শ্রী শ্রী গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দ তাঁর নিজের সম্বন্ধে কথা খুবই কম বলতেন৷ সরাসরি কেউ তাঁর সম্বন্ধে কিছু জিজ্ঞাসা করলে বেশিরভাগই দেখতাম হয় উনি জিজ্ঞাসাটিকে – একেবারেই উড়িয়ে দিতেন অথবা এটিকে এড়িয়ে যেতেন। আবার কোনো কোনো সময় নিজেই নিজের কথা গরগর করে বলতে শুরু করতেন ! তাঁর প্রাক্-জন্মকালীন অবস্থার কথা, মায়ের গর্ভে তাঁর আগমনের কথা, মায়ের গর্ভকালীন অবস্থার কথা বা মাতৃজঠরে তাঁর থাকা অবস্থার কথা, তাঁর শৈশবের কথা, বাল্যের কথা, কৈশোরের কথা, ধীরে ধীরে গুরু হয়ে ওঠার কথা, হিমালয় ভ্রমণকালীন যত মহাত্মার সাথে দেখা হয়েছিল তাঁদের কথা – আরো কত কত কথা !
সেইসব কথাগুলির মাধ্যমেই ভগবান পরমানন্দের মহিমা শক্তির যেসব প্রকাশ ঘটেছিল তার কিছু কিছু এখানে পরিবেশন করা হবে ! তাছাড়া আমরা ওনার সংস্পর্শে আসার পর আমরা নিজে যা দেখেছিলাম বা আমাদের সাথীরা বা অন্যান্য ভক্তদের সাথেও যেসব ঘটনা ঘটেছিল – সেগুলির উল্লেখ‌ও করা যেতেই পারে!
আমরা আগেই জেনে গেছি যে, “ভগবানের মহিমা”_ লেখনীর দ্বারা অথবা ‘লেখা’র মাধ্যমে বর্ণনা করা যায় না ! আর যেটুকুই বা করা যায় – তার দ্বারা ভগবানের ভগবানত্ব বোঝানো যায় না ! কারণ আমরা গুরুমহারাজের কাছেই শুনেছিলাম যে, ” টর্চ জ্বেলে অথবা লন্ঠন বা হ্যারিকেন জ্বেলে সূর্যকে দেখার প্রয়োজন হয় না – সূর্য স্বয়ং প্রকাশমান ! সূর্যের আলোতেই জগতের সমস্ত অন্ধকার, অন্ধকারের সমস্ত কালো আলোয় আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে ! তেমনি ভগবানের মহিমা শক্তিতেই তো জীবজগতের শক্তি ! তাহলে কিভাবে একজন মানুষ, অতি ক্ষুদ্র জীব হয়ে__ সেই বিশ্ব-বিরাটের মহিমা জানতে পারে বা তা প্রকাশ করতে পারে !
তবু __প্রচেষ্টা তো করা যায়! যে জিনিস নিজের ভালো লাগে – তা সকলের সাথে ভাগ করে নেবার আনন্দেই এই প্রচেষ্টা !
গুরুমহারাজের সাথে আমার যখন প্রথম দেখা হয়েছিল এবং পরিচয় হয়েছিল – সেটা খুব একটা মধুর ছিল না ! পূর্ণানন্দ মহারাজ (যিনি বর্তমানে রায়না তপোবন আশ্রম পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন) শ্রী শ্রী গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের সঙ্গে আমার যখন পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন তখন গুরুমহারাজ অন্য দিকে তাকিয়ে _যেন অবজ্ঞা বা উপেক্ষার ভাব প্রকাশ করেছিলেন বলে আমার মনে হয়েছিল! ওনার ভাবটা এমন ছিল যে, ” পূর্ণানন্দ ! তুমি এর সম্বন্ধে যা-ই বলো না কেন – ওকে পাত্তা দেবার মত এমন কিছু ব্যক্তি ও নয়।” আমার অন্ততঃ তাই মনে হয়েছিল ! আর এটা মনে হোতেই আমিও ওনার সম্বন্ধে আগ্রহহীন হয়ে পড়েছিলাম। ফলে, প্রথম দর্শনের এই মনোভাব কাটিয়ে পরবর্তীতে তাঁর প্রেমের স্পর্শ পাওয়া, তাঁর অনুগত হয়ে তাঁর পদপ্রান্তে বসে _জীবনের বাকি দিনগুলি কাটিয়ে দেবার ইচ্ছা তৈরি হওয়া _ এগুলোই তো ভগবান পরমানন্দের মহিমা শক্তির প্রকাশ !
আর এইটা যে শুধু আমার জীবনেই ঘটেছিল – তা তো নয় ! হাজার-হাজার, লক্ষ-লক্ষ মানুষের (নর-নারী) জীবনে এই একই ঘটনা ঘটেছে ! এটাই শেষ নয় – স্বামী পরমানন্দ স্থূলশরীর ছেড়ে চলে গেছেন ১৯৯৯ সালের ২৭-শে নভেম্বর – কিন্তু তারপরেও হাজার হাজার ভক্ত-অনুরাগী তাঁর প্রেমে পাগল, তাঁর বলে যাওয়া কথায় মুগ্ধ, তাঁর আধ্যাত্মিক পথনির্দেশে আপ্লুত এবং তারা তাঁর নির্দেশিত পথে এগিয়ে চলার জন্য ব্রতী হয়ে এগিয়ে আসছে, আগামীদিনেও অর্থাৎ আরও সহস্র-সহস্র বৎসর ধরে মানুষ স্বামী পরমানন্দের কাছেই জীবনে এগিয়ে চলার দিশা খুঁজে পাবে __ এই ঘটনা যদি “ভগবান পরমানন্দের মহিমা” শক্তি না হয় , তাহলে সেটা কি? অবশ্য আপনারা বলতেই পারেন , ‘যে কোনো মহাপুরুষ বা অবতার পুরুষের ক্ষেত্রে এমনটাই হয় !’ __হ্যাঁ, ঐটাও ঠিক কথা !
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ স্থূলশরীর ছেড়েছেন আজ প্রায় দেড়শো বছর হয়েই গেল – কিন্তু তাতে কি ? এখনো লক্ষ লক্ষ ভক্ত নর-নারী ঠাকুরের নামে চোখের জল ফেলে, ঠাকুরের জয়ধ্বনি দিয়ে নিজের জীবনের জয়যাত্রা শুরু করে ! তাঁকে কেন্দ্র করেই জীবনে সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না,প্রেম-ভালোবাসা, উত্থান-পতন আবর্তিত হয়– এই ঘটনা তো আমরা নিজের চোখে দেখছি ! পূর্ব পূর্বের যে কোনো মহাত্মা-মহাপুরুষদেরকে কেন্দ্র করে তাদের followers-রা যুগ যুগ ধরে এমনটাই করে আসছে ! এটাই তাঁদের মহিমা শক্তির অন্যতম প্রকাশ !
তন্ত্রোক্ত যে ‘মহিমা’ সিদ্ধির কথা আগে বলা হয়েছিল, যা সাধনার দ্বারা অর্জন করা যায় – সেইটা অর্জন করেই বহু সাধক নিজেকে ‘ভগবান’ আখ্যা দিয়ে বসে ! সে নিজে ঐ আখ্যা না দিলেও _তাঁর ভক্তরা ওই গুরুদেবের মধ্যে ‘মহিমা শক্তি’-র প্রকাশ দেখে – তাঁকেই ‘ভগবান’ বলে প্রচার করতে শুরু করে দেয় !!
এইভাবেই ভারতবর্ষে প্রচুর “ভগবান”! যেকোনো গুরু পরম্পরার শিষ্যরা তাঁদের পরম্পরার প্রতিষ্ঠাতা গুরু-কে ‘ভগবান’ – এই আখ্যা দিতেই পারেন, কিন্তু সত্যি সত্যিই তো এঁরা সবাই ঈশ্বরের অবতরিত রূপের প্রকাশ নন ! এঁরা হয়তো মহা মহা সাধক ! অষ্টসিদ্ধির দু’তিনটে বা আরও বেশি সিদ্ধি এঁদের অর্জিত ! ফলে এঁদের মধ্যে দিয়ে মানব কল্যাণের জন্য ঈশ্বরীয় শক্তির কিছু কিছু মহিমা প্রকাশিত হতে থাকে ! আর এইটা দেখেই তাঁর ভক্তরা তাঁদের গুরুকে একেবারে ‘ভগবান’ আখ্যা দিয়ে বসে !
গুরুমহারাজ এই ব্যাপারে আমাদের বলেছিলেন – ‘অবতার পুরুষ’ এবং ‘সিদ্ধিপ্রাপ্ত মহাপুরুষে’র পার্থক্য করা যায় তাঁদের মৃত্যুকালে। সিদ্ধিপ্রাপ্ত মহাপুরুষগণ যদি শক্তি প্রকাশের ক্ষেত্রে কোন গোলমাল করে থাকেন – তাহলে মৃত্যুকালে বা মৃত্যুর পূর্বে নানাবিধ ‘বিকার’ এসে যায়। অপরপক্ষে ‘ঈশ্বরের অবতার’ বা ভাগবতী তনুধারণকারী ভগবান সর্বঅবস্থাতেই “সচ্চিদানন্দে”-র বোধে থাকেন।৷ (ক্রমশঃ)