গুরু মহারাজ স্বামী পরমানন্দের বিভিন্ন সিটিং-এ তাঁর বলা কথা নিয়ে আলোচনা হচ্ছিলো ৷ সেই প্রসঙ্গে আমরা আলোচনা করছিলাম যে, যেকোনো মহাপুরুষের শিক্ষা বেশিরভাগ মানুষ গ্রহণই করে না, কিছু কিছু মানুষ হয়তো গ্রহণ করে । কিন্তু যারা গ্রহণ করে, তারা কি ১০০ভাগ তা গ্রহণ করে – করে না ! ১০০ভাগ গ্রহণ করার লোক “কোটিতে গুটিক”! স্বামী পরমানন্দের প্রতিষ্ঠিত একটি আশ্রম রয়েছে আজিমগঞ্জে – “কনশাস্ স্পিরিচুয়াল সেন্টার”। গুরুমহারাজ এই ধরনের নামকরণ করেছিলেন (‘এই ধরনের’- বলতে ইংরাজী নামকরণ) খুব সম্ভবত উনি পরমানন্দ মিশনের বিদেশাগত ভক্তদের কথা ভেবে ! যাতে করে তারা সুদূর ইউরোপের দেশগুলি থেকে এসে নির্জন-নিরিবিলি গঙ্গার ধারে অবস্থিত আজিমগঞ্জের এই আশ্রমটিতে শান্তভাবে ধ্যান-জপ করতে পারেন, নিজেদের মধ্যে বা গুরুভ্রাতাদের সাথে ধর্মালোচনা করতে পারেন। নিজেদের সাধারণ বিষয়ক সমস্যা বা আধ্যাত্মিক উন্নতির বিষয়ে পরামর্শ দেওয়া-নেওয়া করতে পারেন।
গুরু মহারাজ আজিমগঞ্জে সাধারণত শীতকালেই থাকতেন (ব্যতিক্রম নিশ্চয়ই ছিল), আর ইউরোপীয় ভক্তরা শীতকালেই ইন্ডিয়ায় আসাটা পছন্দ করতো (কারণ ওদের দেশগুলিতে শীতকালে প্রচন্ড শীত পড়ে, তুলনায় ইন্ডিয়ায় শীত কম, যেটা ওদের কাছে comfortable)– তাই গুরুমহারাজ আজিমগঞ্জে গেলে অনেক ইউরোপীয় ভক্তদেরকে আমরা ওখানে থাকতে দেখতাম ৷ ইউরোপ থেকে তখন দুজন ‘জনি’ (আমার জানা) আসতো – একজন ‘জনি প্লত্’ নরওয়ে থেকে, তার বিশাল চেহারা ! সে আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্যবিভাগের কর্মী ছিল, বড় পোস্টে চাকরি করতো! আমরা এটা জানতে পেরেছিলাম কারণ __ও একবার এখানে এসে বিশ্রীভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল – তাই ওর দেশ থেকে ওর জন্য বিশেষ বিমান এসেছিল কোলকাতা বিমানবন্দরে ! যে বিমানে অপারেশন থিয়েটার সমেত সমস্ত Medical facility ছিল ! যাইহোক, আর একজন ‘জনি’ ছোটখাটো চেহারার – সে ছিল পাক্কা গেঁজেল !
গুরুমহারাজ ওর কথা পরবর্তীতে বনগ্রামে ন’কাকাদের বাড়িতে বলতে গিয়ে সে কি হাসি ! উনি বলেছিলেন – ” জানো ন’কাকা ! অবাক করার মতো ব্যাপার এই যে, এই ‘জনি’ তো বাংলা বলতে জানে না – বাংলা কথা বোঝেও না । তাহলে ও বনগ্রামে আসার অল্প সময়ের মধ্যেই ঠিক গাঁজার ‘ঠেক’ খুঁজে পেল কি করে ? এখানে আসার দু-এক দিনের মধ্যেই দেখি ভূমিজ পাড়ার এমন লোকের সাথে মিশছে,যারা ঐ পথের পথিক! তারপর ওকে আমি সঙ্গে করে আজিমগঞ্জ আশ্রমে নিয়ে গিয়েছিলাম – ও সেখানেও ঠিক গেঁজেল বন্ধু জুটিয়ে ফেলেছিল ! তবে ও ধ্যান-জপ করতো ! আমি চলে আসার পরও ও কিছুদিন ওখানে থেকে গেছিলো ৷ জানো ন’কাকা ! ‘জনি’ আজিমগঞ্জ কথাটাই উচ্চারণ করতে পারতো না – বলতো “আকিম্-কঞ্”! কিন্তু সেই লোকটাই গেঁজেলদের সঙ্গে কিভাবে ভাব বিনিময় করতো – এটা অবাক করার মতো ঘটনা নয় কি !”
এখন 2021 সাল পড়ে গেল ! আর সেদিন নাই ! সে “রাম”-ও নাই সে “অযোধ্যা”-ও নাই। তবু আজিমগঞ্জে এখনো ‘কনসাস স্পিরিচুয়াল সেন্টার’ রয়েছে ! ওই আশ্রমের এখন দায়িত্বে যে মহারাজ রয়েছেন – তার নাম স্বামী কৃষ্ণানন্দ মহারাজ, উনি গুরুমহারাজের প্রায় প্রথমদিকেরই ব্রহ্মচারী ছিলেন (দ্বিতীয় বা তৃতীয় দলের ব্রহ্মচারী), পরে সন্ন্যাস নিয়েছিলেন ।
আজিমগঞ্জে স্বামী পরমানন্দ প্রতিষ্ঠিত আরও একটি কেন্দ্র রয়েছে – “শতভিষা”! যেখানে সমাজের নিচের দিকে থাকা পরিবারের মহিলারা যাতে স্বনির্ভর হতে পারে _ সেইজন্য গুরুমহারাজ তখন তিন-চারজন ত্যাগব্রতী মহিলাকে বাংলাদেশ থেকে “কাঁথাস্টিচ” বা অন্যান্য “নিটিং”-এর ট্রেনিং দিয়ে নিয়ে এসেছিলেন । সেই থেকে ওখানেও সেবামূলক কাজ-কর্ম চলে আসছে৷ এছাড়াও আজিমগঞ্জে আরো পরমানন্দ ভাবধারার আশ্রম পরবর্তীতে হয়েছে ৷ সেইসব স্থানেও অনেক মানুষ যাওয়া-আসা করে, পরমানন্দ ভাবধারার সাথে পরিচিত হয় – পরমানন্দের শিক্ষা জীবনে গ্রহণ করে – সেইভাবে জীবন গঠন করার চেষ্টা করে । এসব কথা শুনে খুবই ভালো লাগে ! গুরুমহারাজের ভাবধারা যত ছড়িয়ে পড়বে – ততই তো জীবের মঙ্গল !
কিন্তু আজিমগঞ্জ আশ্রমের কৃষ্ণানন্দ মহারাজ একদিন বললেন – পরবর্তী প্রজন্মের কিছু তরুণ যুবক যারা ব্রহ্মচারী বা নিঃস্বার্থ কর্মী হিসেবে “কনসাস স্পিরিচুয়াল সেন্টার”-এর বাইরে থেকে কাজ করে চলেছে – তাদের সাথে কৃষ্ণানন্দ মহারাজের রাস্তা-ঘাটে, বাজারে প্রায়শই দেখা হয় (একই স্থানে থাকার সুবাদে)! কিন্তু পাশ কাটিয়ে চলে গেলেও ঐ সমস্ত যুবকেরা পরমানন্দ মিশনের একজন সিনিয়র মহারাজ (স্বামী কৃষ্ণানন্দ)-কে প্রণাম করা বা অন্যভাবে সম্মান প্রদর্শন করা তো দূরের কথা – তাঁর সাথে মিনিমামৃ সৌজন্য প্রদর্শন বা কুশল বিনিময়টুকুও করে না !
এইকথা শুনে খুবই খারাপ লাগলো – খুবই কষ্ট পেলাম । আজকাল অনেক আশ্রমের ক্ষেত্রেই এই অভিযোগ টা খাটে। ছোটরা বড়দের সম্মান করে না! এটা খুবই কষ্টের!
শুধু কৃষ্ণানন্দ মহারাজের ক্ষেত্রে কেন – যেকোনো সিনিয়র মহারাজের সাথে যে কোনো আশ্রমে এমনটা ঘটলেও আমরা সমানই কষ্ট পাবো । অধ্যাত্ম জগতে এসে যদি জুনিয়ররা সিনিয়রদের সম্মান না করে, শ্রদ্ধা প্রদর্শন না করে – তাহলে সমাজের সাধারণ মানুষেরা তা করবে কেন ? এর উপরেও একটা কথা আছে, সেটা হোলো __আমার ব্যবহারে অন্য কেউ ব্যাথা পেলে তো সেটা আমার আধ্যাত্মিক উন্নতির পথে চরম বাধাস্বরূপ (সনাতন গোস্বামীর জীবনের ঘটনায় এর চরম দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়)। তাছাড়া এইটা কি শিক্ষা ? এটা তো স্বামী পরমানন্দের শিক্ষা নয় ! এটাতো ভারতীয় পরম্পরা, বৈদিক বা ঔপনিষদিক পরম্পরার শিক্ষা নয় ! বেদ বলেছে “শ্রদ্ধা দেয়ম্”, উপনিষদে রয়েছে “শ্রদ্ধাবান লভতে জ্ঞানম”। প্রকৃত জ্ঞান অর্থাৎ আত্মজ্ঞান বা ব্রহ্মজ্ঞান লাভ যদি মানবজীবনের উদ্দেশ্য হয় তাহলে জ্ঞানলাভের প্রথম শর্তই হলো “শ্রদ্ধা”! এ ব্যাপারে সকলকে সচেতন হোতেই হবে ৷ যে আশ্রমে যিনিই দায়িত্বে রয়েছেন_তাঁকেই এ ব্যাপারে নজর দিতে হবে। ছোটদেরকে শেখানোর দায়িত্ব তো বড়দের‌ই!
গুরু মহারাজ স্বামী পরমানন্দ বারবার বলতেন_”লোকে তোদেরকে দেখেই আমাকে চিনবে!” তাই আমরা, যারা(ছোট অথবা বড়) গুরুজীকে জীবনের ধ্রুবতারা করে নিয়েছি_আমাদের অনেক দায়িত্ব! আমাদের নিজেদেরকে ঠিকমতো করে গড়ে তোলার দায়িত্ব‌ও আমাদেরকেই নিতে হবে।।(ক্রমশঃ)