গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের কথা হচ্ছিলো। তাঁর মহিমা শক্তির প্রকাশ আমি যেটুকু প্রত্যক্ষ করেছিলাম বা যাঁরা প্রথম থেকে তাঁকে খুব কাছ থেকে দেখেছে বা দেখেছেন – তাঁদের/তাদের মুখ থেকে আমি সেইসময় যা-কিছু শুনেছিলাম – সেইগুলি নিয়েই আমাদের আলোচনা।
গুরুমহারাজ নিজেও ওনার জীবনের টুকরো টুকরো নানান কাহিনী _ মাঝে মাঝেই ‘কথা প্রসঙ্গে’ বলতেন ! উনি ওনার নিজের সম্বন্ধে যখন যে কথাগুলিই বলতেন – আমাদের কাছে সেই কথাগুলিই বিস্ময়কর মনে হোতো এবং আমরা সেগুলির সবকিছুর মধ্যেই ভগবানের ‘মহিমা’ খুঁজে বের করার চেষ্টা করতাম। তবে আমরা সাধারন মানুষেরা যেকোনো বিষয় বলার সময় তাকে একটু অতিরঞ্জিত করে বলতে যেন অধিক ভালোবাসি ! তাই গুরুমহারাজ স্বয়ং তাঁর নিজের কথা যা বলেছিলেন সেটাই 100% authentic ! তাছাড়া সমকালীন সময়ে যাঁরা ওনার জীবনের কিছু কিছু ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছিলেন – তাঁদের অনেকেই যখন একই কথা বিবৃত করেছে – সেটাকে প্রায় 100% authentic হিসাবে ধরে নেওয়া যায় ! বাকি যা কিছু বা যতকিছু গুরুমহারাজ সম্পর্কিত ঘটনা কারো সাথে 1:1 (one is to one) ঘটেছিল – এবং সেগুলি ঐ ভক্ত বা ভক্তরা পরে বিবৃত করেছে – সেখানেই জল মেশানো হয়েছে ! অর্থাৎ সেগুলি 100% authentic নয় !
আমরা এগুলির প্রত্যক্ষ প্রমাণ পেয়েছি বলেই এইকথা বলার সাহস পেয়েছি। কারণ গুরুজীর সাথে কোনো ব্যক্তি (বা ভক্ত)-র ঘটে যাওয়া ঘটনা অনেক সময় গুরুমহারাজও বলেছেন, পরবর্তীতে সেই ব্যক্তির কাছেও ঐ ঘটনার কথা শুনেছি_ কিন্তু দেখেছি সামান্য হোলেও একটু-আধটু ঘটনা পরম্পরার ইতরবিশেষে ঘটে গেছে ! এখানে ওই ব্যক্তিরও যে দোষ আছে – তা নয় ! কারণ ওই যে প্রথমেই বলা হোলো – আমরা যেকোনো বিষয়কেই একটু অতিরঞ্জিত করতে ভালোবাসি ! আর তার সাথে যদি “অহং-অস্মিতা” বা ‘আমি’–’আমি’ এই ব্যাপারটা ঢুকে পড়ে তাহলেই ষোলআনা গন্ডগোল ! তবে, এখানে একটা কথা আছে___গুরু মহারাজ সম্পর্কিত অতিরঞ্জিত কথাবার্তা_ লোকে দু’চারদিন শুনবে, পাত্তা দেবে – তারপর ঐ ধরনের ব্যক্তিকে দূর থেকে দেখলেই সরে পড়বে ! ভাবটা এইরকম যে,__ এই রে ! ওই আবার শুরু হবে সেই ফাটা-রেকর্ডের ঘ্যানঘ্যানানি !
এগুলো বাস্তব কথা – তাই বললাম! কাল বহমান – মানুষের জীবন বহমান – সবসময়ই সবকিছু সামনের দিকে এগিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে ! প্রতিমুহূর্তই পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে পরের মুহূর্তে ! বিবর্তিত হচ্ছে জড়, উদ্ভিদ-জীবসকল ! সেখানে পিছনে পড়ে থাকা – শুধুমাত্রই অতীত আঁকড়ে গৌরব করায় কোনো কাজের কাজ হয় না ! গুরু মহারাজ বলেছিলেন, ” অতীতকে সম্মান করবি, অতীত থেকে শিক্ষাগ্রহণ করবি, কিন্তু আহাম্মকের মতো অতীত আঁকড়ে পড়ে থাকবি না !”
তাহলে একটা প্রশ্ন আবার এসেই যাচ্ছে – ”পুরোনো সেই বনগ্রামের কথা”ও তো সেই পুরোনো বা অতীতের-ই কথা ! তবে এটাও কি ঐ একই দোষে দুষ্ট ? না – তা নয় ! কারণ এখানে বেশিরভাগটাই গুরু মহারাজের মুখের কথা! আর গুরু মহারাজকে নিয়ে যে আলোচনাগুলি হচ্ছে সেই আলোচনায় একজন ব্যক্তির মুখের কথাই শুধু ব্যক্ত হচ্ছে না ! বহু মানুষ – বিভিন্নভাবে গুরুমহারাজকে দেখেছেন, তাঁর শ্রীমুখ থেকে বহু কথা শুনেছেন – এমন বহু মানুষ এখনো স্থূলশরীরে বিদ্যমান রয়েছেন _তাদের শোনা কথাও ব্যক্ত হচ্ছে । তাছাড়া পাঠকেরাও প্রায় সবাই কোনটি ‘ভগবানের কথা’ _তা বেশ ভালোমতোই বোঝেন ! কারণ ভগবানের কথাগুলির মধ্যেই যে আধ্যাত্মিক শক্তি সম্পুটিত রয়েছে। এইসব কথায় মানুষ মনে শান্তি পায়, জীবনে চলার পথে নানান দিশা খুঁজে পায়, এগিয়ে চলার অনুপ্রেরণা পায় !
এইজন্যেই তো বিভিন্ন স্থানে মহাপুরুষদের ‘জীবনী ও বাণী’ পাঠ করা হয়। তাঁদের বলে যাওয়া কথার ব্যাখ্যা করে উপস্থিত জনগণকে শোনানো হয় – যাতে সবার মঙ্গল হয়, সবার কল্যান হয়।
ভগবানের ‘বলে যাওয়া কথা’ বা ‘ভগবানের সাথে ঘটে যাওয়া’ কোনো ঘটনার কথা শুনতে ভক্তদের কখনোই boring লাগবে না ! সবসময়ই মনে হবে যেন নতুন কথা শুনছি ! “নব রে নব, নিতুই নব।” এটাও তো ভগবানের মহিমা ! কোনো ব্যক্তি হয়তো জীবনের ২০/৩০ বছর বা আরও বেশি সময় ধরে গীতা পাঠ করে যাচ্ছেন – কিন্তু তিনি কখনও bore হচ্ছেন না ! আমি অনেককেই বলতে শুনেছি এই ২০/৩০ বছর পরেও যখনই গীতা পাঠ করি – তখন মনে হয় যেন নতুন করে গীতার শ্লোকের অর্থ ধরতে পারছি, উপলব্ধি করতে পারছি ! গুরুমহারাজের নিজের লেখা যে বইগুলি রয়েছে অর্থাৎ ‘সহজতা ও প্রেম’, ‘বাউলের মর্মকথা’, ‘বাউল কথা প্রথম খন্ড ও দ্বিতীয় খন্ড’ – এই বইগুলি আমরা প্রায় ৩০ বছর ধরে পড়ছি কিন্তু কখনও মনে হয় না যে – “এগুলি সবই তো আগে পড়া হয়ে গেছে, আর নতুন কি পড়বো ? বরং মনে হয় – ‘ আরে ! আগে তো এইটা চোখে পড়েনি !” অথবা মনে হয় – ” ওঃ দেখেছো ! – গুরুমহারাজ তো তাঁর লেখায় এই ব্যাপারটা (হয়তো মনে কোনো জিজ্ঞাসার উদয় হয়েছিল–তার নিরসন করতে পারছিলাম না) আগেই এখানে লিখে রেখে গেছেন ! এতদিন চোখেই পড়েনি !” ‘ভগবানের মহিমা’ _ বলতে গেলে এটাকেও বলতে হয় ! (ক্রমশঃ)