শ্রী শ্রী গুরুমহারাজের কথা (বলা এবং লেখা) নিয়ে এখানে আলোচনা করা হচ্ছিলো। আমরা এখন ছিলাম গুরুমহারাজের “সহজতা ও প্রেম” গ্রন্থে উল্লিখিত “জীবন পথের পাথেয়”-রূপ বাণী-তে। গুরুমহারাজ তাঁর গুরুভাব প্রকাশিত হবার শুরুতে অর্থাৎ বনগ্রাম আশ্রম প্রতিষ্ঠা হবার পরে পরেই সমগ্র মানবজাতিকে উদ্দেশ্য করে যে মহান বাণী রেখে গিয়েছিলেন, তা হোলো – ” সিদ্ধান্তের কথা বলবো না, সিদ্ধান্ত অনেক শুনেছ। উপদেশ দেব না, উপদেশ অনেক পেয়েছ। না – কোনো বাদ নয়, বাদ-গ্রস্থ জীবনে বিবাদ উপস্থিত হয়, বাদের কথা বলবো না ! জীবনের কথা বলবো। যা তুমি হারিয়েছ, তা আমি খুঁজে পেয়েছি। তোমায় প্রদান করব পুনরুজ্জীবন।৷”
এটাই ছিল গুরুমহারাজের শিক্ষাদানের প্রারম্ভিক মহাবাণী ! “জীবনের কথা বলব”–! প্রতিটি মানুষকেই উনি ভীষণ মর্যাদা দিয়ে বলেছেন – ” প্রত্যেকটি মানবের মধ্যে রয়েছে সমুন্নত হবার ও দেবত্ব লাভের সম্ভাবনা ! সুতরাং কোনো মানবই হেয় বা অবজ্ঞার পাত্র নয়। মানব কখনই হীন বা তুচ্ছ নয়। “মানব পরমাত্মার প্রকাশ !” গুরুমহারাজ যে মানবের সর্বাঙ্গীন কল্যাণের নিমিত্তই শরীর ধারণ করেছেন, পরম করুণায় তাদেরকে টেনে তুলে (আত্মিক উত্তরণ) নিতে এসেছেন – তা স্পষ্ট বোঝা যায়,– গুরুমহারাজের এই কথাগুলির মাধ্যমে ! উনি বলেছেন – ” মানব, মহাপুরুষদের অনুসরণ করে মহাপুরুষদের সমকক্ষ হোক, মানব ক্রমোন্নতির দ্বারা বলিষ্ঠ হোক, মানবের আত্মভাব প্রতিষ্ঠা হোক – এটাই আমার একান্ত ইচ্ছা !” উপনিষদের ঋষিদের সেই সুমহান বাণীর পুনরাবৃতি, “উত্তিষ্ঠতঃ জাগ্রত প্রাপ্য বরান নিবোধত”!– কিন্তু কথাগুলি যেন আরো বেশী মধুমাখা, আরো বেশি বেশি স্নেহ-প্রেমে ভরা !
“মহাপুরুষদের অনুসরণ করে, মানব – সেই মহাপুরুষের সমকক্ষ হোক” – এইকথাটা কি সাংঘাতিক, কি bold !! সনাতন ঋষি-পরম্পরার অনুসারী যুগপুরুষগণ ছাড়া এই boldness কে কবে দেখাতে পেরেছে ? গুরুমহারাজ এটাই বারবার বলতেন – ” হয়ে ওঠো !” আগে ‘হয়ে ওঠো’– তারপর বাকি সকলকে তৈরি করো ! Be and make ! তোমার নিজেরই তেমন কিছু জমলো না –তবু তুমি মানুষজনকে ধরে ধরে জ্ঞান দিতে শুরু করলে – তাদেরকে পরমার্থদানের আশ্বাস দিতে শুরু করলে – এইখান থেকেই তো যত গন্ডগোলের সূত্রপাত ! এই পৃথিবীতে যত অশান্তি, দলাদলি, ভেদাভেদ – সবই এই ‘নিজে না হয়ে’ অপরকে তৈরি করার প্রচেষ্টার জন্য‌ই !
গুরুমহারাজ সরাসরি বলেছিলেন – ” মানবজাতির অনগ্রসরতা (চেতনার জাগরণ ও আত্মিক উত্তরণের ক্ষেত্রে)-র মূলে ধর্মবোধের অভাব !” এটাই সারকথা ! মুখে ধর্ম ধর্ম করা বা বাহ্যিক কিছু আচারের মাধ্যমে ধার্মিক সাজায় – কিচ্ছু হবে না ! প্রকৃত বিষয় হোলো – “ধর্মবোধ”। ধর্মের বিষয়সমূহ, বিভিন্ন মহাপুরুষের শিক্ষাসমূহ কি আমার নিজের জীবনে প্রকাশিত হয়েছে ? আমার মধ্যেও কি পূর্ব পূর্ব মহাপুরুষদের গুণসমূহ প্রকটিত হোচ্ছে ? আমিও কি কামনা-বাসনার মোহ থেকে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত হোতে পেরেছি ? আমিও কি এই পৃথিবীর রূপ-রস-শব্দ-গন্ধ-স্পর্শের আকর্ষণকে সম্পূর্ণ জয় করতে পেরেছি ? – এইসব না হোলে, শুধু শুধু আমার ধার্মিক সেজে আর লাভটা কি হোলো? আমার তো এখনো “ধর্মবোধ”-ই হয় নি, আমি এখনো নিজেকেই তৈরী করতে পারিনি – তাই আমার এখনো অপরকে জ্ঞান দেবার, অপরকে শিক্ষা দেবার, অপরকে উত্তরণের পথ দেখাবার অধিকার আসেনি ! ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের কথায় এখনো ‘চাপরাস’ পাওয়া হয়ে ওঠেনি।
গুরুমহারাজ অনেকটা আফসোসের সুরেই যেন বলেছিলেন – ” মানব ঋষি-মহর্ষি প্রবর্তিত পথ ভুলে বেদ-বেদান্ত, উপনিষদ ছেড়ে কতকগুলি নেতিবাচক, সংকীর্ণমনা, সম্প্রদায়িক নেতাকে অনুসরণ করছে, আর ধর্মের নামে অসংহতি, সংকীর্ণতা ও অসাম্যের বীজ বপন করছে। বিকৃত দেশাচার ও সাম্প্রদায়িক বিকারগ্রস্থ ক্ষমতাপিপাসু কিছু লোক ঘৃণা ও হিংসার কালো মেঘ সৃষ্টি করে মানবজাতির ক্রমোন্নতির ধারা ও প্রগতির পথকে রুদ্ধ করছে। ধর্মের নাম দিয়ে মানবকে দানবে পরিণত করছে।” গুরুমহারাজ আরও বলেছেন – “এর ফলে মানবগণ ধর্মের প্রকৃত পথ ও ভাব হতে দূরে সরে গিয়ে ভন্ডামিতে আকৃষ্ট হোচ্ছে। সমগ্র মানবসমাজ এক অবক্ষয়মুখী অবস্থার দিকে অগ্রসর হোচ্ছে !”
তাহলে কি দাঁড়ালো ? সাধারণ মানুষ যেন অনেকটাই বেচারা ! প্রকৃত ধার্মিক, মহাপুরুষ, সহজ মানুষদের শিক্ষাগ্রহণ না করে, তাদেরকে যথাযোগ্য মর্যাদা না দিয়ে – তারা ঐ নেতিবাচক, সংকীর্ণমনা, সাম্প্রদায়িক, বিকারগ্রস্থ নেতাকেই তাদের আদর্শ করে বসে। আর এরফলেই তারা বিভ্রান্ত হয়, পরিস্থিতির শিকার হয়। সুতরাং, সাধারণ মানুষকে অর্থাৎ আমাদেরকে এই পার্থক্যটা বুঝতেই হবে। মহাপুরুষগণের আদর্শকেই জীবনে গ্রহণ করতে হবে এবং জীবনের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। আর স্বামী পরমানন্দের ন্যায় যুগপুরুষদের বারবার আগমন হয় এইজন্যেই ৷।(ক্রমশঃ)