গুরু মহারাজ একবার বনগ্রামে আলোচনা করছিলেন – “এই যে বাংলায় একটা কথা রয়েছে ‘ধূমকেতুর মতো হঠাৎ করে কোথা থেকে এলি’ ? এই কথা বা প্রবাদটি শুনে অনেকেরই ধারণা হয় যে ধূমকেতু বোধহয় মহাকাশে হঠাৎ করে উদয় হয় ৷ তা কিন্তু নয় ! মহাকাশ বিজ্ঞানীরা দেখেছেন যে, বিভিন্ন গ্রহ, উপগ্রহের মতো ধূমকেতুরও একটি নির্দিষ্ট কক্ষপথ রয়েছে এবং এগুলি একটি নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর মহাকাশে প্রকট হয় ৷ যেমন হ্যালির ধূমকেতু নিয়ে কদিন paper -এ খুবই লেখালেখি হ’ল (1992/93) – এটিও ৭০/৭৫ বছর অন্তর পৃথিবী থেকে পরিলক্ষিত হয় । বাকী সময়টা মহাশূন্যে তার নির্দিষ্ট কক্ষপথেই ঘুরে বেড়ায় ।
একদিন বললেন – “লোকটা ‘দেবতার মতো’ সুন্দর, অথবা মেয়েটি ‘দেবীর মতো’_বলে একটা কথা রয়েছে । কিন্তু এই কথা থেকে অনেকেই মনে করে যে – ছেলেটি বা মেয়েটি দেখতে খুব সুন্দর ! কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা নয় ! দেবতা অর্থে ‘যে দেয়’ – যার সদাসর্বদা দেবার প্রবৃত্তি রয়েছে — তিনিই দেবতা বা দেবী! পিতা-মাতা- আচার্য্য বা গুরু দেবতা ! কারণ তাঁরা দেন – বিনিময় আশা করেন না। আবার সূর্য্য, জল, পৃথিবী (মাটি), বাতাস ইত্যাদি দেবতা – কারণ এরাও শুধু দেয় ; এরাও কোন কিছু পাবার আশায় দেয় না ৷
দেবতা মানে যাদের দেহের গঠন, মুখের গঠন সুন্দর–তা নয়, যাদের মন সুন্দর, যাঁদের চেতনার উত্তরণ হয়েছে, যাদের মধ্যে দেবার প্রবৃত্তি জাগ্রত হয়েছে__তাঁরাই প্রকৃত সুন্দর, আর তাঁরাই দেবতা বা দেবী!!
দ্যাখো, দেখতে সুন্দর তো সব দেবতা নয়, যমরাজ ও তো দেবতা ! যমরাজকে আমাদের শাস্ত্রাদিতে তো – কৃষ্ণবর্ণ, ভয়ঙ্কর আকৃতি বিশিষ্ট হিসাবে বর্ণনা করেছে ! শনি ঠাকুর বা শনিদেবকেও তো Good looking দেবতা হিসাবে শাস্ত্র বর্ণনা করেনি ! গণেশ ঠাকুর বা গণপতি বাপ্পাকে দ্যাখো, ওনার শরীরের উপরের অংশে আবার শুঁড় বিশিষ্ট হাতির মাথা বসানো ! সুতরাং দেবতার মতো বা দেবীর মতো — বলতে কখনই মনে কোরোনা যে good looking বা দেখতে সুন্দর !
সারদা মা ছিলেন জগৎজননী ! দেখতে খুব সুশ্রী ছিলেন না তো ! ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ এই জন্যই বলেছিলেন – “এবার ও রূপ লুকিয়ে এসেছে !” তাই বলছিলাম, তোমরা জানবে কোন মানুষকে দেবতা বা দেবী যখন বলা হচ্ছে — তখন তাদের দেখতে সুন্দর হতে হবে তার কোন মানে নাই — তাঁদের অন্তঃকরন সুন্দর হতে হবে । আর শুধু ‘হবে’ নয় হবেই ! তাই তো তারা ‘দেবতা’ বা ‘দেবী’ ৷ এইজন্যই কোন মহাপুরুষ বা মহীয়সীদেরকে ‘দেব’ বা ‘দেবী’ অথবা ‘মা’ সম্বোধনে ভূষিত করা হয় ৷ যেমন বুদ্ধদেব, চৈতন্যদেব, শ্রীরামকৃষ্ণদেব অথবা সারদাদেবী বা সারদা মা, আনন্দময়ী মা ৷
গুরুমহারাজ একদিন siting -এ বসে আছেন। তখন পূর্বদিক টা ফাঁকা শুধু রান্নাঘরটা ছিল আর বাঁদিকে দেড়তলা মাটির ঘর। রান্না ঘরের বাঁদিকটায় অর্থাৎ গুরুমহারাজ যেখানে বসতেন তার সোজাসুজি একটা Tube well ছিল। Tube well টির জল যাওয়ায় নালাটি ছিল দেড়তলা ঘরের দিকে অর্থাৎ এখন যেখানে “সাধনা ভবন”- ওই দিকে! নালা বরাবর একটা বেড়া মতো দেওয়া ছিলো, হয়তো বেড়ার ওদিকে কিছু গাছপালা লাগানো ছিল। গুরুমহারাজ sitting – এ বসে কথা বলছিলেন – হঠাৎ ওনার নজর গেলো ওই নালার ধারে বেড়ার দিকে! বেড়ায় তেলাকুচোর গাছের লতা উঠে বেড়াটা লতায় ভর্তি হয়ে গেছে। আর দু চারটে রাঙা ফল! তেলাকুচোর ফল গুলো পেকে লাল টকটকে হয়ে ঝুলছে! উনি ঐগুলি দেখতে পেয়েই নগেন কে উদ্দেশ্য করে( নগেন সাধারণত sitting – এ গুরুমহারাজের সামনের সারিতে ডানদিকে অর্থাৎ গুরুমহারাজের বাঁদিকে বসত। আর বসত মানে ওটাই ওর নির্দিষ্ট স্থান! কদাচিৎ কোনদিন কেউ বসে পড়লে__ তার বাঁদিকে, তবে প্রথম সারিতে বসেই! অনেক সময় দেরীতে এসে প্রথম সারিতে জায়গা না পেলে -মাটিতেই ডানদিকে বসত। গুরুমহারাজ অন্য কেউ মাটিতে বসতে চাইলে নিষেধ করতেন কিন্তু নগেন কে কোনোদিন এই ব্যাপারে কিছু বলতে শুনিনি।) – বলে উঠলেন- “ওই যে লাল ফল ঝুলছে -ওগুলো কি বলতো নগেন?”- নগেন গুরুমহারাজের কথা শোনা মাত্রই তিড়িং করে লাফিয়ে উঠে দৌড়ে পৌঁছে গেলো বেড়ার ধারে! আর তৎক্ষণাৎ ফিরে এলো গোটা কয়েক পাকা তেলাকুচো হাতে নিয়ে! গুরুমহারাজ বললেন – “এগুলো তো তেলাকুচো” পেকে কেমন লাল রং হয়েছে দেখেছিস! এগুলি পাখিদের খুবই প্রিয় খাদ্য! তাছাড়া এগুলি diabetes -এও ভালো কাজ হয়। যাদের শরীরে sugar আছে, তাদের পক্ষে খুবই ভালো। – এই কথা গুলো বলার পর গুরুজী ওগুলির মধ্যে থেকে একটা লাল ও পুরুষ্ট দেখে তেলাকুচো নিয়ে হাতে দুবার ঘষে নিয়ে খেতে শুরু করে দিলেন।পরিতৃপ্তি সহকারে খেয়ে নিলেন তারপর বললেন -“সামান্য টক ভাব রয়েছে কিন্তু খেতে ভালোই!”
বনগ্রামের sitting -এর ঐ জায়গায় যে কত কান্ড ঘটেছে তা বলে হয়তো শেষ -ই করা যাবে না। তবু আমি যেগুলো প্রত্যক্ষ করেছিলাম অন্তত সেই গুলো সকলের সাথে শেয়ার করার চেষ্টা করছি।ফলে গুরুকৃপা থাকলে এটা আরো কিছুদিন চলতে থাকবে।
এখন যেটা মনে পড়ছে_এটা বোধহয় আগে বলা হয়েছে। তবু নগেন সংক্রান্ত বলেই প্রাসঙ্গিক হবে মনে করে আবার বলছি। সেদিন বিকালের সিটিং-এ গুরুমহারাজ এসে বসলেন। ভক্তরাও একে একে প্রনাম করে যে যার seat এ বসল। গুরুজী আলোচনাও শুরু করলেন। হটাৎ একটা চড়াই পাখি (যেটা ওনারই খড়ের চালে বাসা বেঁধে থাকত)_ওনার ঠিক মাথার উপরে এসে চ্যাঁচামেচি শুরু করে দিল। যেন কত কথা বলতে চাইছে! গুরুমহারাজ উপস্থিত জনদের দিকে তাকিয়েই কথা বলেছিলেন_ওর চ্যাঁচামেচিতে কথা বন্ধ করে উনি পাখিটির দিকে একদৃষ্টিতে খানিকক্ষন চেয়ে রইলেন। তারপর নগেনকে উদ্দেশ্য করে বললেন_”নগেন! দ্যাখ তো আমার ঘরের পিছন দিকে কামিনী গাছটায় বোধহয় একটা সাপ উঠেছে! গাছটার কাছে আমার ঘরের চালের খোপে ওর ছোট বাচ্চারা রয়েছে_তাই ও বিপন্ন বোধ করে আমার সাহায্য চাইছে।”সেদিনও নগেন তিড়িং করে লাফিয়ে উঠেই দৌড় লাগাল(আসলে গুরুমহারাজ যখনই কাউকে নাম ধরে ডেকে কোন কাজের কথা বলতেন__তখন সেই ব্যক্তি আনন্দে, উৎসাহের আতিশায্যে তিড়িং করে লাফিয়েই উঠত!)। তারপর কামিনী গাছের কাছে গিয়ে নগেন বলে উঠল_” হ্যাঁ বাবা! গাছে একটা লাউডগা সাপ রয়েছে। “গুরুমহারাজ বললেন_একটা লাঠি নিয়ে ওটাকে তাড়িয়ে দে”।