শ্রী শ্রী গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের কথা (বলা ও লেখা) নিয়েই এখানে আলোচনা করা হচ্ছিলো। গুরু মহারাজ বলেছিলেন – ” বিচার বাদ দিয়ে আচার প্রবণতা বা আবেগের স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়ে কিংবা বিবেকবোধকে পদদলিত করে প্রকৃত সত্যের কণ্ঠরোধ করা সদাচার বা ধর্মাচার নয় – তা অজ্ঞানতা বা পাশবিকতা এবং অসহজ ও জীবনবিরোধী।” সুতরাং এইকথা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে, পৃথিবীতে যত ধর্মাচরণ রয়েছে, যত রকমের আচার রয়েছে – সেখানে ‘বিচার’ বড়ই প্রয়োজন ! ‘বিচার’-অর্থে যে শুধুই বুদ্ধিবিচার তা-ই নয়, প্রকৃতপক্ষে চাই বিবেক-বিচার, অর্থাৎ বিবেকের পরিচালিত বুদ্ধি বিচার ! যেকোনো ধর্মাচরণের আচার-অনুষ্ঠান বহুদিন ধরে চলে আসছে, পিতা-পূর্বপুরুষ পরম্পরা হয়ে আসছে – তাই “আমাকেও সেই একই আচার পালন করতে হবেই হবে”– এই স্থানেই প্রয়োজন হয় বিচারের, বিবেকচালিত বিচারের !
কেন আমি পূর্বপুরুষক্রমে চলে আসা আচার পালন করতে বাধ্য হবো ? আচার-নিয়মাদি পালন করে আমার পূর্বপুরুষদের বা আমার চারপাশের লোকেদের (যারা সেই একই আচার পালন করে থাকে) কতটা উপকার হয়েছে? তাদের কি চেতনার উন্নতি হয়েছে? তাদের কি বিবেকের জাগরণ হয়েছে? তাদের কি আত্মিক উত্তরণ হয়েছে? নিজ নিজ পরম্পরার যেসব মহাপুরুষ, মহাত্মার উল্লেখ রয়েছে – তাঁদের জীবনে যে সমস্ত ধর্মীয় অনুভূতি-সকল হয়েছিল, তার অন্ততঃ কিছু কিছুও কি আমার পূর্বজদের জীবনে বা আমার জীবনে ঘটেছে? যদি তা না ঘটে – তাহলে তো কোথাও না কোথাও মস্ত ফাঁকি থেকে যাচ্ছে!
এইভাবেই ধর্মীয় আচার পালনগুলি ধর্মীয় উৎসব-অনুষ্ঠানে পরিণত হয়ে যাচ্ছে। অবশ্য তার‌ও প্রয়োজনীয়তা রয়েছে__কারণ, তাতে মানব সমাজের পরস্পরের মধ্যে একটা মিলনের ভাব আসে, একে অপরের কাছাকাছি আসা যায়। একঘেয়েমি জীবন কাটাতে কাটাতে ‘bore’ হয়ে যাওয়া মানুষের কাছে উৎসব-অনুষ্ঠান যেন একরাশ খুশি, আনন্দের জোয়ার__ প্রাণদায়ীনী প্রেরণা।। কিন্তু ধর্মাচরণের মূল উদ্দেশ্য যা, অর্থাৎ আত্মজ্ঞান লাভ বা ঈশ্বরলাভ__তা কি এর দ্বারা সিদ্ধ হয়? তা তো হয় না !
সুতরাং বিচারের অবশ্যই প্রয়োজন। যুগ-বিবর্তনের সাথে সাথে – সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমার বাহ্যিক অনেককিছুই তো পরিবর্তন করতে হোচ্ছে এবং সেই সব পরিবর্তনের সাথে নিজেকে adjust-ও করে নিতে হোচ্ছে । তাহলে যা পরিবর্তন করলে আমার জীবনের উদ্দেশ্য সফল হবে, আমার অন্তর্জগতের পরিবর্তন হবে – তাও করতে হবে ব‌ই কি। এইটাই বিচার !
তাছাড়া বিচারের আরো বিষয় রয়েছে। পৃথিবীতে বহু মহাত্মা স্থান-কাল-পাত্র ভেদে তাঁদের শিষ্যপরম্পরায় নানাধরনের শিক্ষা দিয়েছেন। সবগুলি সম্বন্ধে জানতে গিয়ে বিভ্রান্ত না হয়ে বা সেইগুলির সমালোচনা, বিরোধ ইত্যাদি না করে,– সেইগুলির মধ্যে আমার পক্ষে কোনটা উপযোগী সেইটাকে গ্রহণ করতে হবে। আর সেইটাকে ধরেই আত্মিক উত্তরণের পথে এগিয়ে যেতে হবে। এই ব্যাপারে মহাজনবাক্য সর্বদা মাথায় রাখতে হবে – ” সবসে রসিয়ে, সবসে বসিয়ে – লিজিয়ে সব কা নাম। হাঁ-জী, হাঁ-জী, করতে রহিয়ে বৈঠিয়ে আপনা ঠাম্৷”
এইজন্যেই গুরুমহারাজ বলেছেন – ” আবেগের স্রোতে গা ভাসিয়ে কিংবা বিবেক-বোধকে পদদলিত করে প্রকৃত সত্যের কণ্ঠরোধ করা সদাচার বা ধর্মাচার নয়৷” অন্যত্র গুরুমহারাজ এই ব্যাপারটা বোঝানোর জন্য বলেছিলেন – ” এটা যেন সূর্যের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে রেখে আলো-কে আড়াল করার চেষ্টা !” কিন্তু এভাবে তো আলো-কে অস্বীকার করা যায় না, সত্য-সূর্যকে আড়াল করাও যায় না। সত্য এবং সূর্য স্বয়ংপ্রকাশ ! পৃথিবীতে চিরন্তন সত্যকে মানবের প্রকৃত ‘ধর্মবোধ’ বা ‘ধর্মাচরণ’-কে আড়াল করে রাখার, দাবিয়ে রাখার – যুগে যুগে প্রচুর চেষ্টা হয়েছে। ভারতীয় প্রাচীন শাস্ত্রাদিতে বিভিন্ন শক্তিশালী রাক্ষস, অসুরদের উল্লেখ রয়েছে – এছাড়াও বিভিন্ন শক্তিশালী নৃপতিদের উল্লেখ রয়েছে – যারা বারবার চিরন্তন সত্যকে, শাশ্বত ধর্মাচরণকে অস্বীকার করে নিজেদের মত প্রতিষ্ঠা করেছে ! দেখা গেছে – তারা বেশ কিছুটা successful-ও হয়েছে, কিছুকাল প্রকৃত ধার্মিক ব্যক্তিগণ অর্থাৎ ‘সুর’ বা দেবগন কষ্ট পেয়েছেন, নির্যাতন সহ্য করেছেন ! কিন্তু তারপর আবার কোনো না কোনো দৈবশক্তির (পুরুষ শরীরে বা নারীশরীরে) প্রভাবে মানব সমাজে আবার একটা সাম্যের ভাব এসেছে, অনেকটা শান্তির বাতাবরণ তৈরি হয়েছে।
তাহলে এখন এই সময়ে দাঁড়িয়ে আমরা যারা পৃথিবীর মানবজাতির এক-একজন সদস্য – তাদের কিরূপ আচরণ করা প্রয়োজন, কিভাবে তাদের আত্মিক উত্তরণের পথ প্রশস্ত হবে (যেটা প্রতিটি মানবের লক্ষ্য) – তার উত্তরে গুরুমহারাজ বলেছেন – ” অসহজ ও জীবনবিরোধী ভাবগুলি কাটিয়ে উঠতে হবে – তাহলেই মানবজাতির অগ্রগতির পথ প্রশস্ত হবে।” উনি মানবজাতিকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন – “প্রেম ও ভালোবাসার শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে, কারণ, প্রেম ও ভালোবাসার শিক্ষা কোনদিনই মানবকে অবক্ষয়মুখী বিপদের দিকে নিয়ে যায় না – তা মানবকে উন্নত করে, মহান করে।”
গুরুমহারাজের এই যে কথাগুলি – এগুলি এই পৃথিবীর সমস্ত মানুষেরই একবার ভাবা দরকার ! আমরা মানবসমাজের প্রচলিত নানারকম শিক্ষায় (সামাজিক শিক্ষা, ধর্মীয় শিক্ষা, রাজনৈতিক শিক্ষা ইত্যাদি) শিক্ষিত হচ্ছি। কিন্তু আমাদের একান্তভাবেই ভাবা দরকার যে, সেই শিক্ষাগুলি মানবকে অবক্ষয়মুখী বিপদের দিকে নিয়ে যাচ্ছে না তো? সেইসব শিক্ষা গ্রহণ করে আবেগের স্রোতে গা ভাসানো হচ্ছে না তো? তাহলে তো সেইসমস্ত শিক্ষার দ্বারা জ্ঞান অর্জনের বদলে আনছে অজ্ঞানতা, মানবকে করে তুলছে পাশবিক, অসহজ ও জীবনবিরোধী ! সুতরাং এটা তো সহজ সিদ্ধান্ত যে, মানবজাতির সর্বাঙ্গীন মঙ্গলের স্বার্থে মানবকে ভারতীয় যুগপুরুষদের প্রদর্শিত প্রেম ও ভালোবাসার শিক্ষা গ্রহণ করতেই হবে।(ক্রমশঃ)