গুরুমহারাজ (স্বামী পরমানন্দ) মানবজীবনে ইষ্টমন্ত্র বা বীজমন্ত্রের ভূমিকা এবং অন্যান্য মন্ত্রের সম্বন্ধে কথা বলছিলেন ৷ উনি এই কথাগুলি বলছিলেন কাটোয়ার কাছে বারেন্দা আশ্রমে – গভীর রাতের আলোচনা চক্রে ! বনগ্রামে একসময় আলোচনার সময় গুরুমহারাজ বলেছিলেন – ” বিভিন্ন বৈদিক মন্ত্র বা দেব দেবীর প্রণাম মন্ত্রগুলিও সংস্কৃতে যদি সঠিক ছন্দ ও সুরে পাঠ করা হয় তাহলে প্রাণায়াম হয়ে যায় এবং এই সুর ও ছন্দ মস্তিষ্কের কোষগুলিকে সুস্থ ও সুন্দর রাখে ! ফলে বৈদিক মন্ত্র পাঠরত ব্যক্তির শরীরের গ্রন্থিসমূহেরও সাম্যভাব আসে ! মানবশরীরের এন্ডোক্রিন বা অন্তঃক্ষরা গ্রন্থিগুলির অসামঞ্জস্যের জন্যই মানুষের যত রোগ-ব্যাধি , অস্থিরতা , উদ্বিগ্নতা , ক্রোধ , কামুকতা ইত্যাদির প্রকাশ হয় । শুধুমাত্র একজন যোগী (রাজযোগী , ভক্তিযোগী , জ্ঞানযোগী , কর্মযোগী ইত্যাদি)-রই অন্তঃক্ষরা গ্রন্থিগুলির সাম্যতা আসে এবং তার জীবনে সমস্ত কাজে ছন্দবদ্ধতা আসে , সমস্ত ইন্দ্রিয়ের উপর নিয়ন্ত্রণ আসে ! নিজের অন্তঃপ্রকৃতিকে স্ববশে এনে যোগী মহাপ্রকৃতিকেও ‘বশ’ করতে পারেন বা নিয়ন্ত্রণ করতে সমর্থ হন ৷ যোগশাস্ত্রে রয়েছে “প্রযত্নশৈথিল্য” এবং “অনন্ত সমাপত্তি মনঃ”৷ গুরু মহারাজ বলেছিলেন — “প্রযত্নশৈথিল্য” হচ্ছে Relaxation of body এবং “অনন্ত সমাপত্তি মনঃ” হচ্ছে Relaxation of mind ! যোগীরা যেকোন ভয়ঙ্কর প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মধ্যে অবিচল থেকে যদি ঐ প্রাকৃতিক বিপর্যয়টির (ঝড় , ভূমিকম্প , সাইক্লোন ইত্যাদি) নির্দিষ্ট Vibration -এ নিজের শরীরের (হয়তো নির্দিষ্ট কোন গ্রন্থির) Vibration যদি Tuning করা যায়, তাহলে ঐ ভয়ঙ্কর প্রাকৃতিক শক্তি ঐ যোগীর শরীরে প্রবেশ করে! এইভাবে যোগসিদ্ধ যোগী প্রয়োজনে কোনস্থানে ভয়ঙ্কর প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটিয়ে দিতে পারেন – অাবার প্রয়োজনে ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে রুখে দিতেও পারেন ! আচার্য্য শঙ্কর এই কায়দাতেই ভয়াবহ বন্যার হাত থেকে তাঁর গুরু গোবিন্দপাদের আশ্রম রক্ষা করেছিলেন , শুধুমাত্র একটা ছোট কলসীর মধ্যে সমগ্র বন্যার জলকে ভরে ফেলেছিলেন ৷
‘প্রযত্নশৈথিল্য’ সিদ্ধি থাকলে যোগীর শরীরে ঐ শক্তি আসে , আর ‘অনন্ত সমাপত্তি মনঃ’ সিদ্ধ ব্যক্তির মনোজগতে ঐ বিপুল পরিমাণ শক্তি সমাহিত হয়ে যায় ! ঐ সাধক ইচ্ছা মাত্রই তা প্রয়োগ করতে পারেন ! হঠযোগীদের মধ্যে যে অলৌকিক শক্তি দেখতে পাওয়া যায় সেগুলি এই ধরণের সাধনার সিদ্ধির ফল !
আমরা আবার বারেন্দা আশ্রমে ফিরে আসি – ঐ রাত্রে গুরু মহারাজ আরও অনেক মন্ত্রের কথা বলেছিলেন । সেগুলো-কে উনি সঠিক পদ্ধতিতে কিভাবে জপ করতে হয়, তা উচ্চারণ করেও দেখিয়েছিলেন! ওনার উচ্চারিত মন্ত্রগুলির সুর ও ছন্দ অনেকটা South-এর পন্ডিতরা যেমন উচ্চারণ করে – ঠিক তেমন লাগাছিল !
উনি “ওঁ” মন্ত্রও উচ্চারণ করে দেখালেন – কিভাবে সেই মন্ত্র নাভি প্রদেশ থেকে সৃষ্টি হয়ে যেন সহস্রার পর্যন্ত সঞ্চারিত হচ্ছিল ! এইভাবে বিভিন্ন মন্ত্র এবং ত নির্দিষ্ট সুরে বা ছন্দে সেগুলি উচ্চারণ , তাদের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা অর্থাৎ শরীরে ও মনে এদের সুপ্রভাব – এসব উনি সেই রাত্রে সুন্দর করে আমাদেরকে বুঝিয়ে বলে দিয়েছিলেন !
আজও যখন আমরা মাঝে মাঝেই ঐ ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করি – তখন এটাই ভাবি যে , উনি সেই রাতে ‘মন্ত্র’ নিয়ে এত বিস্তারিত আলোচনা কেন করেছিলেন ? আমাদের মনে হয়েছিল যে – উনি হয়তো সেই রাত্রেই এই আশ্রমের বাতাবরণটাকে ‘আধ্যাত্মিক ক্ষেত্র’ হিসাবে তৈরী করে দিয়েছিলেন ৷ তখন থেকে আজ পর্যন্ত (প্রায় ১৯ বছর হয়ে গেল) বারেন্দা আশ্রমের গুরু মহারাজের ঘরটি কিন্তু প্রচন্ড Vibration -যুক্ত ! চোখ বন্ধ করে একটু ধ্যান-জপ করতে বসলেই মন হু হু করে concentrated হয়ে যায়!
এটি ছাড়াও আরও হাজার কারণ থাকতে পারে – কারণ গুরু মহারাজের প্রতিটি ‘চলা’ বা প্রতিটি ‘বলা’ – মানবকল্যাণের নিমিত্ত _ এটা আমরা মনে প্রাণে বিশ্বাস করি ! তাই উনি ঐ ব্যাপারটা সেদিন ঘটালেন যখন — তখন নিশ্চই তার বিশেষ কোন কারণ আছে-ই আছে , সেটা পরে হয়তো কোন সময় প্রকাশও পাবে ! হয়তো উনি স্বয়ং পরের শরীরে এসে এইরকম বহু রহস্যের উত্তর দেবেন – তখন মানুষ সব জানতে পারবে ! আর এখন আমরা শুধু একটা ‘আন্দাজ’ করতে পারি বা একটা ধারণা দিতে পারি – এইমাত্র !
সেই রাতে গুরুমহারাজ “ক্রিং” এবং “ক্লীং” এই দুটি বীজমন্ত্রের কথাও বলেছিলেন। “ক্লীং” হল কৃষ্ণমন্ত্রের বীজ। ‘ক’, ‘ল’, ং_এই সব বর্নের অর্থও উনি ব্যাখ্যা করেছিলেন! আবার “ক্রিং” মন্ত্র হল কালীমন্ত্রের বীজ। এই বীজের ‘ক’, ‘র’, বা ং-এর ব্যাখাও করেছিলেন _তবে সব কথা মনে নেই! শুধু এটা মনে আছে যে কালীমন্ত্র নিষ্ঠাসহকারে জপ করলে কাম বা কামনা লয়প্রাপ্ত হয় এবং কৃষ্ণমন্ত্র নিষ্ঠাসহকারে জপ করলে কাম বা কামনা বশে আসে।
একটু আগে মানুষের শরীরের অভ্যন্তরে থাকা এন্ডোক্রীন গ্রন্থিসমূহের সাম্যতার কথা বলা হচ্ছিল। সেই প্রসঙ্গে অন্য কোন একটা সিটিং-এ গুরুমহারাজের কাছে যা শুনেছিলাম _সেটা এখানে প্রাসঙ্গিক হতে পারে ভেবে বলা হচ্ছে…।
উনি বলেছিলেন __পরিবারের কোন সন্তানকে, শিশু অবস্থা থেকেই যদি বাবা-মায়েরা ঠিকঠাক নজরে রাখতে পারে এবং যত্ন নিতে পারে _তাহলে সেই সন্তান অবশ্যই সৎ, সুস্থ ও সুন্দর হয়ে উঠবে!
শিশুরা সাধারণত একটু দুরন্ত হয় _কিন্তু অবাধ্য, একগুঁয়ে শিশু_ সবসময় বায়না করছে, ঘ্যানঘ্যান করছে, অথবা এমনও শিশু দেখা যায়! আবার দেখা যায়, কোন কোন শিশুর মধ্যে নিষ্ঠুরতা প্রকট, _সে তার চেয়ে ছোটদেরকে বা সমবয়সীদেরকে মারধর করছে, অত্যাচার করছে!শিশুদেরকে ছোটবেলা থেকে ভালোভাবে watch করলে _এই ধরনের অনেক সমস্যার কথা বাড়ির লোক জানতে পারবে। গুরুমহারাজ বললেন _এই সমস্ত সমস্যা থেকে শিশুরা মুক্ত হতে পারে একমাত্র ‘যোগা'( yoga) -র দ্বারা! খুব ছোটবেলা থেকেই যদি শিশুদেরকে কিছু যোগাসন এবং প্রানায়াম শেখানো হয়, আর এর সাথে সাথে আয়ুর্বেদিক বা হোমিওপ্যাথি ওষুধ খাইয়ে শিশুটির কফ, পিত্ত, বায়ুর সাম্যতা বজায় রাখা যায় __তাহলে ঐ রূপ অবাধ্য, একগুঁয়ে, ‘একনশিরে’ শিশুও সভ্য, ভদ্র, সুশীল হয়ে উঠবে! এরা যত বড় হবে ততই এরা সুঠাম শরীরের অধিকারী হবে এবং স্বভাব সুন্দর হবে! এইভাবে আদর্শ পিতামাতা সমাজকে একটা সুস্থ – সবল নাগরিক উপহার দিতে পারে!
এই ধরণের নাগরিকেরা শুধুমাত্র শরীরে ই সুস্থ হবে _তা নয়! এরা সুস্থ মনেরও অধিকারী হবে! আজকের শিশুরাই তো যে কোন জনজাতির ভবিষ্যৎ! তাই পরবর্তীতে শরীর ও মনের দিক থেকে সম্পূর্ণ সুস্থ মানুষের হাতে যদি দেশের ভার পড়ে _তবেই তো সেই সমাজের সর্বাঙ্গীন মঙ্গল হবে!! অসুস্থ শরীর এবং অসুস্থ মনের লোকজন সমাজের শীর্ষে থাকলে _সেই সমাজ আরও দুষ্ট হবে, দুষনমুক্ত কখনই হবে না!!! (ক্রমশঃ)