শ্রী শ্রী গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের কথা (বলা এবং লেখা) নিয়ে এখানে আলোচনা করা হচ্ছিলো। গুরুমহারাজ ‘উপাসনা’ প্রসঙ্গে বিভিন্ন আলোচনা করেছিলেন। উনি বলেছিলেন – ” প্রিয় আত্মন্‌, সাধারণতঃ মানবের অভিমানী মনের স্তর দ্বন্দ্বাত্মক, কেবল বা গুণপ্রদ বা কেবল দোষপ্রদ নয়। গুণের সঙ্গে দোষ, সুবিধার সঙ্গে অসুবিধা, অনুকুলতার সঙ্গে প্রতিকূলতা এবং সুখের সঙ্গে দুঃখ – এরূপ দ্বন্দ্ব চলছে৷ ঐসকল দ্বন্দ্বযুক্ত অভিমানী মনের স্তর হতে সংগ্রাম করে মানবকে মুক্ত হতে হবে। মানবকে আত্মমুখী হতে হবে – অনাত্ম বিষয়ের সাথে সংগ্রাম করে। ঐ অনাত্মক অভিমানী ভাবগুলিই আত্মস্বরূপ জীবনকে আত্মতত্ত্ব থেকে বিস্মৃত রেখেছে। সেইহেতু সুখ, দুঃখ, হর্ষ, বিষাদ – এই সমস্ত ভাবগুলি ঐ অসহজ অভিমানী মনোজগতের চিত্তবিকার। এই অবস্থা হতে সহজ স্থিতিতে যাওয়ার যে কলা – তাই উপাসনা বা আরাধনা।”
সুধী পাঠকবৃন্দ ! গুরুমহারাজের এই মধুর কথামালা থেকে আমরা বেশ কয়েকটা নতুন নতুন term-এর পরিচয় পেলাম। তার মধ্যে প্রথমটা হোলো ‘অভিমানী মনের স্তর’ । এই যে, আমরা অর্থাৎ সাধারণ মানবেরা – সর্বদাই অভিমানিক মনের স্তরে রয়েছি। আর সেইজন্যেই আমরা কোনো বিষয়ে বা বস্তুতে অথবা ব্যক্তিতে ‘স্থির’ থাকতে পারি না। সদাই একটা থেকে অন্যটায় বিচরণ করি। এই কোনোটা ভালো লাগছে – তো পরক্ষণেই সেটা খারাপ লাগতে শুরু করলো। সবসময়েই আমাদের মন দ্বন্দ্বাত্মক ! কিন্তু এই দ্বন্দ্বাত্মক অবস্থা থেকে – অভিমানী স্তর থেকে যতক্ষণ পর্যন্ত না মন ঊর্ধ্বে উত্থিত হচ্ছে, ততক্ষণ আমরা গুরুমহারাজের কথাগুলির মর্মার্থ কি উপলব্ধি করতে পারবো না বোধ করতে পারবো ?
দ্বিতীয় term যেটি আমাদের কাছে নতুন সেটি হোলো – ‘সহজ সংগ্রাম’। উনি বলেছেন – “সহজ সংগ্রাম করে মানবকে মুক্ত হতে হবে।” কোথা থেকে মুক্ত হোতে হবে ? ‘দ্বন্দ্বযুক্ত অভিমানিক মনের স্তর’ থেকে মুক্ত হওয়ার কথা বলেছেন গুরুজী। কিন্তু ‘সহজ সংগ্রাম’-টি কি ? এইটা বুঝতে গেলে গুরুমহারাজের অন্যান্য স্থানে এই প্রসঙ্গে বলা কথাগুলি প্রণিধানযোগ্য। উনি বলেছিলেন যে, “যে কোনো মানুষ যে, যে – অবস্থায় রয়েছে – সে সেই অবস্থা থেকেই আধ্যাত্মিক পথে চলা শুরু করতে পারে।” তাছাড়া উনি আরো বলেছিলেন – ” মানুষ তার আপন বৈশিষ্ট্যকে অক্ষুন্ন রেখে, তার স্বভাবের অনুকূলে সাধন-ভজন করলে দ্রুত আত্মিক উত্তরণ করতে পারে।”
তাহলে এটা বোঝা গেল যে, গুরুমহারাজ সবার জন্য এক বিধানের কথা বলেন নি বরং এক ‘ক্ষুরে’ মাথা কামানোর ব্যাপারে ওনার মোটেই উৎসাহ ছিল না। উনি বলেছিলেন – “পৃথিবীর সাতশো কোটি (১৯৯৫/৯৬ সাল) মানুষের প্রত্যেকের পৃথক পৃথক আরাধনা হোক্ না – তাতে মানুষের আধ্যাত্মিক অগ্রগতি আরও ত্বরান্বিত হবে।” ধর্ম বা অধ্যাত্ম – এইসকল বিষয়গুলিকে আমরা নানাকিছু আরোপ করে অকারণে জটিল করে তুলি। বিভিন্ন নিয়ম, উপাচার, পালন, বার-ব্রত, আঙ্গিক ইত্যাদি নিয়ে বিব্রত থাকি। এটাই অসহজতা। এই অসহজ অবস্থা থেকে মুক্ত হওয়ার চেষ্টাই ‘সহজ সংগ্রাম’।
এরপরের term-টি যেটি আমাদের কাছে একেবারেই নতুন, সেটি হোলো – ‘অনাত্মক অভিমানী ভাব’! অভিমানী মনের স্তরে থাকা মানবেরা (আমরা, যারা সাধারন মানুষ) অনাত্ম বিষয়সমূহ নিয়েই জীবন কাটিয়ে দিই। এক জন্ম থেকে অন্য জন্মে আমাদের যে বারবার যাওয়া-আসা__ তা তো ঐ অনাত্ম বিষয়ের চাওয়া-পাওয়া নিয়েই ! অনাত্ম বিষয়ক অর্থাৎ যা ‘আত্মবিষয়ক’ নয়। ব্রহ্মবাদিনী মৈত্রেয়ী কত হাজার বছর আগে বলেছিলেন, “যেনাহং নামৃতাস্যাম্, কিমাহং তেন কুর্যাম্।”– এখানে ‘অমৃত’ বলতে আত্মবিদ্যা-কেই বলা হয়েছে। যে বিদ্যা অধিগত হোলে মানুষ প্রকৃত অর্থে ‘অমর’ হয় কারণ তখনই মানুষ ‘মৃত্যুভয়’ জয় করে মৃত্যুঞ্জয়ী হোতে পারে।
গুরুমহারাজ উপরোক্ত কথায় আর একটি শব্দগুচ্ছ আমরা পাচ্ছি, সেটা হোলো – ‘অভিমানী মনোজগতের চিত্তবিকার’! এখান থেকে আমরা দুটো দিক খুঁজে পাচ্ছি। একটা হোলো – আমাদের যত রকমের বিকার, অসহজতা, দ্বন্দ্বাত্মক মনোভাব সবই আসছে অভিমানিক মনের স্তর থেকে। ‘অভিমানিক মনের স্তর’ বলতে সহজভাবে আমরা যেটাকে বলি sentimental state ! কারো কোনো কথা আমার মতের সঙ্গে মিললে তা আমাকে সুখ দেয়, সে আমার আপন হয় – আর তা না হোলেই আমি দুঃখ পাই, আমার সাথে তার দূরত্ব তৈরি হয়। এইভাবে, এই যে ‘আমি-আমার’ ভাবকে প্রাধান্য দেওয়া – এটাই ক্ষুদ্র রূপে ‘অভিমান’ (sentiment) আর বৃহৎরূপে ‘অহং'(ego) ! যাইহোক, এই কথার দ্বিতীয় দিকটি হোলো – ‘অভিমানী মনোজগতের চিত্তবিকার’ ! __এইটা সাংঘাতিক কথা ! কারণ আমরা গুরুমহারাজের কাছে শুনেছিলাম – ” চিত্ত যেন হ্রদস্বরূপ, আর সেই হ্রদ থেকে তরঙ্গরূপ বিভিন্ন বৃত্তি উত্থিত উঠছে, যেমন ‘সংকল্প-বিকল্পাত্মিকা বৃত্তি’, ‘নিশ্চয়াত্মিকা বৃত্তি’ এবং ‘অভিমানাত্মিকা বৃত্তি’ – যেগুলি যথাক্রমে মন, বুদ্ধি ও অহংকার রূপে শাস্ত্রে বর্ণিত রয়েছে।” তাহলে ‘অভিমানী মনোজগতের চিত্তবিকার’ – কথাটি যে কতটা তাৎপর্যপূর্ণ তার ব্যাখ্যা করা আমার অসাধ্য ! সুধী পাঠকবৃন্দ, ধ্যানের মাধ্যমেই এর মর্মার্থ অনুধাবন করতে পারবেন বলে আমার মনে হয়।
এরপর গুরুমহারাজ বলেছেন – ” অসহজ অবস্থা হোতে সহজ স্থিতিতে যাওয়ার যে কলা – তাই উপাসনা বা আরাধনা।” সুতরাং এই কথাগুলি থেকে আমরা উপাসনা বা আরাধনার উদ্দেশ্য সম্বন্ধে সম্পূর্ণরূপে অবগত হোতে পারলাম। যেকোনো ধর্মমত বা পথেরই আমরা অনুসারী হই না কেন – যেকোনো আচার-অনুষ্ঠানই আমরা পালন করি না কেন, অর্থাৎ আমরা মন্দিরে গিয়ে দেবতার পূজা করি বা মসজিদে গিয়ে আল্লাহের পীত্যর্থে নামাজ আদায় করি অথবা গীর্জায় গিয়ে যীশুর মূর্তির পাদদেশে বসে প্রার্থনা করি, এইরকম আরো নানাভাবে যে আমরা ঈশ্বরের উপাসনা করি__তার একটাই উদ্দেশ্য হোলো ‘অসহজ অবস্থা’ থেকে ‘সহজ স্থিতি’-তে পৌঁছানো।।