শ্রী শ্রী গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের কথা (বলা এবং লেখা) নিয়ে আমরা এখানে আলোচনা করছিলাম। আমরা ছিলাম গুরুজীর “সহজতা ও প্রেম” গ্রন্থে উল্লিখিত ‘উপাসনা’ বা ‘আরাধনা’ বিষয়ক আলোচনায়। এখন তারই পরবর্তী অংশ। এই অংশে গুরুমহারাজ ভিন্ন ভিন্ন মানব প্রকৃতি বা মানবের স্বভাব ভিন্ন কেন হয় – তার কারণ বলেছেন এবং এই ভিন্নতার জন্যেই যে পৃথিবীতে উপাসনা পদ্ধতির ভিন্নতা – তার সুন্দর ও প্রাঞ্জল ব্যাখ্যা করেছেন। উনি বলেছেন – ” প্রিয় আত্মন্‌, প্রতিটি মানবের আপন প্রকৃতিগত সংস্কার বা স্বভাব বিদ্যমান। মানবের ঐ স্বভাবই হল মানবের বৈশিষ্ট্য। ঐ স্বভাব বা বৈশিষ্ট্য মানবের পূর্ব হতেই সহজাতক্রমে তার প্রকৃতিতে বিদ্যমান থাকে। স্বভাব-নির্দিষ্ট কর্মের দ্বারা ঐ বৈশিষ্ট্যকে রক্ষা করে তার বিকাশ করাই হোলো সাধনা।”
প্রিয় পাঠক ! গুরুমহারাজের এই কথাগুলি দুবার-তিনবার করে ভালোভাবে পড়তে হবে – তারপর এই কথাগুলির মর্মার্থ উপলব্ধি করে নিতে হবে। গুরুমহারাজ মানুষের ‘স্বভাব’-কে বলেছেন “প্রকৃতিগত সংস্কার”, আর এই প্রকৃতিগত সংস্কার বা স্বভাব-ই হোলো মানুষের বৈশিষ্ট্য ! কিন্তু মানুষ এই সংস্কার বা স্বভাব পেল কি করে ? গুরুমহারাজ বললেন – এই স্বভাব বা বৈশিষ্ট্য আমাদের পূর্ব হোতেই বিদ্যমান এবং সেটা সহজাতক্রমে রয়ে গেছে আমাদের প্রকৃতিতে ! এই যে ‘সহজাতক্রমে রয়ে যাওয়া’– এটাই জন্ম-জন্মান্তরের ফলে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতার ফসল। তাহলে গুরুমহারাজের এইসব কথা থেকে আমরা বুঝতে পারছি – আমরা যে ‘স্বভাব’ এবং ‘প্রকৃতি’ এই দুটি শব্দেরই ইংরেজি প্রতিশব্দ করি ‘nature’, এটা কিন্তু সঠিক নয়। কারণ ‘স্বভাব’ হোলো মানবের ‘প্রকৃতিগত সংস্কার’।
যাইহোক, এরপর গুরুমহারাজ ‘উপাসনা’, আরাধনা বা সাধনার একটা নতুন এবং একেবারেই নতুন সংজ্ঞা দিয়েছেন, আর তা হোলো – ‘ আমাদের স্বভাব নির্দিষ্ট-কর্মের দ্বারা ওই বৈশিষ্ট্যকে রক্ষা কোরে – তার বিকাশ করা ‘৷ সুতরাং আমাদেরকে প্রথমেই বুঝতে হবে বা সিদ্ধান্ত করে নিতে হবে যে, আমাদের স্বভাব-নির্দিষ্ট কর্মটি কি ? উদাহরণ হিসেবে বলা যায় – কারো হয়তো স্বভাবে শিক্ষকতা রয়েছে কিন্তু সে কেরানীর কাজ করছে, কারো স্বভাবে প্রযুক্তি বা কারিগরি বিদ্যা রয়েছে – কিন্তু সে ওকালতি পেশায় যুক্ত হয়েছে, কারো স্বভাবে ‘সেবা’ করার মানসিকতা রয়েছে – কিন্তু সে অভাবজনিত কারণে শ্রমিকের কাজ করছে – এইভাবেই মানুষ সারাজীবন তার স্বভাব-নির্দিষ্ট কর্মের বিরুদ্ধে যেতে বাধ্য হয় এবং এরফলেই মানবের বৈশিষ্ট্যকে রক্ষা কোরে__ তার বিকাশসাধন সম্ভব হয়ে ওঠে না। আর সেইজন্যেই মানবের জন্ম থেকে জন্মান্তর কেটে যায় কিন্তু সাধনার সঠিক ফল পাওয়া হয়ে ওঠে না।৷
গুরুমহারাজ তাঁর কবিতায় সকল মানুষকে আহ্বান করে বলেছেন –
” প্রিয় আত্মন্‌ – তুমি চলছো, তাই জীবিত, তাই তুমি জীবন।_
জড়েরা মৃত–আত্মবিস্মৃত, জড়েরা মৃতের সমতুল্য।_
এই বিশ্বসংসার স্রোতের মতো প্রবাহমান।৷_
একই উৎস হোতে সুর-ছন্দ ও তালে প্রবাহিত হয়ে_
ঐ মহাসঙ্গীতের সুরে বিলীন হোচ্ছে,_
আর ঐ মহাসঙ্গীত বেজে চলেছে অনাদি অনন্তকাল ধরে।_
সময় তার নিকট তুচ্ছ, ক্ষণিক স্বপ্নমাত্র।৷_
তুমি সেই অবিনাশী সত্তার প্রকাশ, আর এই মহাবিশ্বের_
প্রতিটি কণায় কণায় ঐ মহাসঙ্গীদের সুর বেজে চলেছে।৷”
এই যে গুরুমহারাজ বললেন – “তুমি চলছো” – এই চলা মানে হাঁটাচলা নয়। এই চলা উপনিষদের ‘চরৈবেতি’ ! আধ্যাত্মিক পথে চলা – উজান পথে চলা, কুলকুণ্ডলিনী শক্তিকে জাগ্রত করে ঊর্ধ্বগামী গতিতে একটি একটি চক্র ভেদ করে প্রিয় মিলনের ন্যায়, অভিসারিকা রাধার ন্যায় বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে এগিয়ে চলা ! এই পথে এগিয়ে চলা পথিকেরাই জীবিত, বাকিরা যেন ‘জড়’, যেন মৃতবৎ! এই সমগ্র বিশ্বসংসার প্রবহমান স্রোতের মতো এবং যে স্রোতের উৎস একই, যা সুর – ছন্দ ও তাল যুক্ত হওয়ায় সংগীতের ন্যায় সুললিত – সুশৃংখল এবং যা এক মহা ছন্দোবদ্ধতা বা মহাসংগীতের সুরে বিলীন হোচ্ছে। এই মহাবিশ্বের প্রতিটি কণা সেই মহাসংগীতের সুরেই রয়েছে, সুতরাং প্রতিটি জীব তথা প্রতিটি মানুষও সেই অবিনাশী সত্তার প্রকাশ হওয়ায় আমরাও সেই মহাসঙ্গীতের সুরের মধ্যেই আছি। যদি আমাদের জীবনে সুর ঐ মহাসঙ্গীতের সুরের সাথে মিলে যায় – তাহলেই আমরা আমাদের ক্ষুদ্র অহংকার বা অভিমানের জগৎ থেকে মুক্ত হয়ে বিশ্ব অহং-চেতনায় উন্নীত হোতে পারবো। আর এরফলে মানব জীবনের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবার পথ সুগম হবে।
কিন্তু সেটা সংখ্যায় “কোটিকে গুটিক”! আর আমাদের বেশিরভাগেরই জীবনে চলার পথের ছন্দ-তাল-সুর ঐ মহাসঙ্গীতের ছন্দ-তাল-সুরের সাথে মেলে না ! ফলে আমাদের অগ্রগতির তাল কেটে যায়, আধ্যাত্মিক উন্নতির পথ সুরযুক্ত বা ছন্দবদ্ধ হয় না – সবকিছুই গোলমাল হয়ে যায়। এইজন্যেই তো গুরুমহারাজ বললেন – ” প্রিয় আত্মন্ – তোমার হৃদয়ের নিভৃত কুঞ্জে, ঐ সংগীতের সুর বাজছে।_
তুমি উদ্দীপ্ত করো, জীবনের প্রতি সুতীব্র ভালোবাসা।_
তুমি জেগে ওঠো–জীবনের বোধে।_
তোমার জীবনসঙ্গীত তরঙ্গে তরঙ্গে–মূর্ছনায় মুখরিত হয়ে উঠুক,_
হে সাক্ষাৎ জীবন দেবতা, আলিপ্সার আবিলতা মুক্ত তুমিই সেই প্রথম প্রেম।_
অন্ধ, জড় সুষুপ্তি হতে উঠে আসা তুমিই সেই প্রথম প্রজ্ঞা বা জ্ঞান।_
বিস্মৃতির অতল হতে উঠে আসা–তুমিই সেই আনন্দ স্বরূপ পরম প্রকাশ।৷”