শ্রী শ্রী গুরুমহারাজের জীবনে ঘটে যাওয়া নানান মহিমা শক্তির প্রকাশের কথা বলা হচ্ছিলো। গুরুমহারাজ নিজে যে কয়টি ‘ঈশ্বরের মহিমা’র কথা উল্লেখ করেছিলেন, সেগুলি ছাড়াও আমরা প্রায় ঐ ধরনেরই একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করেছিলাম। গুরুমহারাজ (অল্প বয়সে) হিমালয়ের কোনো দুর্গম অঞ্চল দিয়ে পায়ে হেঁটে হেঁটে গভীর অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাচ্ছিলেন ! সেই সময় কিছুটা স্থানে ওনার পা দুটো নরম নরম কোনো স্থানে পড়ছিল বলে ওনার মনে হয়েছিল ! কিন্তু সেই সময়ে সর্বক্ষণই তাঁর সমগ্র অন্তঃকরণ ঈশ্বরচিন্তায় মগ্ন থাকতো – তবু চলার পথে তিনি কিছুটা জায়গায় অনুভব করেছিলেন যে তাঁর পায়ের তলায় কঠিন পাথরের নুড়ির আঘাত না লেগে যেন নরম নরম কিছু লাগছিল ! উনি ভেবেছিলেন পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসা ঝরনার জলযুক্ত কাদামাটি হবে বোধয় ! গভীর অন্ধকার, আত্মমগ্ন অন্তঃকরণ, আর একটি আলোকবিন্দুর প্রতি লক্ষ্য রেখে আশ্রয় লাভের আশায় এগিয়ে চলা – এইগুলি ছাড়া আরো বেশী চিন্তা করার অবকাশ তাঁর ছিল না !
ঐ অবস্থায় গুরুমহারাজ সেই আলোর কাছে পৌঁছেও গিয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে উনি দেখেছিলেন একজন সন্ন্যাসী পাহাড়ের কোলে একটি ছোট্ট কুটীর বানিয়ে সাধন-ভজন করেন। তাঁরই কুটীরের সামনে জ্বলা ধুনির আগুন গুরুমহারাজ দূর থেকে দেখেছিলেন এবং সেইটাকে লক্ষ্য করেই ওখানে গিয়ে পৌঁছেছিলেন। গুরুমহারাজ যে পথে ঐ সাধুবাবার আশ্রমে পৌঁছেছিলেন – এইটা দেখে বা শুনে সেই সাধুবাবা যেন একটু অবাক হয়েছিলেন – কিন্তু সেই রাত্রে উনি গুরুজীকে কিছুই বলেন নি। তিনি কিশোর রবীন (গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দ)-কে আহার্য ও বিশ্রামের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।
ভোর বেলাতেই প্রাতঃকৃত্য সারার পর শুরু হবে আবার যাত্রা (সেইসময় সম্ভবতঃ গুরুজী সমগ্র হিমালয় ভ্রমণ করেছিলেন)! কিন্তু যাত্রা করতে গিয়েই ঘাবড়ে গেলেন কিশোর রবীন ! একি ! এ যে বিরাট খাদ ! প্রায় একটি পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ের গা পর্যন্ত পুরোটাই খাদ – কোনো রাস্তা থাকা তো দূরের কথা, গভীর গর্ত ! ফলে গুরুমহারাজ চলতে গিয়েও থমকে গিয়েছিলেন এবং অনেকক্ষণ থেমে থেকে তারপর ঐখানেই বসে পড়েছিলেন। সকাল থেকে দুপুর গড়িয়ে গেল – কিন্তু গুরুমহারাজ সেইখানেই বসেছিলেন, শুধু ভাবছিলেন এমনটা সম্ভব হয় কি করে ! গত রাত্রে এই সুদীর্ঘ পথে (যা ধ্বস নেমে গর্ত হয়ে গেছে )তো খাদ– কিন্তু সেই পথ ধরেই উনি এলেন কি করে ? ওনার পায়ের নিচে নরম নরম একটা অনুভূতি হয়েছিল, কিন্তু উনি মনে করেছিলেন হয়তো ভিজে মাটি (পাহাড়ের গায়েও অনেক সময় জলের সাথে বালি-মাটি ঝরে পড়ে৷) ছিল – তাই পায়ে নরম অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছিল ! কিন্তু তা তো নয় !
তাহলে কি হোতে পারে ? তবে কি মা জগদম্বা স্বয়ং তাঁর প্রিয় পুত্রকে রক্ষা করেছেন ! কিন্তু কিভাবে ? প্রথম যখন গুরুমহারাজের পা – পাহাড়ি রাস্তা থেকে খাদে পড়তে যাচ্ছিলো, তখনই মা জগদম্বা হাত পেতে দিয়েছিলেন!! ফলে গুরুমহারাজের শরীর আর খাদের অতলে পড়ে যেতে পারে নি !! এইভাবে পুরো খাদটা গুরুমহারাজ একপা একপা করে যতই এগিয়ে গেছেন, ৺রী মা-র দুটি হাত ততোই এগিয়ে এগিয়ে পেতে পেতে দিয়েছেন !! যাতে গুরুমহারাজ পায়ে পায়ে সেই হাতে হাতে ভর দিয়ে এগিয়ে যেতে পারেন !! আর সত্যি সত্যি এমনটাই হয়েছিল!! মা জগদম্বা বিরাট শরীর ধারণ করে দুটি হাত পেতে তাঁর প্রিয় সন্তানকে খাদে পড়ে যাবার হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন !! মা জগদম্বার তাঁর প্রতি এত করুণা !! এই কথা ভাবতে ভাবতে এবং ৺রী মায়ের প্রতি মনে মনে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে গিয়েই গুরুমহারাজের সকাল থেকে দুপুর হয়ে গিয়েছিল কিন্তু ওনার হুঁশ ছিল না !
ওই আশ্রমের সন্ন্যাসীটি সকাল থেকে গুরুমহারাজকে লক্ষ্য রাখছিলেন। সকাল থেকে ঠাকুরের পূজাে-পাঠ সেরে, ভোগ রান্না ও ভোগ নিবেদন করে উনি গুরুমহারাজকে (কিশোর রবীনকে) ডেকে তোলেন এবং ভিতরে নিয়ে গিয়ে প্রসাদ খাওয়ান। খাওয়া-দাওয়ার পর গুরুমহারাজ (কিশোর রবীন) ঐ সাধুবাবাকে সমগ্র ব্যাপারটা বলার চেষ্টা করতেই – সেই সাধুবাবা গুরুমহারাজকে থামিয়ে বলে ওঠেন – ” আমি সবটাই জানি। কাল রাত্রে যখন তুমি এই পথে এসে আমার কুটিয়ায় উঠেছিলে – আমি তখনই বুঝতে পেরেছিলাম যে এই ঘটনার মধ্যে ঈশ্বরের কিছু লীলা নিহিত আছে ! আমি তোমাকে সকাল থেকেই লক্ষ্য রাখছিলাম এবং আমি আশা করছিলাম যে নিশ্চয়ই তুমিও এই ব্যাপারটা নিজে নিজেই বুঝতে পারবে। এখন তুমি নিশ্চয়ই বুঝেছো যে সর্বশক্তিমান ইশ্বর চান যে তোমার শরীরটা এখনো বেশ কিছুদিন পৃথিবীতে থাকুক ! কেননা এই শরীর দিয়ে নিশ্চয়ই তিনি আরো কিছু লীলা করাবেন৷”
সাধুবাবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গুরুমহারাজ চলে এসেছিলেন কিন্তু সেইদিন থেকেই উনি সম্পূর্ণরূপে ঈশ্বর বা ৺রী মা জগদম্বার উপর নির্ভরশীল হোতে পেরেছিলেন। উনি এটা বুঝতে পেরেছিলেন যে, ৺রী মা তাঁর প্রিয় সন্তানকে সবসময়, সব অবস্থায় ঠিকই রক্ষা করবেন। (ক্রমশঃ)