শ্রী শ্রী গুরুমহারাজের ‘মহিমা’র প্রকাশ আমরা যেটা দেখেছিলাম, সেইসব কথা এখানে বলা হচ্ছিলো। আমি আগেই আপনাদের বলেছি যে, গুরুমহারাজের সাথে আমার প্রথম সাক্ষাৎ খুব একটা মধুর ছিল না৷ স্বামী পূর্ণানন্দ মহারাজ যখন প্রথম গুরুমহারাজের সাথে আমায় পরিচয় করিয়েছিলেন – তখন কেমন যেন উনি মুখ ঘুরিয়ে দু-একটা কথা বলেই ঘরের ভিতরে (হাওড়ার শিবপুরে গঙ্গাবাবুর বাড়ি) ঢুকে গেছিলেন। ফলে ওনার সম্বন্ধে আমার প্রথম যে ধারণাটা হয়েছিল, সেটা হোল – “লোকটা দেখতে সুন্দর হোলেও খুবই অহংঙ্কারী গোছের লোক !”
একদম সত্যিকথা বলছি। প্রথম দর্শনে আমি ওনার রূপমুগ্ধ কিছুটা হলেও ওনার গুণমুগ্ধ বা অন্যান্য কোনভাবেই মুগ্ধ হোতে পারিনি ! আমি প্রথম মুগ্ধ হয়েছিলাম – গঙ্গাবাবুর শিবপুরের বাড়িতেই ওনার ‘সিটিং’ অর্থাৎ আধ্যাত্মিক বিষয়ক আলোচনা শুনে ! কেমন অনায়াসে, অক্লেশে, ঝর-ঝর্ করে কত কথা বলে যাচ্ছিলেন ! আর কি অপূর্ব সব কথা ! বিকাল ৪-টার মধ্যে আসনে বসে, টানা একেবারে রাত্রি আটটা থেকে সাড়ে আটটা পর্যন্ত সিটিং ! বুঝতে পারছেন তো – কি সাংঘাতিক ব্যাপার ! এইরকমটা তো কখোনো শুনিনি – আর ওই ধরনের কোনো কথাও কোনোদিন শুনবো – তাও ভাবি নি ! তাই অবাক হয়ে গেছিলাম !
গুরুমহারাজের ‘মহিমা’ শক্তির প্রথম প্রকাশের কথা যদি বলেন – তাহলে আমার কাছে ছিল ঐ সিটিং-টা !
গুরুমহারাজের কাছে শুনেছিলাম – দেবাদিদেব মহাদেব বা শিবের দুই কন্যা লক্ষ্মী ও সরস্বতীর ব্যাপারটা রূপকাকারে বলা হয়েছে ! আজ্ঞাচক্রের উপরে স্থিতিলাভ করা মানেই শিবাবস্থা প্রাপ্ত হওয়া ! আর অবতার পুরুষরা তো উপর থেকে নেমে আসেন অর্থাৎ সহস্রার থেকে আজ্ঞাচক্রের-র দিকে ! তাই তাঁরা ইচ্ছামাত্রই যেকোনো অবস্থা লাভ করতে পারেন।
যাইহোক, কথা হচ্ছিলো লক্ষ্মী এবং সরস্বতীকে নিয়ে। গুরুমহারাজ বলেছিলেন – আজ্ঞাচক্রের পারে থাকা অবতারপুরুষদের কাছে ‘শ্রী’ অর্থাৎ ধন-সম্পদ-ঐশ্বর্য্য ইত্যাদি এবং ‘জ্ঞান’ তা সে যে কোন বিদ্যার জ্ঞানই হোক না কেন – সবকিছুরই পরিপূর্ণ জ্ঞান তাঁর মধ্যে বিদ্যমান থাকে। ছোট ছোট কন্যারা যেমন তাদের পিতার কাছে সবসময় থাকে, আব্দার করে – বাবার আদরের আশা করে, তেমনই লক্ষ্মী আর সরস্বতীও শিব-স্থিতির মানুষের কাছে কাছেই আদরের কন্যা হয়ে থাকে ! তাই তাঁদের কাছে সহস্র-সহস্র মানুষ (আর্ত, আর্থার্থী, জিজ্ঞাসু ইত্যাদি) নানান আবদার নিয়ে আসুক না কেন – সেই আব্দার মেটাতে মহাপুরুষদের কোনো অসুবিধাই হয় না !
এই যে কথাগুলো বলছি – এসব কথা আমি অনেক পরে বুঝেছি। গুরুমহারাজের সঙ্গে আমার প্রথম প্রথম সাক্ষাৎ বা পরিচয়ের সময় – এসব কিছুই জানতাম না ! এরপরে যখন বনগ্রাম পরমানন্দ মিশনে যাতায়াত শুরু হোল – তখনই জীবনে প্রথম দেখেছিলাম, অনেকগুলো ভালো ভালো মানুষ একই জায়গায় এসে জড়ো হয়েছে ! সমাজের বিভিন্ন স্থানে যখন ঘুরি – তখন দেখি মানুষজন যেন অপরকে ঠকানোর জন্য বসে আছে, প্রতিনিয়ত মানুষ মানুষকে ‘অপরব্যক্তি’ বলে মনে করছে এবং সেই মনোভাব থেকেই নিজের স্বার্থ পূরণের জন্য ওই ‘অপর’কে ব্যবহার করছে। বনগ্রাম আশ্রমে যখন প্রথম গেছিলাম তখন দেখেছিলাম – ধনী-দরিদ্র, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, সাধু-গৃহী নির্বিশেষে সবার মধ্যেই একটা ‘সমভাব’ বা ‘সমতা’ বিরাজ করছে, সবাই সবার কাছাকাছি আসার জন্য উন্মুখ, সবাই সবার ভালো করার জন্য তৎপর – এ কি আশ্চর্য্য ! তাহলে এ স্থানটি কি পৃথিবী গ্রহের বাইরের কোন জায়গা নাকি !!
ফলে, আশ্রমে যাওয়া-আসা করা মানুষগুলোর সঙ্গে আত্মীয়তা হয়ে যেতে সময় লাগলো না ! তখন মনে হোল – “এই রে ! এতদিন যাদেরকে আত্মীয় বা বন্ধু ভাবতাম – তারা তো এরকমটা নয় !” আশ্রমের ভক্তদের তুলনায় তাদেরকে যেন ‘জোলো’ মনে হোতে লাগলো ! আমার কাছে গুরুমহারাজের ‘মহিমা’ শক্তির দ্বিতীয় প্রকাশ যদি বলেন – তাহলে এটাই ছিল দ্বিতীয় প্রকাশ ! আর ভগবান পরমানন্দের ‘মহিমা শক্তি’র প্রকাশের প্রকট রূপ সম্বন্ধে যদি কেউ জানতে চান – তাহলে আমি বলব সেটা ছিল ওনার অপার্থিব “প্রেম”! তাই প্রথম প্রথম আশ্রম (বনগ্রাম) গিয়ে আমি যখন ওখানে যাওয়া-আসা করা মানুষজনেদের জিজ্ঞাসা করতাম – “তারা এই অজপাড়াগাঁয়ে স্বামী পরমানন্দ নামক মানুষটির কাছে ছুটে ছুটে আসে কেন ?” – তার উত্তরে সেই মানুষগুলির প্রত্যেকে একটা উত্তর দিতো, আর সেই উত্তরটি হলো – ” উনি আমাদেরকে এতো ভালবাসেন যে, আমাদের বাবা-মা বা কোনো আত্মীয়-স্বজনই আমাদেরকে এতো ভালোবাসে না !” এই ভালোবাসা বা প্রেমের কথাই বলছিলাম। এটাই ছিল পরমানন্দের মহিমা শক্তির প্রকাশ__ সর্বনাশা, সর্বগ্রাসী অপার্থিব “প্রেম” !(ক্রমশঃ)
একদম সত্যিকথা বলছি। প্রথম দর্শনে আমি ওনার রূপমুগ্ধ কিছুটা হলেও ওনার গুণমুগ্ধ বা অন্যান্য কোনভাবেই মুগ্ধ হোতে পারিনি ! আমি প্রথম মুগ্ধ হয়েছিলাম – গঙ্গাবাবুর শিবপুরের বাড়িতেই ওনার ‘সিটিং’ অর্থাৎ আধ্যাত্মিক বিষয়ক আলোচনা শুনে ! কেমন অনায়াসে, অক্লেশে, ঝর-ঝর্ করে কত কথা বলে যাচ্ছিলেন ! আর কি অপূর্ব সব কথা ! বিকাল ৪-টার মধ্যে আসনে বসে, টানা একেবারে রাত্রি আটটা থেকে সাড়ে আটটা পর্যন্ত সিটিং ! বুঝতে পারছেন তো – কি সাংঘাতিক ব্যাপার ! এইরকমটা তো কখোনো শুনিনি – আর ওই ধরনের কোনো কথাও কোনোদিন শুনবো – তাও ভাবি নি ! তাই অবাক হয়ে গেছিলাম !
গুরুমহারাজের ‘মহিমা’ শক্তির প্রথম প্রকাশের কথা যদি বলেন – তাহলে আমার কাছে ছিল ঐ সিটিং-টা !
গুরুমহারাজের কাছে শুনেছিলাম – দেবাদিদেব মহাদেব বা শিবের দুই কন্যা লক্ষ্মী ও সরস্বতীর ব্যাপারটা রূপকাকারে বলা হয়েছে ! আজ্ঞাচক্রের উপরে স্থিতিলাভ করা মানেই শিবাবস্থা প্রাপ্ত হওয়া ! আর অবতার পুরুষরা তো উপর থেকে নেমে আসেন অর্থাৎ সহস্রার থেকে আজ্ঞাচক্রের-র দিকে ! তাই তাঁরা ইচ্ছামাত্রই যেকোনো অবস্থা লাভ করতে পারেন।
যাইহোক, কথা হচ্ছিলো লক্ষ্মী এবং সরস্বতীকে নিয়ে। গুরুমহারাজ বলেছিলেন – আজ্ঞাচক্রের পারে থাকা অবতারপুরুষদের কাছে ‘শ্রী’ অর্থাৎ ধন-সম্পদ-ঐশ্বর্য্য ইত্যাদি এবং ‘জ্ঞান’ তা সে যে কোন বিদ্যার জ্ঞানই হোক না কেন – সবকিছুরই পরিপূর্ণ জ্ঞান তাঁর মধ্যে বিদ্যমান থাকে। ছোট ছোট কন্যারা যেমন তাদের পিতার কাছে সবসময় থাকে, আব্দার করে – বাবার আদরের আশা করে, তেমনই লক্ষ্মী আর সরস্বতীও শিব-স্থিতির মানুষের কাছে কাছেই আদরের কন্যা হয়ে থাকে ! তাই তাঁদের কাছে সহস্র-সহস্র মানুষ (আর্ত, আর্থার্থী, জিজ্ঞাসু ইত্যাদি) নানান আবদার নিয়ে আসুক না কেন – সেই আব্দার মেটাতে মহাপুরুষদের কোনো অসুবিধাই হয় না !
এই যে কথাগুলো বলছি – এসব কথা আমি অনেক পরে বুঝেছি। গুরুমহারাজের সঙ্গে আমার প্রথম প্রথম সাক্ষাৎ বা পরিচয়ের সময় – এসব কিছুই জানতাম না ! এরপরে যখন বনগ্রাম পরমানন্দ মিশনে যাতায়াত শুরু হোল – তখনই জীবনে প্রথম দেখেছিলাম, অনেকগুলো ভালো ভালো মানুষ একই জায়গায় এসে জড়ো হয়েছে ! সমাজের বিভিন্ন স্থানে যখন ঘুরি – তখন দেখি মানুষজন যেন অপরকে ঠকানোর জন্য বসে আছে, প্রতিনিয়ত মানুষ মানুষকে ‘অপরব্যক্তি’ বলে মনে করছে এবং সেই মনোভাব থেকেই নিজের স্বার্থ পূরণের জন্য ওই ‘অপর’কে ব্যবহার করছে। বনগ্রাম আশ্রমে যখন প্রথম গেছিলাম তখন দেখেছিলাম – ধনী-দরিদ্র, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, সাধু-গৃহী নির্বিশেষে সবার মধ্যেই একটা ‘সমভাব’ বা ‘সমতা’ বিরাজ করছে, সবাই সবার কাছাকাছি আসার জন্য উন্মুখ, সবাই সবার ভালো করার জন্য তৎপর – এ কি আশ্চর্য্য ! তাহলে এ স্থানটি কি পৃথিবী গ্রহের বাইরের কোন জায়গা নাকি !!
ফলে, আশ্রমে যাওয়া-আসা করা মানুষগুলোর সঙ্গে আত্মীয়তা হয়ে যেতে সময় লাগলো না ! তখন মনে হোল – “এই রে ! এতদিন যাদেরকে আত্মীয় বা বন্ধু ভাবতাম – তারা তো এরকমটা নয় !” আশ্রমের ভক্তদের তুলনায় তাদেরকে যেন ‘জোলো’ মনে হোতে লাগলো ! আমার কাছে গুরুমহারাজের ‘মহিমা’ শক্তির দ্বিতীয় প্রকাশ যদি বলেন – তাহলে এটাই ছিল দ্বিতীয় প্রকাশ ! আর ভগবান পরমানন্দের ‘মহিমা শক্তি’র প্রকাশের প্রকট রূপ সম্বন্ধে যদি কেউ জানতে চান – তাহলে আমি বলব সেটা ছিল ওনার অপার্থিব “প্রেম”! তাই প্রথম প্রথম আশ্রম (বনগ্রাম) গিয়ে আমি যখন ওখানে যাওয়া-আসা করা মানুষজনেদের জিজ্ঞাসা করতাম – “তারা এই অজপাড়াগাঁয়ে স্বামী পরমানন্দ নামক মানুষটির কাছে ছুটে ছুটে আসে কেন ?” – তার উত্তরে সেই মানুষগুলির প্রত্যেকে একটা উত্তর দিতো, আর সেই উত্তরটি হলো – ” উনি আমাদেরকে এতো ভালবাসেন যে, আমাদের বাবা-মা বা কোনো আত্মীয়-স্বজনই আমাদেরকে এতো ভালোবাসে না !” এই ভালোবাসা বা প্রেমের কথাই বলছিলাম। এটাই ছিল পরমানন্দের মহিমা শক্তির প্রকাশ__ সর্বনাশা, সর্বগ্রাসী অপার্থিব “প্রেম” !(ক্রমশঃ)