শ্রী শ্রী গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের কথা (বলা ও লেখা) এখানে আলোচনা করা হচ্ছিলো। গুরুমহারাজ তার “সহজতা ও প্রেম”- গ্রন্থে বলেছেন – ” প্রিয় আত্মন ! সংসারে মানব যদি কোনো প্রশংসা পায়, তাহলে সে নিজেকে খুব সন্তুষ্ট মনে করতে থাকে।”….. উনি আরও বলেছেন, ” যদি সে সাধারণ লৌকিক মান, আদর ও প্রশংসার প্রতি উদাসীন হয়, তাহলে দেখা যায় – সে আবার অলৌকিক মান ও যশের জন্য উৎকন্ঠিত।” এটা খুবই সত্যি যে, আমরা সাধারন মানুষেরা এই সংসারের মান, যশ, প্রশংসা পাবার জন্য লালায়িত!! এইটা অর্থাৎ প্রশংসা পাবার প্রবৃত্তি প্রতিটি মানবের অন্তরের অন্তঃস্থলে অথবা মনের গোপনভূমিতে অবস্থান করে। সমাজের বেশিরভাগ সদস্যই হয়তো ব্যাপকভাবে প্রশংসা-মান লাভ করতে পারে না, কিন্তু সে তার পরিবারের মধ্যে বা তার ক্ষুদ্র পরিসরেই এটা আশা করে বা পাবার চেষ্টা করে। এই যে অপরকে dominale করার চেষ্টা – এটাও ঐ ‘মান’ পাওয়ার-ই বিকৃত রূপ ! কারণ প্রতিটি মানুষ-ই চায় যে, অপরে তাকে মানুক-গণুক, তাকে বিরাট একটা কিছু ভাবুক – তার পরামর্শ, তার অনুশাসন, তার নির্দেশ সকলে মেনে চলুক !
এবার এখানে মুশকিলটা কি বলুন তো – যে কোনো ব্যক্তি তার মনের সংগোপনে থাকা এই বৃত্তিটি পূরণ হলে খুশি হয়, নিজেকে সুখী ও সৌভাগ্যবান’ বলে মনে করে। কিন্তু ঐটির অপ্রাপ্তিতে নিজেকে দুঃখী এবং হতভাগ্য বলে মনে করে, শোকগ্রস্থ হয়ে বিলাপ করে। এইসব কথা বলার পর গুরুমহারাজ যেটা বললেন তার মূলভাব হোলো – মান-যশ-প্রশংসা-আদরের প্রত্যাশী যারা, তারাই ‘অসহজ’ বা ভ্রান্ত ! এর কারণ তারা ঐগুলির প্রাপ্তিতে সুখী হোচ্ছে, কিন্তু ঐগুলির অপ্রাপ্তিতে দুঃখী হোচ্ছে, শোক করছে, হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। সুতরাং আমাদেরকে অর্থাৎ সাধারণ মানবকে এই অভিমানিক স্তর থেকে উঠে আসতেই হবে – তবেই আমরা ‘সহজ’ হবো, সহজাবস্থা লাভ করবো। কারণ, একমাত্র সহজ মানবই অভিমানিক স্তর থেকে উঠে আসা এই প্রশংসা-মান-যশ অথবা নিন্দা-অযশ-অলাভ ইত্যাদি কোনো কিছুতে বিচলিত হ’ন না।
গুরুমহারাজ আরও বললেন – ” প্রিয় আত্মন ! মানব লৌকিক বা অলৌকিক কিছুই নয়। মানব আনন্দ-স্বরূপ। মানব অমৃত-স্বরূপ। মানব সহজ।” আমাদের চোখের সামনে যে পরিদৃশ্যমান জগৎ – এটাই লৌকিক জগৎ। এই লৌকিক জগতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বার্থবুদ্ধি জড়িত থাকে বলেই লোকে কোনো শক্তিমান-ধনবান-বিদ্বান ইত্যাদিদের অর্থাৎ সমাজের একটু উপরে থাকা লোকদেরকে প্রশংসা করে, মান্যতা দেয়। অপরপক্ষে ঐ মানী ব্যাক্তিও এতে একটা আত্মগর্ব-আত্মপ্রশংসা অনুভব করে এবং যশলাভ করে ধন্য বোধ করে। কিন্তু যদি ঐ ব্যক্তির ব্যক্তিগত ক্ষুদ্র স্বার্থে ঘা লাগে – তখন সে অপমান ও অপযশ বোধ করে। গুরুমহারাজ এটাকে উল্লেখ করে বললেন – ” এইরূপ মানব মান-অপমান, যশ-অপযশ, পুরস্কার-তিরস্কার – এই সমস্ত অভিমানী মনের জগতে আবদ্ধ !”
আমাদের মতো সাধারণ মানুষের__ এই সন্তোষ – আবার এই অসন্তোষ ! এটাকেই গুরুমহারাজ বলেছিলেন – “আত্মপ্রবঞ্চনা”। আর এই আত্মপ্রবঞ্চনাতেই আমরা সততঃ মগ্ন ! কিন্তু এই অভিমানিক স্তরে থাকা মানবকে খুব সহজেই কাজে লাগায় একদল দুষ্টবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ – তাদের ঐ সন্তোষ-অসন্তোষের অভিমানে সুড়সুড়ি দিয়ে ! এরা মানবের এই সূক্ষ্ম সংবেদনকে তাদের আপন স্বার্থে কাজে লাগায় – আর সাধারণ মানুষ বুঝতেই পারে না__ কখন সে তারা ওই দুষ্টুবুদ্ধিসম্পন্ন মানবদের ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেছে ! এরা নানারকম পারিতোষিক দেয়, পুরস্কার দেয় – বিভিন্ন compitition-এর আয়োজন করে দু-চারজনকে সর্বসমক্ষে মান দিয়ে তাদেরকে দিয়ে ওদের নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি ঘটিয়ে নেয়!! ওই দুষ্টুবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরা সাধারণ মানুষকে দন্ড বা শাস্তির ভয়ও দেখায় ! পুরস্কার ও দন্ড এই দুটোই ওই দুষ্টুবুদ্ধিসম্পন্ন শক্তিশালীদের অস্ত্র ! আর সাধারণ মানব ওদের পারিতোষিকের প্রলোভনে পড়ে, তাদের নির্দেশে নানারকম অমানবিক কাজে লিপ্ত হয়ে যায় । অথবা দন্ডের বা শাস্তির ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে নিজের কর্মশক্তি ও সহজতা হারিয়ে ফেলে ওই অমানবিক, সমাজের ক্ষতিসাধনকারী দুষ্টুবুদ্ধিসম্পন্ন শক্তিশালী মানুষদের (রাজনৈতিক, ধর্মনৈতিক, সামাজিক) অনুগামী হয়ে পড়ে বা হোতে বাধ্য হয়। কিন্তু এইরূপ হ‌ওয়াটা সাধারণ মানবের একটা বিরাট ভ্রান্তি !
গুরুমহারাজ এই সমস্ত কথা বলার পর__ এর থেকে পরিত্রাণের উপায় হিসাবে যেটা বললেন তা হোলো – ” মানব যতক্ষণ পর্যন্ত না তার স্বরূপ সম্বন্ধে অবগত হোচ্ছে, যতক্ষণ না সে সহজ হোচ্ছে বা তার আত্মবোধ হোচ্ছে – ততক্ষণ পর্যন্ত মানবের এই ভ্রান্তি দূরীভূত হয় না !” সুতরাং আমরা এটাই বুঝতে পারছি যে, আমাদেরকে__ আমাদের ‘অসহজ’ অবস্থা অতিক্রম করে ‘সহজ’ অবস্থা প্রাপ্ত হোতেই হবে – না হোলে জন্ম-জন্মান্তর ধরে এই ধরনের নানারকম ভ্রান্তির শিকার হয়ে কাটাতে হবে।
এইজন্যেই সাধারণ মানবের উদ্দেশ্যে এ যুগের যুগপুরুষ পরম প্রেমময়-করুণাময় গুরুমহারাজ বলে গেলেন – ” প্রিয় আত্মন্‌ ! মানবের উদ্দেশ্য হয়ে উঠুক – কল্যাণ, সৌহার্দ্য ও শান্তি। মানবের আদর্শ হয়ে উঠুক – অভেদ, প্রেম ও স্থায়িত্ব।”