শ্রী শ্রী গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দ বলেছিলেন – ” পৃথিবীতে সৎ ব্যক্তি অনেক পাওয়া যায়, কিন্তু সৎসাহস রয়েছে এমন ব্যক্তির বড়ই অভাব।” আমরা গুরুমহারাজের বলা যে চারটি মুখ্য জীবনাদর্শের কথা বলছিলাম – তাতে উন্নত মানবের প্রথম আদর্শ হিসাবে বলা হয়েছিল ‘সদাচারে’র কথা ! ঐরূপ সদাচারী ব্যক্তিগণ অবশ্যই সৎসাহসের অধিকারী ! সৎসাহসের অন্যতম পরিচয় হোল – যে কোনো অন্যায়ের প্রতিবাদ করা এবং পারলে সেই অন্যায়ের প্রতিকার করা বা ন্যায়কে প্রতিষ্ঠা করা !
তবে, সমাজে কোনো ‘ন্যায়’কে সঠিকভাবে প্রতিষ্ঠা করা সহজ কাজ নয় – এরজন্য খুবই শক্তির প্রয়োজন হয়। তাই কোনো মহাপুরুষ অর্থাৎ যাঁর মধ্যে ঈশ্বরীয় শক্তির বিশেষ প্রকাশ (জন্ম-জন্মান্তরের সাধনার ফলে যিনি সেই শক্তি অর্জন করেছেন অথবা ঈশ্বর-আদিষ্ট হয়ে শরীর ধারণ করেছেন।)– তাঁরা ছাড়া সাধারণ মানুষের পক্ষে নতুন করে কিছু সার্বিকভাবে বা ব্যাপকভাবে ‘ন্যায়’ প্রতিষ্ঠা করা ‘কঠিন কাজ’-ই শুধু নয়, এটি করা সত্যিই অসম্ভব ! সাধারণ মানুষ তার চারপাশের মানুষের জন্য কিছু দান-ধ্যান করতে পারে, শিক্ষা বা স্বাস্থ্যের ব্যাপারে কিছু সাহায্য করতে পারে – কিন্তু মানবের চেতনার উন্নতি ঘটিয়ে, তার পাশের কোনো ব্যক্তিকে প্রকৃতপক্ষে ‘উন্নত’ করতে পারে না ! এই ‘উন্নত’ বলতে বিবেকের জাগরণ এবং চেতনার উত্তরণ ! গুরু মহারাজ বলেছিলেন – একটি জ্বলন্ত প্রদীপই পারে অন্য আরও অনেক প্রদীপকে জ্বালাতে। সেইজন্যেই আগে সাধনার দ্বারা, ঈশ্বরের কৃপালাভের দ্বারা নিজেকে আগে জ্বলন্ত প্রদীপ হয়ে উঠতে হবে – ”আত্ম দীপো ভবঃ”! তবেই মানবের তথা মানবসমাজের যথার্থ মঙ্গল করা সম্ভব হবে।
এইজন্যই গুরুমহারাজ বারবার বলেছিলেন যে, ” যদি রাজনীতির দ্বারা মানুষের কল্যাণ করা যেতো, তাহলে আমি একজন রাজনীতিবিদ্ হোতাম ! যদি কোনো সমাজনীতি দিয়ে এটা করা যেতো, তাহলে আমি সমাজনীতিবিদ্ হোতাম ! যদি কোনো ধর্মীয় মতবাদ দিয়ে বা কোনো ধর্মীয় organization দিয়ে যদি মানবের কল্যাণ করা যেতাে, তাহলে আমি সেই সংগঠনেই যোগ দিতাম। কিন্তু সেটা হয় না ! আমি দেখলাম মানুষের যথার্থ কল্যাণ করতে গেলে একটাই উপায় – আর তা হোল – আগে আত্মজ্ঞান লাভ করে নিজেকে জ্বলন্ত প্রদীপ হয়ে উঠতে হবে ! তারপর সমাজের মানুষের অর্ন্তজগতে আলো জ্বালিয়ে – তার জন্ম-জন্মান্তরের সংস্কাররূপ, অজ্ঞানতারূপ অন্ধকার কাটিয়ে তুলতে হবে। আর এখন আমি এই বনগ্রামে বসে সেই কাজটাই করে চলেছি।”
এটা ঠিকই ! আমরা যখন প্রথম প্রথম হাওড়া থেকে বর্ধমানে নেমে বা মেমারীতে নেমে (তখন ১৯৮৩/৮৪ সাল, আমি যেহেতু হাওড়ায় থাকতাম তখন মেমারী অপেক্ষা বর্ধমানে নেমে জাবুইডাঙা আসা অপেক্ষাকৃত কম কষ্টের ছিল!) বনগ্রাম আশ্রমে আসতাম, তখন জাবুইডাঙা থেকে মাটির রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে আসতে হোত। বর্ষাকালে বা অন্যসময় বৃষ্টি হলে রাস্তায় কাদা হয়ে যেতো – জুতো খুলে হাতে নিয়ে, প্যান্ট গুটিয়ে হাঁটুর উপর তুলে আশ্রমে যেতে হোত(আর মহিলাদেরকে শাড়ি হাঁটুর উপর তুলে হেঁটে আসতে হোত)। তখন ভাবতাম – “গুরুজী এটা কি করলেন ! উনি কোনো বড় শহরের উপকন্ঠে এই আশ্রমটি তো তৈরী করতে পারতেন ! যাতায়াতে এতো কষ্ট ! তার উপরে আশ্রমে তখন শোবার ভালো ঘর নাই, বিছানার ব্যাবস্থা নাই, দুবেলা সাদা-মাঠা ভাত-ডাল-তরকারী, আশ্রমে পায়খানা-বাথরুম নাই ! উনি এতবড়ো মাপের একজন মহাপুরুষ – উনি ইচ্ছা করলেই তো সবরকম ব্যাবস্থা করে দিতে পারতেন।”
এখন নতুন যারা আশ্রমে রয়েছে বা যারা যাতায়াত করছে – তারা কি এইসব ভাববে ? এখন যাতায়াতের কত সুন্দর ব্যাবস্থা, বনগ্রাম আশ্রমে এখন থাকা-খাওয়ার জন্য কত বিল্ডিং, কত পায়খানা-বাথরুম, চাই – কি attach-bath যুক্ত ঘরও রয়েছে ! কিন্তু সেগুলো বলার জন্য এতো কথা বলা হচ্ছিলো না – কথাটা হচ্ছিলো গুরুমহারাজ ভারতবর্ষে (বা পশ্চিমবঙ্গে) এতো বড় বড় শহর থাকতে, শহর-নগর-বন্দর থেকে অনেক দূরে একটি প্রত্যন্ত গ্রামের নির্জন মাঠের মধ্যে (ভাগাড়ে), হাতে তৈরী ছিটেবেড়া একটিমাত্র ঘরে এসে উঠে – তাঁর পৃথিবীব্যাপী এই সুবিশাল কর্মযজ্ঞের সূচনা করেছিলেন ! ভাবা যায় !! সত্যিই ভাবা খুবই দুষ্কর !!
কিন্তু এইটাই style ! যথার্থ মানবকল্যাণকারী কর্ম সম্পাদনের এটাই সঠিক style ! এটা আমরা অনেক পরে বুঝেছি ! সেই সময়ের ওনার যারা সহযোগী – তাঁরাও গুরুমহারাজের style-টা হয় জেনেছিলেন অথবা তাঁকে ভালোবেসে (তাঁকে তো না ভালোবেসে পারা যায় না !) তৎকালীন সমস্ত দুঃখ-কষ্টকে মেনে নিয়েছিলেন এবং ভগবানের কাজে নিজেদেরকে সম্পূর্ণভাবে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। আজ গুরুমহারাজ আর শরীরে নাই – তিনি তাঁর বর্তমান লীলার এই কর্মযজ্ঞে যেটুকু Roll ছিল – তা সম্পাদন করে পুনরায় অসীম-অখন্ড লোকে, চিন্ময়লোকে অখন্ড অবস্থায় বিরাজ করছেন ! কিন্তু তাঁর সাথীদের অনেকেই এখনো তাঁর আরব্ধ কাজকে আজো হাসিমুখে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন। আমরা আজকে এসে তাঁদের সম্বন্ধে বা তাঁদের কাজের ভালোমন্দ নিয়ে__ সমালোচনা করতেই পারি (এটা তো করতে কোন Tax লাগে না !) কিন্তু তাঁদের এই জীবনে ত্যাগ, তিতিক্ষা, বৈরাগ্য – এগুলিও ইতিহাস হয়ে থাকবে। পরমানন্দরূপী জ্বলন্ত প্রদীপ নিজের প্রজ্বলন শক্তি দিয়ে যে প্রদীপগুলি জ্বালিয়ে দিয়ে গেছেন – তারাও বহু প্রদীপ জ্বালাবেই জ্বালাবে – এটা আর বিচিত্র কি ! !
[আমাদের মূল আলোচনা আজ আর হোল না – গৌরচন্দ্র করতে করতেই সময় কেটে গেল ! তাই বাকী আলোচনা পরের দিন।]
তবে, সমাজে কোনো ‘ন্যায়’কে সঠিকভাবে প্রতিষ্ঠা করা সহজ কাজ নয় – এরজন্য খুবই শক্তির প্রয়োজন হয়। তাই কোনো মহাপুরুষ অর্থাৎ যাঁর মধ্যে ঈশ্বরীয় শক্তির বিশেষ প্রকাশ (জন্ম-জন্মান্তরের সাধনার ফলে যিনি সেই শক্তি অর্জন করেছেন অথবা ঈশ্বর-আদিষ্ট হয়ে শরীর ধারণ করেছেন।)– তাঁরা ছাড়া সাধারণ মানুষের পক্ষে নতুন করে কিছু সার্বিকভাবে বা ব্যাপকভাবে ‘ন্যায়’ প্রতিষ্ঠা করা ‘কঠিন কাজ’-ই শুধু নয়, এটি করা সত্যিই অসম্ভব ! সাধারণ মানুষ তার চারপাশের মানুষের জন্য কিছু দান-ধ্যান করতে পারে, শিক্ষা বা স্বাস্থ্যের ব্যাপারে কিছু সাহায্য করতে পারে – কিন্তু মানবের চেতনার উন্নতি ঘটিয়ে, তার পাশের কোনো ব্যক্তিকে প্রকৃতপক্ষে ‘উন্নত’ করতে পারে না ! এই ‘উন্নত’ বলতে বিবেকের জাগরণ এবং চেতনার উত্তরণ ! গুরু মহারাজ বলেছিলেন – একটি জ্বলন্ত প্রদীপই পারে অন্য আরও অনেক প্রদীপকে জ্বালাতে। সেইজন্যেই আগে সাধনার দ্বারা, ঈশ্বরের কৃপালাভের দ্বারা নিজেকে আগে জ্বলন্ত প্রদীপ হয়ে উঠতে হবে – ”আত্ম দীপো ভবঃ”! তবেই মানবের তথা মানবসমাজের যথার্থ মঙ্গল করা সম্ভব হবে।
এইজন্যই গুরুমহারাজ বারবার বলেছিলেন যে, ” যদি রাজনীতির দ্বারা মানুষের কল্যাণ করা যেতো, তাহলে আমি একজন রাজনীতিবিদ্ হোতাম ! যদি কোনো সমাজনীতি দিয়ে এটা করা যেতো, তাহলে আমি সমাজনীতিবিদ্ হোতাম ! যদি কোনো ধর্মীয় মতবাদ দিয়ে বা কোনো ধর্মীয় organization দিয়ে যদি মানবের কল্যাণ করা যেতাে, তাহলে আমি সেই সংগঠনেই যোগ দিতাম। কিন্তু সেটা হয় না ! আমি দেখলাম মানুষের যথার্থ কল্যাণ করতে গেলে একটাই উপায় – আর তা হোল – আগে আত্মজ্ঞান লাভ করে নিজেকে জ্বলন্ত প্রদীপ হয়ে উঠতে হবে ! তারপর সমাজের মানুষের অর্ন্তজগতে আলো জ্বালিয়ে – তার জন্ম-জন্মান্তরের সংস্কাররূপ, অজ্ঞানতারূপ অন্ধকার কাটিয়ে তুলতে হবে। আর এখন আমি এই বনগ্রামে বসে সেই কাজটাই করে চলেছি।”
এটা ঠিকই ! আমরা যখন প্রথম প্রথম হাওড়া থেকে বর্ধমানে নেমে বা মেমারীতে নেমে (তখন ১৯৮৩/৮৪ সাল, আমি যেহেতু হাওড়ায় থাকতাম তখন মেমারী অপেক্ষা বর্ধমানে নেমে জাবুইডাঙা আসা অপেক্ষাকৃত কম কষ্টের ছিল!) বনগ্রাম আশ্রমে আসতাম, তখন জাবুইডাঙা থেকে মাটির রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে আসতে হোত। বর্ষাকালে বা অন্যসময় বৃষ্টি হলে রাস্তায় কাদা হয়ে যেতো – জুতো খুলে হাতে নিয়ে, প্যান্ট গুটিয়ে হাঁটুর উপর তুলে আশ্রমে যেতে হোত(আর মহিলাদেরকে শাড়ি হাঁটুর উপর তুলে হেঁটে আসতে হোত)। তখন ভাবতাম – “গুরুজী এটা কি করলেন ! উনি কোনো বড় শহরের উপকন্ঠে এই আশ্রমটি তো তৈরী করতে পারতেন ! যাতায়াতে এতো কষ্ট ! তার উপরে আশ্রমে তখন শোবার ভালো ঘর নাই, বিছানার ব্যাবস্থা নাই, দুবেলা সাদা-মাঠা ভাত-ডাল-তরকারী, আশ্রমে পায়খানা-বাথরুম নাই ! উনি এতবড়ো মাপের একজন মহাপুরুষ – উনি ইচ্ছা করলেই তো সবরকম ব্যাবস্থা করে দিতে পারতেন।”
এখন নতুন যারা আশ্রমে রয়েছে বা যারা যাতায়াত করছে – তারা কি এইসব ভাববে ? এখন যাতায়াতের কত সুন্দর ব্যাবস্থা, বনগ্রাম আশ্রমে এখন থাকা-খাওয়ার জন্য কত বিল্ডিং, কত পায়খানা-বাথরুম, চাই – কি attach-bath যুক্ত ঘরও রয়েছে ! কিন্তু সেগুলো বলার জন্য এতো কথা বলা হচ্ছিলো না – কথাটা হচ্ছিলো গুরুমহারাজ ভারতবর্ষে (বা পশ্চিমবঙ্গে) এতো বড় বড় শহর থাকতে, শহর-নগর-বন্দর থেকে অনেক দূরে একটি প্রত্যন্ত গ্রামের নির্জন মাঠের মধ্যে (ভাগাড়ে), হাতে তৈরী ছিটেবেড়া একটিমাত্র ঘরে এসে উঠে – তাঁর পৃথিবীব্যাপী এই সুবিশাল কর্মযজ্ঞের সূচনা করেছিলেন ! ভাবা যায় !! সত্যিই ভাবা খুবই দুষ্কর !!
কিন্তু এইটাই style ! যথার্থ মানবকল্যাণকারী কর্ম সম্পাদনের এটাই সঠিক style ! এটা আমরা অনেক পরে বুঝেছি ! সেই সময়ের ওনার যারা সহযোগী – তাঁরাও গুরুমহারাজের style-টা হয় জেনেছিলেন অথবা তাঁকে ভালোবেসে (তাঁকে তো না ভালোবেসে পারা যায় না !) তৎকালীন সমস্ত দুঃখ-কষ্টকে মেনে নিয়েছিলেন এবং ভগবানের কাজে নিজেদেরকে সম্পূর্ণভাবে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। আজ গুরুমহারাজ আর শরীরে নাই – তিনি তাঁর বর্তমান লীলার এই কর্মযজ্ঞে যেটুকু Roll ছিল – তা সম্পাদন করে পুনরায় অসীম-অখন্ড লোকে, চিন্ময়লোকে অখন্ড অবস্থায় বিরাজ করছেন ! কিন্তু তাঁর সাথীদের অনেকেই এখনো তাঁর আরব্ধ কাজকে আজো হাসিমুখে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন। আমরা আজকে এসে তাঁদের সম্বন্ধে বা তাঁদের কাজের ভালোমন্দ নিয়ে__ সমালোচনা করতেই পারি (এটা তো করতে কোন Tax লাগে না !) কিন্তু তাঁদের এই জীবনে ত্যাগ, তিতিক্ষা, বৈরাগ্য – এগুলিও ইতিহাস হয়ে থাকবে। পরমানন্দরূপী জ্বলন্ত প্রদীপ নিজের প্রজ্বলন শক্তি দিয়ে যে প্রদীপগুলি জ্বালিয়ে দিয়ে গেছেন – তারাও বহু প্রদীপ জ্বালাবেই জ্বালাবে – এটা আর বিচিত্র কি ! !
[আমাদের মূল আলোচনা আজ আর হোল না – গৌরচন্দ্র করতে করতেই সময় কেটে গেল ! তাই বাকী আলোচনা পরের দিন।]