শ্রী শ্রী গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের বলা কথা নিয়ে এখানে এখন আলোচনা করা হচ্ছিলো। তবে একটা কথা বলে রাখা ভালো – তাঁর কথা আমরা যে যতটুকু বুঝতে পেরেছিলাম সেটাই বলার চেষ্টা করা হচ্ছে। আসলে ভগবানের কথার সঠিক মর্মার্থ অনুধাবন করে তা যথাযথভাবে পরিবেশন করা সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। কিন্তু আমরা সাধারন মানুষ, ফলে আমরা তো sentiment মুক্ত নই, তাই আমাদের প্রত্যেকের মনে হয় – “আমি যেটা শুনেছি সেটাই সঠিক !” এইভাবেই গুরুমহারাজের কথা আমরা যারাই লিখছি – তাদের প্রত্যেকের (গৃহী-সন্ন্যাসী-ব্রহ্মচারী নির্বিশেষে) লেখাতেই প্রচুর ভুল থেকে যাচ্ছে। ভগবানের কথার সাথে প্রচুর নিজের কথা ঢুকে যাচ্ছে ! বিশেষতঃ আমার নজরে পড়েছে – যেখানে যেখানে গুরুমহারাজ স্থূল-বিজ্ঞান (ভৌতবিজ্ঞান, জীবনবিজ্ঞান মহাকাশবিজ্ঞান, তাছাড়া আধুনিক বিজ্ঞানের শাখাগুলি) নিয়ে আলোচনা করেছেন, সেখানেই আমাদের মতো সমস্ত লেখকদের কোথাও-না-কোথাও ত্রুটি ঘটে গেছে, ব্যাখ্যার ভুল হয়েছে বা বক্তব্যের উপস্থাপনা ঠিকমতো করা হয়নি।
আসলে গুরুমহারাজ ছিলেন মহাবিজ্ঞানী, সম্পূর্ণ বিজ্ঞানী ! পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান – অধ্যাত্মবিজ্ঞানের সম্রাট। তিনি যখন যে বিষয় সম্বন্ধেই কথা বলতেন, সেই কথা চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে যেতো ! উপস্থিত শ্রোতৃবৃন্দের চেতনার বাইরে চলে যেতো – তাহলে শ্রোতারা কি করে তাঁর সমস্ত কথা ধরে রাখবে ? তাছাড়া আমরা যারা গুরু গুরুমহারাজের কথাগুলি লেখার চেষ্টা করি – তারা তো আর স্থূলবিজ্ঞানীও নই ! গুরুজীর সিটিং-এ উপস্থিত বেশিরভাগ লোক তো বিজ্ঞানশাখার student ছিল না – ফলে গুরুমহারাজের বলা যে কোনো বিজ্ঞান-বিষয়ক আলোচনা তো শ্রোতৃবর্গের অধিকাংশের ধারণাতেই আসতো না – তাহলে লেখকদের লেখার সময় তো ভুল পরিবেশন হবেই ! এবার আমাদের মতো অনেকেরই তো আধ্যাত্মবিষয়ের অগ্রগতিও সম্পূর্ণতা পায় নি, ফলে অধ্যাত্মবিষয়ক গুরুজীর আলোচনা পরিবেশনকালেও নানান ত্রুটি থেকে যাচ্ছে। তবুও আমরা অভিমানমুক্ত নই বলে ভাবছি __আমার লেখাটাই সঠিক !
এই কম্মো করতে গিয়েই একসময় আরব দেশে “হাদিস শরীফে” নানান গোলমাল ঢুকে পড়েছিল ! গুরুমহারাজের কাছে শুনেছিলাম – ” হজরতের শ্রীমুখের কথাগুলিই ‘হাদিস’ হিসাবে পরিগণিত হোতো। কিন্তু ওনার জীবৎকালে সেগুলি সংকলন হয়নি। ওনার পরবর্তীতে বহু মানুষ, যারাই তাঁর শ্রীমুখের কথা শুনেছিল, তারা বলতে লাগল -“আমি হযরতের কাছে এটা শুনেছি”, কেউ বলল – “আমার আব্বা শুনেছে বা আম্মি শুনেছে”, কেউ বললো – “আমার খালা-ফুফু বা নিকটাত্মীয়রা শুনেছে”। এইভাবে সহস্র সহস্র হাদিস লোকের মুখে মুখে প্রচারিত হতে লাগলো, ফলে প্রচুর ‘বেনােজল’ ঢুকে গেল। অনেকেই মনগড়া কথা বলে – সেটাকেই হজরত মুহাম্মদের শ্রীমুখের কথা বলে চালাতে চাইলো। এইভাবে হজরতের মৃত্যুর ১০০/১৫০ বছর পর হাজার হাজার হাদিসে আরব দেশ ছেয়ে গেছিলো !
গুরুমহারাজের কাছে শুনেছিলাম এরপর আরব দুনিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ শাসক হারুন-অর(উর)-রশীদের সময় আরবের শ্রেষ্ঠ পন্ডিতের ডেকে যেখানে যত হাদিস ছিল – সেগুলি সব একজায়গায় করা হয় এবং ওই পণ্ডিতেরা হাজার হাজার হাদিসের মধ্যে বেছে বেছে যেগুলিকে মান্যতা প্রদান করেন – সেইগুলিরই সংকলন-ই বর্তমানের “হাদিস শরীফ”! বাকি সমস্ত হাদিস-কে বাতিল করা হয় ! এমনও হোতে পারে যে, ওগুলির মধ্যে হয়তো সত্যি সত্যিই হজরতের কিছু কথা রয়ে গিয়েছিল। আবার এমনও হোতে পারে যে, যেগুলি বর্তমানের সর্বজনগ্রাহ্য হাদিস – তার মধ্যেই কোথাও কোথাও সাধারণ মানুষের কথা ঢুকে গেছে !
এরকমটাই হয় ! পৃথিবীর সবদেশে, সবকালে, সকল সমাজে এমনটাই হয়ে আসছে। আর এমনটা হচ্ছে বলেই তো পুনরায় মহাপুরুষদের আগমনের বা ঈশ্বরের অবতরণের প্রয়োজন হয় ! যাইহোক, এসব কথা থাক্ ! আমাদের কথা হচ্ছিলো – গুরুমহারাজের কথাগুলি বর্তমান প্রথম প্রজন্মের লেখকদের লেখায় যথাযথ পরিবেশিত হলো কিনা – সেই বিষয়ে ! গুরুমহারাজ নিজেই একদিন বলেছিলেন – ” আমার কথা ষোলোআনা কখনোই পরিবেশন করা যাবে না ! তবে যদি এক আনাও পরিবেশিত হয় – তাহলেই লোককল্যাণ হবে।” সেই হিসাবে গুরুমহারাজ সম্পর্কিত যেকোনো লেখাতে ষোলআনার এক আনাও যদি ঠিকঠাক গুরুমহারাজের কথা হয় – তাতেই মানবকল্যাণ হবে। কিন্তু তবুও তাঁর (গুরুজীর) কথা (এক আনা হলেও) তো যথাযথ হওয়াটাই উচিত ! তিনি তো আর কখনো কোনো কথা ভুল বলেন নি। আমাদের শোনার ভুলে, বোঝার ভুলে ঐ ভুলগুলি পরিবেশিত হয়ে গেছে !
তাহলে সেগুলিরও সংশোধন প্রয়োজন ! কিন্তু লেখকদের মনে জমে থাকা ‘অহং’ বা ‘অভিমান’ হয়তো তা করতে বাধা দিতে পারেন ! তবুও সেগুলি সংশোধন হবে – এই generation যদি নাও পারে – তাহলে পরের generation-এর লোকেরাও এগুলি ঠিক করে নেবে ! (ক্রমশঃ)