গুরু মহারাজ জপের ব্যাপারে বলেছিলেন – জপ তিন রকম উপায়ে করা যায়_ ১)পুন: পুন: উচ্চারণ বা বাচিক ,২)_ বাইরে উচ্চারণ হচ্ছে না কিন্তু মনে মনে জপ হয়ে চলেছে অর্থাৎ মানসিক এবং ৩) উপাংশু _এটাই জপের শ্রেষ্ঠ পদ্ধতি। যেটা গুরু মহারাজ বলেছিলেন _যা শ্বাসে-প্রশ্বাসে অন্তর্জগতে নিরন্তর করতে হয় ৷ চলতে ফিরতে, যে কোন কাজ করতে করতে জপ করা যেতে পারে। এতে শুচি_অশুচি নাই। পায়খানা ঘরে বসেও জপ করা যায়। মানুষ সারাদিনে ২১৬০০ বার শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ করে , যারা জপে সিদ্ধ তাদের জাগরণে, শয়নে, স্বপনেও জপ হয়ে যায় — অর্থাৎ সারাদিন-রাত ২১৬০০ বার জপ হয় ৷ আর লক্ষ জপ বা এক লক্ষ জপের যে বৈষ্ণবীয় ব্যাখ্যা আছে সে ব্যাপারে উনি বলেছিলেন – ব্যাখ্যা যাই হোক না কেনো , প্রকৃতপক্ষে সেই ‘এক ‘ -কে লক্ষ্য রেখে জপ-ই এক লক্ষ জপ ৷ জপেও সিদ্ধি আসে — সাধক বাক্ সিদ্ধ হতে পারে বা অন্যান্য কিছু সিদ্ধিও তার করায়ত্ত হতে পারে, যা দিয়ে অনেক সাধক কিছু মানবকল্যাণমূনক কাজও করে থাকে। কিন্তু এসব করতে গেলেই শক্তিক্ষয় ! যেটুকু জন্মেছিল তা কিছুদিনের মধ্যেই নি:শেষ হয়ে যাবে ৷ তাই জ্ঞানী সাধকেরা কখনই ঐ কর্মটি করেন না ৷ তাঁরা বালক ভাব , পিশাচ ভাব , উন্মাদ ভাব ইত্যাদি যে কোন একটা ভাব অবলম্বন করে নেন — যাতে লোকে তাঁদেরকে বিরক্ত করতে না পারে ! ঐগুলো যেন ছদ্ম-আবরণ — মানুষের অত্যাচার থেকে বাঁচার ঢাল । তবে যাঁর সমুদ্রের সঙ্গে ড্রেন বা খাল কাটা হয়ে গেছে — তার আর কোন ভয় নাই ! দেখতে ছোট জলাশয় মনে হলেও ঐ ডোবার জল আর কোনদিনই শুকাবে না । বরং তাতে মাঝে মাঝেই জোয়ার ভাটার হিল্লোল-কল্লোল দেখা যাবে – যেন উপছে পড়ছে ! “ধরো , নাও সে কিশোরীর প্রেম – নিতাই ডাকে আয় ! সে প্রেম কলসে কলসে ঢালে , তবু না ফুরায় ” (অর্থাৎ যে মহাসাধকের সাথে সরাসরি ঈশ্বরের যোগাযোগ হয়েছে তাদের কথা বলা হচ্ছে!)!
১৯৮৪ সালের ঐ দিনটার(দীক্ষার দিন) পর থেকেই বনগ্রাম পরমানন্দ মিশনকে কেমন যেন একান্ত আপনার বলে বোধ হতে থাকলো।মনে হতো এটাই আমাদের নিজেদের বাড়ী আর এর বাইরের জগৎ টা যেন অপরের।মনে হতো বনগ্রাম আশ্রম টাই জীবন- আর বাইরের জগৎটা যেন মৃত্যুর হাতছানি ! যেদিন আশ্রম যাবার কথা হতো -তার আগের দিন থেকে কত প্রস্তুতি , সে কি আনন্দ !আর প্রত্যেক বার মিশন থেকে চলে আসার সময় ব্যাথায় বেদনায় কেমন যেন বুক টা চিন চিন করত । একবার বনগ্রামে মুখার্জী বাড়িতে রাতের সিটিং-এ, যেদিন উনি -নিজেকে প্রায় প্রকাশ করেই ফেলেছিলেন(যেটা গুরু মহারাজ প্রায় একদমই করতে চাইতেন না) -সেদিন ওনাকে আমি বলেছিলাম -” গুরু মহারাজ! কি হতভাগা আমরা !আপনি স্বয়ং বনগ্রামে বিরাজ করছেন ,তা জানতে পেরেও আমরা আপনার কাছ থেকে দূরে দূরে চলে যাই!”_উত্তরে পুরুষোত্তম ভাবে উনি উত্তর দিয়েছিলেন -“দুরে চলে যাস__মানে !আমার কাছ থেকে দুরে কোথায় যাবি?সপ্ততল -পাতাল,ভূতল,সুতল,তলাতল,রসাতল ……ইত্যাদি সপ্ত নিম্ন লোকে ?অথবা ভূলোক,ভবলোক,স্বর্গলোক,জনলোক,মহলোক ইত্যাদি সপ্ত ঊর্ধ্বলোকে ? কোথায় যাবি? যেখানেই যাবি সেখানেই সেই ‘আমি’ ই আছি । আমার কাছ থেকে দুরে কেউ কখনো যেতে পারে না !”
‘পুরুষোত্তম ভাবে’_কথাটা বললাম, তার কারণ আমরা লক্ষ করতাম এক এক সময় উনি এক এক রকম ভাবে বিরাজ করতেন ।
১| কখনও কখনও সাধারণ উচ্চ কোটির সাধক বা কোনো মহাপুরুষের ভাব অবলম্বন করতেন । কিছু কিছু সিদ্ধির প্রয়োগও হয়ে যেত-সেইসময় ।ওনার কথা বার্তা শুনেও মনে হতো উনি অনেক সাধন ভজন করেছেন ফলে কিছু শক্তিলাভ করেছেন ।
২| কখনও কখনও উনি অবতার ভাবে থাকতেন-কথায় কথায় বলতেন মা জগদম্বা সবসময় ওনাকে রক্ষা করেন, guide করেন। কেউ কোনো সমস্যার কথা বললে বলতেন ” আচ্ছা, আমি মা এর কাছে প্রার্থনা জানাবো। আমি মা -য়ের কোলে বসে আছি ,মা যখন যা করতে বলেন তাই করি “।
৩| আবার কখনও কখনও পুরুষোত্তম ভাব!স্পষ্ট করে বলে দিতেন “উনি কে- কি জন্য এসেছেন !” উনি নিজেই হজরত,যীশু -ইত্যাদি সহ অন্যান্য মহাপুরুষদের স্থিতি এবং তাদের কার্যকারিতা সম্বন্ধে এমন ভাবে আলোচনা করতেন _তা শুনে স্পষ্ট বোঝা যেতো যে,উনি এই সমস্ত মহাপুরুষদের‌ও উচ্চ স্থিতিতে অবস্থান করছেন। আবার পৃথিবী সহ অন্যান্য গ্রহাদি ,নক্ষত্র মন্ডল ,ব্ল্যাক হোল,বিগব্যাং ইত্যাদি বিষয়গুলি যেন হস্তমলকবৎ—এমন ভাবে বর্ণনা করতেন ! আমার নজরুলের সেই বিখ্যাত গানটির কথা মনে পড়তো “খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে বিরাট শিশু আনমনে ।” সেই জন্যই “পুরুষোত্তম ভাব” কথাটি উল্লেখ করা হোলো।
আমার মতো বহু ভক্তরাই সেই সময় জানতো বনগ্রাম পরমানন্দ মিশন টাই তাদের নিজেদের বাড়ী । আর পরমানন্দ মিশনের জন্য কিছু কাজ করতে পারাটাই যেন মানব জীবনের সার্থকতা ! বহু মানুষ ভাবতো যে রিটায়ার্ড লাইফে হয় এসে বনগ্রামে বানপ্রস্থ জীবন যাপন করবে অথবা বনগ্রামের কাছাকাছি কোনো স্থানে একটু জায়গা কিনে ছোট ঘর বাড়ী বানিয়ে সেখানে বসবাস করবে এবং সারাদিন আশ্রমে এসে যা হোক কিছু কাজ করে গুরুমহারাজের সেবা করবে ।কিন্তু গুরুমহারাজ যে এই ভাবে চলে যাবেন -তা ভাবাই হয়ে ওঠেনি । বরং আমরা (অন্তত আমি) ভাবতাম গুরুমহারাজ অনেকদিন(বহুকাল) বাঁচবেন, আর আমরা তাঁর কোলে বা পদতলে মাথা রেখে একে একে মারা যাব বা পরমানন্দলোকে চলে যাব। আর তিনি থেকেই যাবেন__বৃদ্ধ হয়ে অতিবৃদ্ধ হয়ে, কারণ তিনি আমাদের ভার নিয়েছেন যে!
তাঁর সুক্ষশরীর, তাঁর কারনশরীর এসবের কোন ধারণাই আমাদের ছিল না। আমরা তাঁর স্থুলশরীরকেই ভালোবাসতাম, শ্রদ্ধা করতাম, ভয় করতাম, ভক্তি করতাম। উনি প্রায়ই বলতেন_”তোরা কি আমাকে ভালোবাসিস? ভালোবাসিস তো আমার শরীরটা কে! দেখবি এই শরীর যখন থাকবে না তখন তোদের অনেকেই আর বনগ্রামে আসবি না”। কথাগুলি শুনে মনে হতো যে_তাই আবার হয় নাকি? বনগ্রামে না গিয়ে থাকতেই পারবো না! বনগ্রাম আমাদের বাল্যের ক্রীড়াভূমি, যৌবনের উপবন, বার্ধক্যের বারানসী। কিন্তু তিনিই ঠিক ছিলেন_আমরাই ভূল ছিলাম। এখন মনে হয়_” সে রামও নাই সে অযোধ্যাও নাই “। রাম আছে কিন্তু ‘সে’_ রাম নাই। অযোধ্যা আছে কিন্তু ‘সে’ অযোধ্যা নাই ।প্রানপাখীটিই যে খাঁচা ছেড়ে বেরিয়ে চলে গেছে! সে এখন যে বনে গিয়ে বাসা বেঁধেছে সেখানে আবার নব বৃন্দাবন সেজে উঠছে! নতুন করে ঘুঁটি সাজানোর কাজ চলছে_নতুন ছক পাতা হচ্ছে_নতুন খেলাঘর রচনা হচ্ছে_নতুন লীলাবিলাস সংঘটিত হবার জন্য।
এবার দেখতে হবে আমরা কোন দলে__১)উনি একটা নিরাপদ আশ্রয় করে দিয়েছেন, সেটাকে আঁকড়ে এই জীবনটা বা পরবর্তী জন্মগুলো কাটিয়ে দেওয়া।
২)_”জয় গূরূজী” বলে অনিশ্চিত অথচ পরমনির্ভরের পায়ে ঝাঁপিয়ে পড়া। আবার ছিটেবেড়া ঘরে শোওয়া, আবার Rice to Rice খাওয়া! সুন্দরতম মানুষটির অপার্থিব প্রেমের স্পর্শ পাওয়া, দেবদূর্লভ ভাগবতী তনুর সঙ্গসূধা___ কোনটা????