শ্রী শ্রী গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দ মানব জীবনকে উন্নত করে গড়ে তোলার জন্য যে চারটি মূল জীবনাদর্শের কথা বলেছিলেন – সেগুলিই এখানে আলোচনা করা হচ্ছিলো। গুরুমহারাজ তৃতীয় যে মূল জীবনাদর্শের কথা বলেছিলেন, সেটি হলো প্রেম ! গুরুমহারাজ বলেছিলেন – ” ভালোবাসায় প্রেম মূর্ত, পাশবিকতায় নয় !” ভালোবাসা কথাটির সঙ্গে অল্পবিস্তর সব মানুষই পরিচিত। আগেই বলা হয়েছে যে গুরুমহারাজ বলেছিলেন বড়(senior)দের প্রতি প্রদর্শিত শ্রদ্ধা, ছোট(Junior)দের প্রতি বর্ষিত ‘স্নেহ’ এবং সমবয়সী (নারী-পুরুষের চিরকালীন আকর্ষণ সহ)-দের প্রতি যে emotion প্রদর্শন– এই তিনটিই ‘ভালোবাসা’-র রূপ। Action, reaction ও reflection – এই তিনটি হলো জীবের বা জীবনের লক্ষণ। জীবচেতনার চূড়ান্ত অবস্থায় ‘মনুষ্যচেতনা’ প্রকাশ পায়। একমাত্র মানুষই consciousness কে super consciousness-এ উন্নীত করতে পারে, তার emotion-কে devotion-এ পরিণত করতে পারে !
এই যে devotion বা ‘ভক্তি’- এটাই প্রকৃত প্রেমের প্রাথমিক অবস্থা ! ভক্তিশাস্ত্রে ভক্তকে পাঁচ ভাগে ভাগ করেছে। এখানে ‘ভাগ’ অর্থে ভক্তের অবস্থা ! ভক্ত এক এক সময় এক এক রকম ভক্তিভাব অবলম্বন করে তার ইষ্ট বা ভগবানের সাথে লীলা সম্পাদন করে থাকে। এর প্রথম অবস্থা ‘শান্তভাব’। শান্তভাবের ভক্তের উদাহরণ হল ঋষিগণ ! এঁরা শান্তভাবে গিরি-গুহা-অরণ্যে অর্থাৎ কোনো না কোনো নির্জন স্থানে একাকী সাধনা করে তাঁর ইষ্ট-কে লাভ করেন। তাঁদের কোথাও কোনো প্রেমের উচ্ছাস নাই, মিলনের উদ্দামতা নাই, বিরহের করুণ কান্নার বালাই নাই। এইরূপ অবস্থার ‘গোপনে গোবিন্দ ভজা’– গোপী(ঋষি)-গণই শান্তভাবের সাধক বা ভক্ত !
‘দাস্য’-ভাবের সাধকের শ্রেষ্ঠ উদাহরণ ‘হনুমান’ ! রামদাস হনুমান ! প্রভু রামের আদেশে কি না করতে পারেন ! এক লাফে সাগর পার হতে পারেন, একাকী সোনার লঙ্কা পুড়িয়ে ভস্মীভূত করতে পারেন, সহস্র রক্ষীর নজর এড়িয়ে অশোক কাননে মাতা সীতার সাথে দেখা করতে পারেন, লক্ষণের প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে রাতারাতি হিমালয় থেকে গন্ধমাদন নিয়ে আসতে পারেন, আবার প্রয়োজনে নিজের বুক চিরে হৃদয়াভ্যন্তরে সদা বিরাজিত রাম-সীতার মূর্তিও দেখাতে পারেন ! তাই হনুমান শুধু ভক্ত নয় – বীরভক্ত ! গুরুমহারাজ তথাকথিত বৈষ্ণবদের উদ্দেশ্য করে বলতেন – ” বর্তমানের বৈষ্ণবেরা যেন নিজেদেরকে ‘দীন’ ভাবতে ভাবতে ‘হীন’ হয়ে গেছে। শুধু কথায় কথায় ফ্যাঁচ্-ফ্যাঁচ্ করে কেঁদে ভাসায়, আর সারাদিনের দুই-তিন ঘন্টা আয়নার সামনে অলকা-তিলকা আঁকতে গিয়ে সময় কাটায় ! কিন্তু আজকের সমাজে এইসব ‘ইনিয়ে-বিনিয়ে কথা বলা’ অথবা ‘কথায় কথায় কেঁদে ফেলা’ বৈষ্ণবভক্তের প্রয়োজন নাই – এখন রামদাস হনুমানের মতো বীরভক্তদের সমাজে প্রয়োজন !”
‘সখ্য’ ভাবের সাধকেরা বা ভক্তেরা যেন ভগবানের খেলার সাথী, কোন না কোনো লীলার সাথী ইত্যাদি ! যদি আমরা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ক্ষেত্রে দেখি তাহলে বৃন্দাবনে ব্রজলীলার খেলার সাথী বা সখাগণ হোল – শ্রীদাম-সুদাম-দাম-বসুদাম প্রমুখেরা ! সন্দীপন ঋষির পাঠশালায় পড়ার সময় মধুমঙ্গল আদি পড়ুয়ারা, আবার পরবর্তীতে দেখলাম ধর্মযুদ্ধ করার জন্য উনি পঞ্চপাণ্ডবদের তৃতীয় জনকে ‘সখা’র মর্যাদা দিলেন, দ্রৌপদীকে দিলেন ‘সখী’র মর্যাদা ! ‘ভগবানের সখা’- হবার গৌরব অর্জন করাটা কি মুখের কথা ! কত জীবনের কত সাধনার ফলে এই সৌভাগ্য লাভ হয় ! তবে ভগবানের সাথে সখ্যতা হয়, ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যলাভ হয় ঠিকই – কিন্তু মানবের চূড়ান্ত লক্ষ্য যা – তা কিন্তু তখনও অর্জন হয় না অর্থাৎ আত্মজ্ঞান লাভ হয় না ! এইজন্যেই দেখা যায় – ভগবানের লীলা-সহচর বা সখাগণ ভগবানকে ছেড়ে জগৎ-সংসারের মায়া-মোহ, ভোগ-ঐশ্বর্যের জীবনে__ খানিকটা হোলেও রস পাচ্ছে ! এইজন্যেই দেখা যায়, ভগবানের সখা হ‌ওয়া সত্বেও অর্জুন একের পর এক বিবাহ করছে, নানান ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ছে, কৃষ্ণ পরবর্তী সময়ে গান্ডীব ধনুক তোলার ক্ষমতাও হারাচ্ছে !
পরের ‘ভাব’টি হলো বাৎসল্য ! ভক্তের এই ভাবটি চন্দ্রকিরণের ন্যায় স্নিগ্ধ-শীতল-কোমলতা মাখা ‘ভাব’৷ এখানে শুধুই “দেবার ভাব”! মা-বাবা, গুরু-র মধ্যে থাকে এই ‘বাৎসল্য’ ভাব ! এই ‘ভাবে’ সর্বশক্তিমান হয়েও ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, মা যশোদার ভক্তি-রজ্জুতে বাঁধা পড়ে আকুল হয়ে ছাড়া পাবার জন্য কাঁদেন ! ভগবান অনায়াসে মায়ের বা গুরুজনদের কানমলা খান, হাসিমুখে নানারকম শাস্তি ভোগ করেন।
তবে ভক্তিপথের চরম এবং পরম ‘ভাব’ হোল “মধুর ভাব”! এই ‘ভাবে’ সমস্ত ভাবের সামঞ্জস্য রয়েছে। প্রেমিক তার প্রেমাস্পদকে কাছে পাবার জন্য যে তীব্র আকর্ষণ বোধ এবং দূরে চলে গেলে যে সুতীব্র বিরহের জ্বালা-র অনুভব – এটাই “মধুর লীলা”-র মাধুর্য্য ! আর এই দুটির মাঝে রয়েছে প্রেমিক ও প্রেমাস্পদের মিলনের সেই চরম মূহূর্ত ! ভক্ত-ভগবানের মিলন হোলো আত্মার সঙ্গে পরমাত্মার মিলন ! আর এই মিলনের জন্যই জীবের জীবনপথে ছুটে চলা – জন্ম-জন্মান্তরের মধ্যে দিয়ে ! “মধুর ভাবে”-র সাধনায় সিদ্ধ হতে পারলে জীবের চূড়ান্ত অবস্থা লাভ হয়।
আমরা গুরুমহারাজের বলা ‘প্রেম’- অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে অনেক কথাই বলে ফেলেছি ! তবু এখনও যেটুকু বলার রয়েছে – তা পরবর্তী সংখ্যায়। (ক্রমশঃ)