গুরু মহারাজ (স্বামী পরমানন্দ) যখন 1991 সালে আমাদের বাড়ি এসেছিলেন তখনকার কথা হচ্ছিল ! উনি এখানে এসেছিলেন নভেম্বরের শেষাশেষি ! তখন আমাদের গ্রামে সবে নবান্ন হয়েছে – তার অর্থ অগ্রহায়নের ৯/১০ তারিখ হবে । দু-রাত্রি গুরু মহারাজ ছিলেন ৷ পরদিন খাওয়া-দাওয়া করে আবার তপনদার (বর্ধমান , খালবিল মাঠের তপন রায়) মোটর সাইকেলে চড়ে উনি চলে গেলেন তপনদার বাড়ি (বর্ধমান অথবা ওর দেশের বাড়ি) ৷ সেই সময় আমার স্ত্রী রুনুর খুব শরীর খারাপ ! একে ঠান্ডা লেগেছিল , তায় খেতে পারছে না – সেই নিয়েই গুরু মহারাজ এসেছেন , তাই ছুটে ছুটে সব কাজই করতে হচ্ছিল ! চলে যাবার আগের রাতে আমি এবং তৃষাণ মহারাজ ওকে জোর করে গুরু মহারাজের কাছে পাঠালাম শরীর খারাপের কথা জানানোর জন্য ! সেদিন বাড়ী ফাঁকা – কাজেই গুরু মহারাজও ঘরে একাই ছিলেন ৷ অনেকক্ষণ পর গুরু মহারাজের ঘর থেকে ও বেড়িয়ে এল – আমরা অধীর আগ্রহে বাইরে দাঁড়িয়ে! বেরোতেই জিজ্ঞাসা করলাম – “কি হল ! গুরু মহারাজ কি বললেন ?” ও বলল – ” গুরু মহারাজ খুব তাড়াতাড়ি আশ্রমে যেতে বললেন ।”
তখনও গুরু মহারাজের জন্মদিন বনগ্রামেই পালন হোত (সেটাই শেষবার) ! আমি ভাবলাম এইতো মাসখানেকের মধ্যেই ২৫-শে ডিসেম্বর – তখনই নাহয় বনগ্রাম যাওয়া যাবে ! তখন একটা বাস কাটোয়া থেকে Direct মালডাঙা-মন্তেশ্বর হয়ে জাবুইডাঙা যেতো ! জাবুইডাঙা হয়ে ওটা চলে যেতো বর্ধমান – পরের দিন আবার ওই রুট ধরেই ফিরে আসতো ! বাসটা কাটোয়ায় ছাড়তো ১১টা ১১-৩০টায় , ওখানে পৌঁছাতে ২টো ২-৩০টায় , ফলে আমাদের দিব্যি বিকালের সিটিং শোনা হোত ৷ আবার পরদিন সকালে ৬-৩০টায় জাবুইডাঙায় বাসটা ধরতে পারলেই ৯টা ৯-৩০য় কাটোয়া । ঐ সময় আমাদের এখান থেকে (কাটায়া অঞ্চল) অনেক লোক বনগ্রাম যাতায়াত কোরতো ! আমাদের সুবিধার জন্য ভগবান (স্বামী পরমানন্দ) এই একটা বিশেষ ব্যাবস্থা করে দিয়েছিলেন ! পরে শুনতে পেয়েছিলাম যে ওই বাসটা উঠে গেছে — ঐ ধরণের কোন বাসই এখন আর চলে না !
যাইহোক , কথা হচ্ছিল রুনুর (আমার স্ত্রী) শরীর খারাপ নিয়ে । গুরু মহারাজ কিন্তু এখান থেকে তপনদার (বর্ধমান) বাড়ী গিয়েই তপনদার স্ত্রীকে বলেছেন যে শ্রীধরের স্ত্রীর শরীর খুব খারাপ , ওর বাচ্ছা হবে !
এদিকে আমরা কিন্তু কিছুই জানি না – উনি এখান থেকে (আমাদের বাড়ী) চলে যাবার ১ মাস পরে যখন আমরা বনগ্রাম আশ্রম গেলাম (২৫শে ডিসেম্বর উপলক্ষ‍্যে) তখন রুনুকে দেখেই উনি বললেন – ” তোর তো বাচ্চা হবে ! তাহলে এখন থেকে তুই এখানেই (বনগ্রাম পরমানন্দ মিশনে) থেকে যাবি বুঝলি! আমি মুরারীকে বলে দিচ্ছি – তোর থাকার সব বন্দোবস্ত করে দেবে । আর দীপ্তিকে (ডাক্তার মহারাজ) একবার দেখিয়ে কিছু ওষুধ নিয়ে নে ! আর একবার শ্রীধর কে ডেকে দিবি” রুনু গিয়ে আমাকে যখন বলল – ” তোমাকে গুরু মহারাজ দেখা করতে বলেছেন, আর আমাকে এখন থেকে ৫/৬ মাস বনগ্রাম আশ্রমেই থাকতে বলেছেন !” আমি তো এসব কথা শুনে আকাশ থেকে পড়লাম ! গুরু মহারাজের ঘরে গিয়ে বললাম – ” গুরুজী! আমাকে ডেকেছেন?”
উনি সেদিন যেভাবে আমার সাথে কথা বলেছিলেন – সেটা আমি এজন্মে কেন বোধয় জন্ম-জন্মান্তরেও ভুলব না ! আপনারাও শুনে আশ্চর্য্য হয়ে যাবেন – যে এমনটা হয় কি করে ! উনি সেদিন আমার সাথে রুনুর জন্মদাতা পিতা বা বাবার ন্যায় আচরণ করেছিলেন !আমি ওনার ঘরে ঢোকার পরেই উনি বললেন – ” ও-তুই! আয়! জানিস তো ! রুনুর বোধয় (!!) বাচ্চা হবে ! এখন থেকে ও এই আশ্রমেই থাকবে – কেমন ? আমি যতদিন আশ্রমে থাকবো – ও আমার কাছে কাছে থাকবে, আমার ঘরে ধ্যান-জপ করবে, আমার আসন পাতা বা তোলা _এইসব একটু কাজ করে দেবে, এতে ওর শরীর-মন দুই-ই ভালো থাকবে ! আগেকার দিনে তো গর্ভবতী মায়েদের মুনি-ঋষিদের তপোবনে পাঠিয়ে দেওয়া হোত – জানিস তো !
তবে তোর হয়তো একটু অসুবিধা হবে – তাও একটু কষ্ট করে চালিয়ে নিবি – কেমন ?”
আমি ওনার ঘরে বেদীর নিচে ওনার হাঁটু স্পর্শ করে ‘হাঁ’-“করে ঐ আশ্চর্য মানুষটার দিকে তাকিয়ে ছিলাম _মনে মনে ভাবছিলাম, ” ইনি কে!! ইনি কি ভগবান? ইনি কি মানুষ? ইনি কি রুনু র বাবা??”
আমি তো ওনার দাসানুদাস, হুকুমের চাকর হবার ও যোগ্য নই_আর সেই আমাকেই কিনা উনি কত বিনয় করে, কত যেন অনুরোধ করে কথাগুলো বলছেন! যেন দায় টা আমার নয়, দায় টা ওনার!!
আমি এখনো জানি না কোন মহাপুরুষের সংজ্ঞা _অথবা ভগবানকে কি করে ব্যাখ্যা করা যায়! কিন্তু কিছু কিছু ঘটনা তো তুলে ধরা যায়, আপনজনদের সাথে সেগুলি তো শেয়ার করা যায় _তারই প্রচেষ্টা এই “পুরোনো সেই বনগ্রামের কথা”!
এই কথাগুলো ‘একান্ত ব্যক্তিগত’, তাই বলা উচিত হয়নি বলে – অনেকে আমাকে ভুল বুঝতে পারেন _তাই আগে ভাগেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। হয়তো সত্যিই এই কথাগুলো বলার নয় _তবু বলা হোল! শুধু সেই মহান মানুষটার (এখানে ভগবান বলা হোল না) কথা, তিনি যে বলেছিলেন _”যেখানে যেমন – সেখানে তেমন, যখন যেমন-তখন তেমন, যার যেমন-তার তেমন”__সেই সব কথা বলার চেষ্টা করছি!
স্বামী পরমানন্দ একবার যাকে “বাবা” বলে ডেকেছেন _তো তার কাছে উনি পুত্রবৎ, যাদেরকে “মা” বলে ডেকেছেন, তাদের কাছে উনি শিশুবৎ,বন্ধুদের কাছে ideal বন্ধু, আর তাঁর সন্তানদের কাছে তিনি সর্বদাই ছিলেন পিতৃবৎ! যখন যে roll play করেছেন _একেবারে নিখুঁত! হিমালয়ের সেরা সেরা যোগী দের কাছে উনি যোগীশ্রেষ্ঠ, ইউরোপের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলির পন্ডিতমহলের কাছে উনি পন্ডিতশ্রেষ্ঠ, জ্ঞানী মহলে জ্ঞানীশ্রেষ্ঠ! আবার সাধারণ মানুষের কাছে উনি তাদের মনের মানুষ, তাদের প্রানের মানুষ, ভাললাগার মানুষ _ভালবাসার মানুষ!
হে মহান ভালবাসার মানুষ! তোমার প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধায় আমাদের মাথা সদা সর্বদা নুইয়ে পড়ুক – শুধু এই প্রার্থনা করি! তোমাকে চোখের জল ফেলে স্মরণ করা ছাড়া আর কিই বা করতে পারি প্রভু!!! (ক্রমশঃ)