শ্রী শ্রী গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের কথা (বলা এবং লেখা) নিয়ে আলোচনা করা হচ্ছিলো। “সহজতা ও প্রেম” গ্রন্থের প্রথম অংশে গুরুমহারাজ ‘সহজ’ এবং ‘সহজতা’ নিয়ে-ই তো আলোচনা করেছেন – জগতসংসারকে ‘সহজ’ হবার শিক্ষা দিয়েছেন, ‘সহজ’ ও ‘সহজতা’ সম্বন্ধে সুন্দর ও ‘সহজ’-ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। গুরুমহারাজ বলেছেন – ” প্রিয় আত্মন্ – যা সহজ, তা সহজভাবে ব্যক্ত করাই সহজতা ! বৃথা তর্কের দ্বারা বিষয়কে জটিল করাই হোলো অসহজতা।” কি সুন্দর – প্রাঞ্জল – সহজবোধ্য কথা ! ‘সহজ’-কে সহজভাবে ব্যক্ত করাই ‘সহজতা’ ! সেই হিসাবে অশিক্ষিত, গ্রাম্য বা বনে-জঙ্গলে বসবাসকারী মানুষদের কাছে, এখনো তথাকথিত সভ্যতা যেখানে পৌঁছায়নি – সেখানকার মানুষজন অনেক সরল, অনেক সহজ। এই ধরনের অসভ্য মানুষগুলোর মুখের অনাবিল সারল্যভরা হাসি দেখেই বোঝা যায় – এরা কত সহজ-সরল !
কিন্তু ঐ মানুষগুলোকেই যদি সভ্য সমাজে এনে কিছুদিন রেখে একটু তথাকথিত সভ্য, একটু তথাকথিত শিক্ষিত করে গড়ে তোলা যায় – তাহলেই দেখা যাবে তারাও আমাদের মতোই ধীরে ধীরে ‘অসহজ’ হয়ে উঠছে, তারা তাদের প্রাকৃতিকভাবে প্রাপ্ত সারল্য হারিয়ে ফেলবে। সুতরাং বনবাসী, গ্রামের প্রত্যন্ত এলাকার অধিবাসীদের যে সারল্য বা সহজ অবস্থা – সেটাও কিন্তু গুরুমহারাজ বর্ণিত প্রকৃত ‘সহজতা’ নয় ! প্রকৃত ‘সহজতা’ আসে পরিপূর্ণতায় ! সম্পূর্ণরূপে বিকাশের ভঙ্গিমায় ! সত্যিই তো আমরা সহজ বিষয়কে বৃথা তর্কবিতর্কের দ্বারা জটিল করে তুলি ! যেন এটাই আমাদের মতো সাধারণ শিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত মানুষদের ‘সহজতা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে !
গুরুমহারাজ অর্ধশিক্ষিত বা অশিক্ষিতদের নিয়ে খুব বেশি দুশ্চিন্তা প্রকট করেননি – যতটা উনি প্রকট করেছিলেন so called শিক্ষিতদের ব্যাপারে। শিক্ষিতদের মধ্যে কিছু মানুষ বুদ্ধিকে জীবিকা করে এবং ‘বুদ্ধিজীবী’ নাম নিয়ে সমাজের চরম ক্ষতি করে৷ এরা সাধারণ মানুষকে (অশিক্ষিত, স্বল্পশিক্ষিত অর্থাৎ কম বুদ্ধিমান) তাদের লেখনীর দ্বারা, বক্তব্যের দ্বারা, সভা-সমিতিতে আলোচনার দ্বারা প্রভাবিত কোরে__ এদের নিজ নিজ কল্পনার জগতে নিয়ে যেতে চায়। এতে কি হয় – সাধারণ মানুষেরা ঐসব মান্যিগন্যি ব্যক্তিদের দ্বারা সত্যি সত্যিই খুবই প্রভাবিত হয় এবং সহজ-স্বাভাবিক ধর্মপথ থেকে অনেক দূরে চলে যায় ! সেই অর্থে এই সব so called শিক্ষিতরা মানবসমাজে সভ্য বা ভদ্রবেশে বসবাস করলেও__তারা সমাজের পক্ষে চরম ক্ষতিকারক element !
গুরুমহারাজ বলেছেন – ” সমাজে প্রথম হোতেই (সমাজ যখন থেকে সভ্যতার মুখ দেখেছে – তখন থেকে) কিছু সংখ্যক ব্যক্তি কিছু পারিভাষিক শব্দ দ্বারা ভাবিত থাকেন, আর তা ভাবতে ভাবতেই তারা এতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। ভাবপ্রবণতা হেতু যার যত বেশি কল্পনা, সমাজে তিনি তত বেশি খ্যাতিলাভ করেন।” দেখেছেন ! গুরুমহারাজ কি বললেন – ‘যে যত বেশি কল্পনাপ্রবণ – সে ততো বেশি খ্যাতিলাভ করে ! সুতরাং সামাজিক খ্যাতিমান ব্যক্তি থেকে আমাদের দূরে থাকতেই হবে ! কেন হবে__সেই সম্বন্ধে গুরুমহারাজ বলছেন – ” কিন্তু কল্পনাপ্রবণতা হেতু তাদের ভগবদ্-ভাব ক্ষীণ হয়ে পড়ে। অসহজতা তাদের গ্রাস করে, অবিদ্যারূপ অহংকারবোধ আসে এবং তারা গোঁড়া ধর্ম-উন্মাদে পরিণত হ’ন !” তাহলে আমরা এটাই বুঝতে পারলাম যে, সমাজে খ্যাতিমান ব্যক্তি বলেই তার অনুগামী হবো বা তাকে আদর্শ করবো অথবা তার দলে নাম লিখিয়ে তার স্তুতিগান গাইতে থাকবো – এইটা চরম বোকামি। এই কাজ থেকে আমাদের বিরত থাকতেই হবে। শুধুমাত্র বোধি-ব্যক্তি অথবা মহাপুরুষ বা অবতারপুরুষদের শিক্ষাকেই আদর্শ করতে হবে – না হোলে এইসব কল্পনাপ্রবণ খ্যাতিমান ব্যক্তিরা আমাদেরকে মূল পথ থেকে বহু দূরে নিয়ে চলে যাবে।
গুরুমহারাজ আরো বললেন – ” ঐ সমস্ত ব্যক্তি আপনার(নিজের) কল্পনাপ্রসূত দুর্বল ভাবনারাশিকে শব্দজালে পরিণত করেন এবং সেই বিবেক-বিচারহীন শুষ্ক শব্দমালাকে ‘শাস্ত্র’ বা ‘অনুশাসন’ নামে অভিহিত করতে থাকেন।” এই কথাগুলি থেকে আমরা এটাই বুঝতে পারছি যে. আমাদের শাস্ত্রে যে বলা হয়েছে – ”মহাজনঃ যেন গতাঃ স পন্থা শ্রেয়ঃ”– এইখান থেকে সরে আসলে হবে না। জগতে বহু শাস্ত্রগ্রন্থ রচনা হয়েছে – তার ব্যাখ্যাদিও রয়েছে, কিন্তু আমাদের খেয়াল রাখা উচিত যে, যিনি তাঁর নিজস্ব কল্পনাপ্রসূত ভাবনা দিয়ে কোনো গ্রন্থ বা শাস্ত্রগ্রন্থ রচনা করছেন – তিনি কি বোধি ব্যক্তি ? তাঁর কি নির্বিকল্প সমাধি হয়েছে ? যদি হয় – তাহলে তাঁর শিক্ষা গ্রহণ করো, তাঁর মত অবলম্বন করো ! আর তা যদি না হয় – তাহলে ঐ গ্রন্থ বা শাস্ত্রগ্রন্থ পাঠ করতে যতই চটকদারি লাগুক, তা পাঠ করে যতই মজা পাওয়া যাক, যতই তা মনোগ্রাহী হোক – তা পত্রপাঠ পরিত্যজ্য !
বোধি ব্যক্তিদের সাথে ঐসব পণ্ডিতবর্গদের মধ্যে কি পার্থক্য – সেই ব্যাপারে গুরুমহারাজ বললেন – ” পণ্ডিতগণ শাস্ত্রের উপর ভিত্তি করে ভগবদ্-তত্ত্ব প্রমাণ করতে চান, কিন্তু ‘সহজ সাধক’ (বোধি ব্যক্তিগণ) সাক্ষাৎ অনুভূতির (অপরোক্ষ অনুভূতি বা ব্রহ্মবোধ) উপর ভিত্তি করে তা প্রমাণ করেন।” __এই কথাগুলি থেকে আমরা এটাই বুঝতে পারলাম যে, বোধহীন অপরোক্ষ অনুভূতিহীন পণ্ডিতব্যক্তিগণ যেন নিজে অন্ধস্বরূপ হয়ে অপরকে পথ দেখাবার বৃথা চেষ্টা করছে – আর আমাদের মতো সাধারণ মানুষেরা সেই ফাঁদে পা দিয়ে বিভ্রান্ত হচ্ছি। এই বিভ্রম থেকে বেরোনোর একটাই উপায় – আর তা হলো বোধি ব্যক্তি বা নির্বিকল্পপ্রাপ্ত ব্যক্তি ছাড়া অপর কারো শিক্ষা বা আদর্শকে জীবনে গ্রহণ করা কোনোমতেই উচিত নয়। তা /করলেই আমাদেরকে তারা ভগবদ্-ভাব থেকে ভাটিতে অনেক দূরে নিয়ে চলে যাবে – আর যে পথ পুনরায় আমাদেরকেই আবার উজান পথ বেয়ে make-up দিতে হবে। গুরুমহারাজ পরমসত্য কথা স্বগতোক্তি করে বলেছেন – ” হে পরমেশ্বর ! তোমার কথা সহজ অনুভবের ভিত্তিতে, কিন্তু অসহজ কষ্টকল্পনা দ্বারা জটিল কথা বলে তর্কের বেড়াজাল যারা রচনা করে, তারা শাস্ত্রের ভাববাহী অনুকারক মাত্র । ‘সহজ'(বোধি ব্যক্তি), ধর্মের জীবন্ত উদ্ভব _ উপলব্ধির জীবন্ত বিগ্রহ_ সাক্ষাৎ ধর্মস্বরূপ !”