে ওখানে শুয়ে থাকার পরিকল্পনা নিয়েছিলাম। তবে রাত্রে তৃষাণ মহারাজ গ্রামে এক ভক্তের বাড়ীতে শুতে চলে গিয়েছিলেন (আমাদের শোয়ার অসুবিধা দেখেই হয়তো)৷
যাইহোক , সেদিন গুরু মহারাজ আসবেন শুনে সকাল থেকেই আশ্রমে অনেক লোক জড়ো হয়ে গিয়েছিল ৷ আসলে ১৯৯০/৯১ সালে গুরু মহারাজ প্রথমবার আমাদের বাড়ী আসার পর থেকেই এই অঞ্চলে ভক্তসংখ্যা বাড়তে থাকে । ‘চরৈবেতি’ পত্রিকার গ্রাহকসংখ্যা বাড়ানোর সাথে সাথে বনগ্রাম আশ্রম এবং গুরু মহারাজ (স্বামী পরমানন্দ) সম্বন্ধে এই অঞ্চলের মানুষের একটা খোঁজ পড়ে যায় ৷ ফলে ১৯৯৪/৯৫ সালে গুরু মহারাজ যখন বারেন্দা আশ্রমে এসেছিলেন তখন – আমাদের গ্রামে (রসুই) ধীরুভাই , মুকুল ছাড়াও মনিকা , কানন , বকুল ব্যানার্জী __ এরা সব ইতিমধ্যে গুরু মহারাজের কাছে দীক্ষা নিয়েছিল ৷ চরখী গ্রামে সুব্রত চ্যাটার্জী ও তার পরিবারের লোক, বারেন্দা গ্রামে যারা আশ্রমের জায়গা দান করেছিল অর্থাৎ সুদেব মন্ডল এবং তার পরিবার , ধর্মদাস ঘোষ , লক্ষ্মী মাষ্টার , সমর ঘোষ , ব্রজগোপাল , দীনবন্ধু , সুজিত , তপন এবং এইসমস্ত পরিবারের লোকজনেরাও আশ্রমে গিয়ে দীক্ষা নিয়ে এসেছিল ৷ যতীনপুর গ্রাম থেকে ম্যাকমিলনের পরিবারের লোকজন , প্রভাত এবং আরও দু-একজন , কোশিগ্রামের গোবিন্দ , সুনীল প্রমুখেরা , কাটোয়ার বেশ কিছু মানুষজন এবং ধানডুগি গ্রামের জহর ঘোষ এবং তার পরিবারের প্রায় সমস্ত লোকজন গুরু মহারাজের কাছে দীক্ষা গ্রহণ করেছিল । এছাড়াও তেওড়া গ্রামের প্রৌঢ় রামময় দে মহাশয়ের আগ্রহে ঐ গ্রামের একঝাঁক তরুণ-তরুণী বনগ্রাম আশ্রমে গিয়ে দীক্ষা নিয়েছিল ৷ চুড়পুনি গ্রামের সুজিত গুপ্ত (পানু) এবং ওর পরিবারের লোকজন ভীষণভাবে বারেন্দা আশ্রমের পৃষ্ঠপোষকতা করত ৷
এই সমস্ত ভক্তবৃন্দরা তাদের পরিবারের লোকজন ছাড়াও “গুরু মহারাজ আসছেন”– এই খবরটা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ায় প্রচুর লোকজন ঐদিন আশ্রমে এসে জড়ো হয়ে গেছিল । সুতরাং গুরু মহারাজ আশ্রমে ঢোকার পর মাত্র ১৫/২০ মিনিট ঘরে থেকেই__মানুষজনের অনুরোধে বাইরে বেড়িয়ে এলেন ! ওনাকে বারান্দায় একটা আসন পেতে দেওয়া হোল – উনি ওখানেই বসলেন (চেয়ারে বসার জন্য অনুরোধ করা হয়েছিল – উনি রাজি হন নি) – সামনের ফাঁকা জায়গায় ত্রিপল পেতে দেওয়া হয়েছিল। সেখানেই সমস্ত ভক্তরা বা বহিরাগতরা বসে পড়ল। আমাদের একটু ভয় ছিল যে এখানকার লোকজন, বিশেষত young generation যদি গুরুমহারাজের প্রতি অতটা ভব্যতা, ভদ্রতা দেখাতে না পারে! তাই আমরা কয়েকজন সিটিং এর জায়গার চারিদিকে ছড়িয়ে থাকলাম –যাতে কেউ কোন অভব্যতা করলে তাকে নিরস্ত করতে পারি!
কিন্তু আমরা যেমন সামান্য -তেমনি সামান্য আমাদের বুদ্ধির দৌড়! যাঁর জগৎ -তিনি তো সবই জানেন! পৃথিবীর যাবতীয় প্রতিকূলতার মোকাবিলা করে তবেই ‘পূর্ণতা’ প্রাপ্ত হতে হয় -আর যিনি পূর্ণ তাঁর আবার প্রতিকূলতা কি! !
মনে পড়ে যাচ্ছে–গুরুমহারাজ বলেছিলেন , “পাঞ্জাবে যখন চরম বিশৃঙ্খলা চলছিল (লঙ্গোয়াল আর ভিন্দ্রনওয়ালের নেতৃত্বে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন চলছিল তখন )-তখন আমি একা একা সমস্ত উপদ্রুত অঞ্চলগুলি(গুরুদাসপুর,অমৃতসর ইত্যাদি স্থান) ঘুরছিলাম ! দেখছিলাম -আমার স্থুলশরীরের উপর এর কোনপ্রকার প্রভাব পড়ে কি না! কিন্তু দেখলাম কি জানো -যে অঞ্চল দিয়ে আমি চলে যাচ্ছিলাম, ঠিক তার আগে আগে ওখানে ঝামেলা হয়ে গেছে -পরে আর কোন কিছু হয় নি(ওনার পাঞ্জাব প্রদেশ ঘুরে আসার পরেই ধীরে ধীরে পাঞ্জাব শান্ত হয়ে যায় ।)!
আমাদের সমস্ত প্রস্তুতিকে ব্যর্থ করে বারেন্দা আশ্রমেও চরম অঘটন ঘটেছিল _এবং তার মোকাবিলা গুরুমহারাজ স্বয়ংই করেছিলেন! সে সব কথা আগামী এপিসোডে…..! (ক্রমশঃ)