শ্রী শ্রী গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের কথা (বলা এবং লেখা) এখানে আলোচনা করা হচ্ছিলো। আমরা এখন যুগবতার, যুগপুরুষ গুরুমহারাজের একালের গীতা – “সহজতা ও প্রেম”- গ্রন্থের বিষয়সমূহের মধ্যে ছিলাম। গুরুমহারাজ বলেছিলেন – “তোমরা জীবন বিরোধী কিছু করো না। জীবনের ছন্দময়তায় জীবনমুখী হও। জীবন অতি মূল্যবান, একে নষ্ট করো না। এই জীবন মহাজীবনের দ্বারস্বরূপ। জীবনের মধ্যে দিয়েই পরমসত্য উপলব্ধি হয় – জীবনকে বাদ দিয়ে যা কখনই সম্ভব হয় না।”
কি অপরূপ কথামালা ! গুরুমহারাজ জীবনের পূজারী, আর হবেনই বা না কেন – একজন মহাজীবন-ই তো হোতে পারেন প্রকৃতপক্ষে ‘জীবনের পূজারী’ ! গুরুমহারাজের পূর্ব পূর্ব শরীরের লীলায় যে নামে বা যে রূপে তাঁর অবতরণ হয়েছিল – তাঁরাও প্রকৃত অর্থে ‘জীবনের পূজারী’ ছিলেন। এঁরা ছাড়া আর কে-ই বা ঠিক ঠিক জীবনের মূল্য দিতে পারেন ? কে-ই বা জীবনকে নিয়ে ঠিক ঠিক experiment (যাকে আমরা ‘সাধনা’ বলে জানি) করতে পারেন ? Ascending মানবেরা ঐ সকল descending যুগপুরুষদের শিক্ষাকে গ্রহণ করে তাদের নিজ নিজ জীবনকে কাজে লাগিয়ে একটু একটু করে “জীবনে”-র রহস্য উন্মোচিত করতে থাকে। সাধনার শেষে সমস্ত রহস্য অবগত হয়ে গেলে – সেই জীবন-ই তখন মহাজীবনে পরিণত হয়। আর সেই ‘মানুষ’ হয় অন্য মানুষ, সে মানুষ হয় “সোনার মানুষ” !
বাউল পরম্পরায় এই সোনার মানুষের-ই খোঁজ দেখা যায়৷ এর অর্থ হোলো – ‘সাধনার দ্বারা সাধারণ জৈব-জীবন থেকে মহাজীবনে উন্নীত হওয়া !
যাইহোক, এই প্রসঙ্গে গুরুমহারাজ আরও বলেছেন (সমস্ত মহাপুরুষদের-ই কথা)- “তোমার সাধনার পথে যাকে সবচেয়ে বড় বাধা বলে মনে হোচ্ছে, তুমি সেই বাধাকে যত এড়িয়ে চলার চেষ্টা করবে – ততোই ব্যর্থতায় ভুগবে।” এই কথার ব্যাখায় গুরুমহারাজ সহ সমস্ত মহাপুরুষরাই যে বিধান দিয়েছেন__তা হোলো এই যে, এই বাধাগুলি যতই সরাবার চেষ্টা করা হবে, মানবের চেতনা ততোই সেই বিষয়েই নিমগ্ন হবে। আর এটা কেন হবে ? তার কারণ হোলো – ঐ বাধাগুলি বাইরে কোথাও নাই, যা আছে সবই রয়েছে ঐ সাধকের অন্তঃর্জগতে ! তাই যতক্ষণ না ঐগুলির সাথে বোঝাপড়া হোচ্ছে – তাদের সাথে ভাব হোচ্ছে, ততক্ষণ কোনো সমস্যার সমাধান হবে না।
যেইমাত্র সাধক এইসব বাধার রহস্য বুঝতে পারবে (বোঝাপড়া হয়ে যাবে) তখন দেখা যাবে – যে গুলিকে বাধা বলে মনে হচ্ছিলো, তারাই তখন সাধনার সহায়ক হয়ে উঠবে।৷
এইজন্যেই গুরুমহারাজ বলেছেন – ” প্রিয় আত্মন ! তোমরা তোমাদের অন্তর্নিহিত শক্তিকে দমন কোরো না এবং বৃথা ইন্দ্রিয় ভোগ-লালসায় লিপ্ত হয়ো না। প্রথমটিতে বিকৃতি এবং দ্বিতীয়টিতে ব্যর্থতা সূচিত করে ৷ তোমাদের অন্তর্নিহিত মহাশক্তির জাগরন করো, সংযোজন কারো পরমতত্ত্বে ! জীবনকে করো রূপান্তর ! তোমাদের ভিতরে রয়েছে মহাশক্তির কেন্দ্র।”
জীবনকে মহাজীবনে রূপান্তরিত করার শিক্ষা আর কত সহজভাবে দেওয়া যায় !!! গুরুমহারাজের প্রতিটি কথায় আমাদের (মানবজাতির) প্রতি করুণা যেন ঝরে ঝরে পড়ছে ! আকুল আর্তি ফুটে উঠছে ! তাঁর কী ব্যাকুল প্রচেষ্টা – মানবের কল্যাণ করার জন্য ! কি সেই কল্যাণ? জীবের প্রকৃত কল্যাণ করার অর্থ তো অন্নদান-বস্ত্রদান-প্রথাগত শিক্ষাদান নয়, প্রকৃত কল্যাণ হোলো__ মানবের ‘বিবেকের জাগরন’ এবং ‘চেতনার উত্তরণ’ ঘটিয়ে জীবনকে মহাজীবনে রূপান্তর ঘটানো ! যুগে যুগে অবতরিত মহাজীবনগণ (মহাপুরুষগণ) এই কাজটাই করতে আসেন। কোন্ যুগপুরুষ সেই কাজে কে কতোটা successful হোলেন – সেটা তাঁরা পরোয়া করেন না ! এই যে একটা কথা রয়েছে – “আত্মনো মোক্ষার্থং জগদ্ধিতায় চ”, যে সমস্ত মহাজীবনদের আত্মমোক্ষ ঘটে গেছে – এবার তারা কি করেন টা কি? এই ব্যাপারে আমরা গুরুমহারাজকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম ! উনি উত্তর দিয়েছিলেন – ” এঁরা দু’ধরনের অবস্থায় থাকেন, বুদ্ধ এবং বোধিসত্ত্ব !”
ঐ দুটো কথারও ব্যাখ্যা করেছিলেন গুরুমহারাজ ! উনি যা বলেছিলেন তার মর্মার্থ হোলো এই যে, ‘বুদ্ধ’ অবস্থার মহাজীবনেরা যেন সূর্যের মতো ! যাঁরা দূর থেকে আলো এবং উত্তাপ দিয়ে সমগ্র জগতের কল্যাণ করেন। আর ‘বোধিসত্ত্ব’ স্থিতির মহাজীবনেরা যেন করুণাময়, স্নেহময়, প্রেমময় পিতা বা মাতার মতো ! সন্তানের কষ্ট দেখে, তাদের সংকট দেখে তাঁরা যেন একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাকে উদ্ধার করতে ! গুরুমহারাজ উদাহরণ দিয়ে বলেছিলেন – “যেমন ধরো – কতকগুলো মানুষ একটা কাদায় ভর্তি গভীর একটা গর্তে পড়ে গিয়ে নিজেদের মধ্যে নোংরা-কাদা মাখামাখি করছে ! তাদের কেউ কেউ ওতেই মজা পাচ্ছে, কিন্তু অনেকে ওঠারও চেষ্টা করছে – আর যতবার চেষ্টা করছে, ততবারই পিছলে পিছলে আবার সেই কাদাতেই পড়ে যাচ্ছে ! লোকগুলির এই অবস্থা দেখেও অনেকে মজা পাচ্ছে, অনেকে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে – কিন্তু একজন দয়াপ্রবণ ব্যক্তি ওই গর্তের পাড়ে একটু নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে, গর্তে পরা লোকগুলোকে কিভাবে উঠে আসতে হয় – তার direction দিতে শুরু করলেন। যেহেতু তাঁর ঐরূপ গর্ত থেকে উঠে আসার কায়দা জানা আছে – তাই তিনি এই কায়দা বা কৌশল(art) মানুষগুলোকে জানাতে লাগলেন। ফলে, সেই কৌশল অবলম্বন করে অনেকেই কাদাভর্তি গর্ত থেকে উঠে আসতে লাগলো।
এবার গুরুমহারাজ বললেন ‘বোধিসত্ত্ব স্থিতি’-র মহাজীবনের কথা। উনি বললেন – “বোধিসত্ত্বরা ঐরূপ দৃশ্য (কাদার গর্তে পড়ে যাওয়া মানুষদের) দেখার পর আর স্থির থাকতে পারেন না ! তাঁরা নিজেরাই ঐ কাদার গর্তে লাফিয়ে নেমে পড়েন এবং তারপর নিজেই কাঁধে করে চাপিয়ে ঐ গর্ত থেকে একে একে কাদামাখা মানুষগুলিকে বের করে দেন !”